Ajker Patrika

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কোন পক্ষকে কতটা ছাড় দিতে হবে

অনলাইন ডেস্ক
স্থায়ীভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ কী আদৌও সম্ভব? ছবি: সংগৃহীত
স্থায়ীভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ কী আদৌও সম্ভব? ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মতি দিয়ে কৌশলগতভাবে রাশিয়াকে চাপে ফেলেছে ইউক্রেন। এত দিন শান্তির কথা বলার পর এখন যদি রাশিয়া বেঁকে বসে, তাহলে খলনায়ক হয়ে যেতে পারে মস্কো। পুতিন সব সময়ই শান্তির কথা বলে মুখে ফেনা তুললেও তিনি এখনো ‘তালগাছটি আমার’ অবস্থান নিয়েই আছেন। এমন পরিস্থিতিতে স্থায়ীভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আর সম্ভব হলে কোন পক্ষকে কতটা ছাড় দিতে হবে, তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস।

রাশিয়া ও ইউক্রেন আসলে কী চায়?

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ মুহূর্তে আসল খেলা খেলছে রাশিয়াই। তাদের ভাষ্য, রুশ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনকে প্রলোভন দেখাচ্ছে যে, রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে যেভাবে এগোচ্ছে তারা তাতে যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে লাভবান হচ্ছে। তবে ট্রাম্প প্রশাসনকে প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের আখের গোছানোই রাশিয়ার মূল্য লক্ষ্য। অন্যদিকে, ইউক্রেন চায় বাইডেন শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের যে দহরমমহরম ছিল, ট্রাম্প শাসনামলেও তা বজায় রাখতে।

জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের জ্যেষ্ঠ অ্যাসোসিয়েট বলেন, মস্কোর লক্ষ্য হলো, ট্রাম্প প্রশাসনকে এমন একটি চুক্তিতে প্রলুব্ধ করা, যাতে মার্কিনিদের মনে হবে যে, তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করতে পেরেছে। কিন্তু আসলে তারা রাশিয়ার স্বার্থ হাসিল করবে। আর রাশিয়ার মূল উদ্দেশ্য কিয়েভের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। অন্যদিকে, ইউক্রেনের লক্ষ্য হলো, যুক্তরাষ্ট্রের বিভ্রান্তি দূর করা এবং তাদের বোঝানো যে, এই পুরো ব্যাপারটাতে রাশিয়াই আসল ভিলেন। রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আসলে একটি অনুসন্ধানপ্রক্রিয়া যে, রাশিয়া আর ইউক্রেন আসলে কী চায়।

যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি দেওয়ায় আবারও মার্কিন প্রশাসনের পূর্ণ সহাভূতি পাচ্ছে ইউক্রেন। অথচ এর ঠিক এক সপ্তাহ আগেও দুই পক্ষের মধ্যে স্পষ্ট বিরোধ ছিল। এমনকি ওভাল অফিসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মধ্যে চরম বাগ্‌বিতণ্ডাও হয়। যার জেরে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা ও গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ইউক্রেন রাজি হওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে সে স্থগিতাদেশ তুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

ভূখণ্ড নিয়ে সমঝোতা কি সম্ভব?

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রাশিয়ার দখলে চলে যাওয়া ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। যুদ্ধ শুরুর আগেই ২০১৪ সালেই পেনিনসুলার ক্রিমিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করেছে মস্কো। যুদ্ধ শুরুর পর তিন বছরে ইউক্রেনের এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ডের দখল নিয়ে ফেলেছে রাশিয়া। যার মধ্যে রয়েছে দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝিয়া এবং খেরসন। তবে এই চার অঞ্চলের কোনোটিরই সম্পূর্ণ এলাকা দখল করতে পারেনি রাশিয়ার সেনারা। যুদ্ধ স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হলে অঞ্চলগুলো থেকে ইউক্রেনের সেনা প্রত্যাহার করতে হবে—এমন শর্ত জুড়ে দিয়েছে রাশিয়া।

তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, রাশিয়ার এমন শর্ত কখনোই মেনে নেবে না ইউক্রেন। তাঁর ভাষ্য, আনুষ্ঠানিকভাবে এই অঞ্চলগুলোর ওপর রাশিয়ার কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেওয়া মূলত দেশটির আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকে পুরস্কৃত করারই শামিল। জেলেনস্কি বলেন, ‘আমাদের ভূখণ্ডে রাশিয়ার দখলদারত্ব কখনোই মেনে নেব না আমরা। যত সমঝোতাই হোক, এ ইস্যুটি আমরা কখনোই ভুলে যাব না।’

ইউক্রেনকে কি নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে হবে?

নানা চড়াই-উতরাইয়ের পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অবশেষে মেনেই নিয়েছেন যে, পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগ দেওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। অন্তত ট্রাম্প প্রশাসন যত দিন আছে, ততদিন ন্যাটোতে যোগদানে ইউক্রেনের কোনো আশা নেই। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ ইউক্রেনের সার্বোভৌম অধিকার বলে দাবি করেছে দেশটি।

তবে রাশিয়া চায় না ইউক্রেন কোনো আন্তর্জাতিক জোটের সদস্য হোক। আর তা নিশ্চিতে পশ্চিমা বহু নেতার সঙ্গে যোগসাজশ করে নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। ইউরোপীয় এক কূটনীতিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, ইউক্রেনকে ভূরাজনৈতিকভাবে অস্ট্রিয়ার মতো কোনো দেশে পরিণত করতে চায় রাশিয়া, যেখানে সাংবাধিকভাবে নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা থাকবে। তা নিশ্চিত হলে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তিনি জেলেনস্কিকে সরিয়ে দেশটিতে রুশ অনুগত একটি সরকার বসাতে পারবেন।

রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাবেক জেষ্ঠ্য পরিচালক থমাস গ্রাহাম বলেন, ক্রেমলিন ইউক্রেনকে বেলারুশের মতো রাশিয়ার প্রভাববলয়ে রাখতে চায়, আর কিয়েভ চায় পশ্চিমাদের সঙ্গে জোট করবে। দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে পুরোপুরি বিপরীত দুটি

মতামত, যা নিয়ে প্রকৃতপক্ষে কোনো আপস হতে পারে না।

নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পাবে কি ইউক্রেন?

যদি ন্যাটোতে যোগদান সম্ভব না হয় তাহলে মিত্রদের কাছ থেকে নিজেদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায় ইউক্রেন। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এরই মধ্যে বলেছে ইউক্রেনকে নিরাপত্তা দিতে তারা একটি বিশেষ বাহিনী দেশটিতে মোতায়েন করতে আগ্রহী। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনও চেয়েছিল দেশগুলো, যা নাকচ করে দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।

এদিকে, ন্যাটো সদস্যভুক্ত কোনো দেশ ইউক্রেনে সেনা মোতায়েন করলে তা মেনে নেবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ক্রেমলিনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, ‘ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডে অন্য কোনো দেশের সেনাশক্তি পুতিন মানবেন না। কারণ, ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশের সেনা ইউক্রেনে মোতায়েন আর ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া একই কথা।’

সামরিক শক্তি কমাতে কিয়েভ বাধ্য হবে?

ইউক্রেনের যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই দেশটির সামরিক শক্তি কমানোর দাবি করে আসছে রাশিয়া। তাদের দাবি, ইউক্রেনের সেনাসংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি হতে পারবে না। পাশাপাশি, কিয়েভের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। জাতিসংঘেও বারবার এ কথা তুলেছেন রুশ প্রতিনিধি।

কিন্তু পুতিনের এ দাবিকে অবান্তর আখ্যা দিয়েছে কিয়েভ ও তার মিত্ররা। সম্প্রতি ইউক্রেন তথা পুরো ইউরোপই নিজেদের সামরিক শক্তি আরও বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। বিশেষ করে ইউক্রেনের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলো। কারণ, ইউক্রেনই রাশিয়ার ইউরোপে ঢোকার দরজা। তাই ইউক্রেন সামরিকভাবে যত বেশি শক্তিশালী হবে, ইউরোপের জন্য রুশ হুমকিও তত কমবে।

যেহেতু পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনে সরাসরি সেনা মোতায়েন করতে পারছে না, তাই দীর্ঘ মেয়াদে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করাই তাদের নিরাপত্তার সবচেয়ে কার্যকর গ্যারান্টি হতে পারে।

ভলোদিমির জেলেনস্কির ভবিষ্যৎ কী?

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে অবৈধ প্রেসিডেন্ট আখ্যা দিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, কোনো শান্তিচুক্তিতে সই করার এখতিয়ারই নেই তার। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর রুশ প্রেসিডেন্টের সে কথাই প্রতিধ্বনিত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অবশ্য তিনি আরও এককাঠি সরেস। জেলেনস্কিকে রীতিমতো স্বৈরাচারই আখ্যা দিয়ে বসেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইউক্রেনকে যত দ্রুত সম্ভব নতুন নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে ইউক্রেনের সংবিধান অনুযায়ী, যুদ্ধকালীন সামরিক আইন চলাকালে নির্বাচন সম্ভব নয়। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বলছেন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি চূড়ান্ত করার আগে ইউক্রেনের নির্বাচন নিয়ে চাপ সৃষ্টি করতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন। কিন্তু তা হলে ইউক্রেনে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। যুদ্ধ চলাকালে সামরিক আইন বাতিল করা নিয়ে মতবিরোধ হতে পারে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে।

এদিকে গতকাল বুধবার প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি নিজেই বলেছেন, ‘সামরিক আইন তুলে নেওয়া হলেই কেবল নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করা হবে, তার আগে নয়।’

রাশিয়ার ওপর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা উঠবে কি

২০১৪ সালে একের পর এক আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত হয়েছে রাশিয়া। ২০২৩ সালে যুদ্ধবিরতি নিয়ে যখন তৎপরতা চলছিল, তখন রাশিয়ার ওপর থেকে পশ্চিমাদের সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তা বাস্তবায়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কারণ পুরোদস্তুর ব্যবসায়িক ট্রাম্প মস্কোর সঙ্গে নতুন ব্যবসায়িক সম্ভাবনা খুঁজছেন। কিছু ইউরোপীয় নেতা ইতিমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, ওয়াশিংটন রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার কথা ভাবছে, যাতে মস্কোকে একটি চুক্তিতে আসতে উৎসাহিত করা যায়।

অন্যদিকে, ইউক্রেন চায় ইউরোপ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করুক এবং প্রায় ২০০ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের জব্দ করা রুশ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করুক। ইউরোপীয় নেতারাও ইউক্রেনের প্রস্তাবিত এ ধারণার দিকে ঝুঁকছেন, কারণ এটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের হাতে থাকা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক অস্ত্রের একটি।

ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন ইফ্ফাত আরা খন্দকার

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত