Ajker Patrika

ওপেনএআই এবং একজন স্যাম অল্টম্যান

মোস্তাফিজ মিঠু, ঢাকা
স্যাম অল্টম্যান। ছবি: সংগৃহীত
স্যাম অল্টম্যান। ছবি: সংগৃহীত

২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর। এক অনলাইন মিটিংয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে ওপেনএআইয়ের সিইও এবং প্রতিষ্ঠাতা স্যাম অল্টম্যানকে হঠাৎ চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলো। স্যাম কোনো সাধারণ মানুষ তো নন, তাই তাঁর চাকরি ছাঁটাইয়ের খবরও সাধারণ ছিল না। স্যাম হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি এর আগের এক বছরে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।

স্যাম অল্টম্যানকে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের দিক থেকে ‘আধুনিক দুনিয়ার স্টিভ জবস’ হিসেবে দেখা হয়; বিশেষ করে স্টিভ জবস যেমন উদ্ভাবনী ক্ষমতার মানুষ ছিলেন, স্যাম তার চেয়ে ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে বিবেচিত হন। এই তুলনা শুধু মুখেই নয়, তিনি কাজ দিয়েও সেটি প্রমাণ করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের চ্যাটজিপিটি মাত্র দুই মাসে পেয়েছিল ১০০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী! কয়েকটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে, এই অর্জনও কীভাবে ইতিহাস গড়েছে।

এই ১০০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী পেতে ইনস্টাগ্রামের সময় লেগেছে প্রায় আড়াই বছর। টিকটিক একই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সময় নিয়েছিল প্রায় এক বছর। কিন্তু চ্যাটজিপিটি মাত্র দুই মাসের মধ্যে ১০০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। সেই সঙ্গে স্যামের নেতৃত্বে ওপেনএআই নামের প্রতিষ্ঠানটির মূল্য পৌঁছে গিয়েছিল শূন্য থেকে ৯০ বিলিয়ন ডলারে!

চাকরি যাওয়ার এই প্রসঙ্গ নিয়ে লেখার পরের অংশে আলোচনা করা যাবে। তার আগে স্যাম অল্টম্যানকে নিয়ে আরও কিছু তথ্য জানিয়ে রাখি।

৮ বছর বয়সে তৈরি করেন কম্পিউটার প্রোগ্রাম

স্যাম অল্টম্যান জন্মেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে, ১৯৮৫ সালের এপ্রিলে। ছোটবেলা থেকে কম্পিউটার ও প্রোগ্রামিংয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল। মাত্র ৮ বছর বয়সে তিনি নিজের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরি করেছিলেন। হাইস্কুলে থাকাকালীন তাঁর নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের আগ্রহ আরও তীব্র হয়। স্নাতক স্তরে তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনার জন্য। তবে কলেজ শেষ করার আগেই তিনি থেমে যান। কারণ, প্রযুক্তি ও স্টার্টআপে কাজের সুযোগ তাঁর কাছে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ২০০৫ সালে ‘লুপ্ট’ নামে নিজের প্রথম স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা করেন স্যাম। সেটি ছিল লোকেশনভিত্তিক সামাজিক নেটওয়ার্কিং অ্যাপ। এটি যদিও পরে বড় লাভে বিক্রি হয়নি, তবু এটি তাঁকে সিলিকন ভ্যালির স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে পরিচিতি এনে দেয়।

ক্যারিয়ারে নাটকীয় মোড়

স্যাম মানুষ হিসেবে যেমন বর্ণাঢ্য, তেমনি বর্ণিল তাঁর ক্যারিয়ার। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি যুক্ত হন ওয়াই কম্বিনেটরে। এই প্রতিষ্ঠান স্টার্টআপ জগতে সবচেয়ে শক্তিশালী ইনকিউবেটরগুলোর একটি। এটি মূলত নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুরু থেকে সফল করার জন্য ফান্ডিং, পরামর্শ, স্ট্র্যাটেজি ও নেটওয়ার্কিং সুবিধা দিয়ে থাকে। স্যাম অল্টম্যানও ওয়াই কম্বিনেটরে তাঁর ছোট্ট প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে যোগ দেন। ইনকিউবেটরের সহায়তায় তিনি সেটিকে বড় করেন এবং পরে বিক্রি করে ৫ মিলিয়ন ডলার আয় করেন। তাঁর এই অর্থ আবার বিভিন্ন টেক স্টার্টআপে বিনিয়োগ করে ১০০ মিলিয়ন ডলার আয় করেন। এরপর তাঁকে ওয়াই কম্বিনেটরের প্রেসিডেন্ট করা হয়। পদটি ছিল হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডিনের সমমর্যাদার। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রভাব পুরো সিলিকন ভ্যালিতে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যান

ওয়াই কম্বিনেটরের প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দিতে পারে—এমন কথা হয়তো কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেন না। তেমন শোনা যায়নি স্যামের আগে। কয়েক বছর এই পদে কাজ করার পর তিনি উপলব্ধি করেন, তাঁর জীবনে আর নতুন কিছু অর্জনের সুযোগ নেই। তাই তিনি ওয়াই কম্বিনেটরের প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়ে দিয়ে ওপেনএআই শুরু করেন।

ওপেনএআইয়ের সূচনা

ওপেনএআই স্যাম অল্টম্যানের নতুন উদ্যোগ। শুরু করেন ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই প্রতিষ্ঠান শুরুর সময় ইলন মাস্কও এতে বিনিয়োগ করেন। স্যামের একটি বিশেষ ক্ষমতা হলো, সহজে বোঝানোর ক্ষমতা অর্থাৎ কনভিন্সিং পাওয়ার। মানুষকে তিনি নিজের ভিশন ও পরিকল্পনার প্রতি বিশ্বাসী করে তুলতে পারেন খুব দ্রুত। এই ক্ষমতার কারণে তিনি ওপেনএআইয়ে যোগ দেওয়ার জন্য স্ট্রাইপের জনপ্রিয় সিটিও গ্রেগ ব্রকম্যানকে রাজি করাতে সক্ষম হন। গ্রেগও স্যামের নেতৃত্বে আস্থা রেখে পুরোনো কাজ ছেড়ে ওপেনএআইয়ে যোগ দেন।

এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ছিলেন স্যাম অল্টম্যান, ইলন মাস্ক, গ্রেগ ব্রকম্যান, ইলিয়া সুতস্কেভার, ভিকি চেং, আন্দ্রেই কারপাথি, ট্রেভর ব্ল্যাকওয়েল, জন শুলম্যান, পামেলা ভাগাতা, ডার্ক কিংমা ও জেসিকা লিভিংস্টোন। প্রথম দিকে ওপেনএআইয়ের সদর দপ্তর ছিল সানফ্রান্সিসকোতে, তবে ২০২৩ সালের শেষে ইলন মাস্কের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে প্রতিষ্ঠানের ওই অফিস ছেড়ে দেওয়া হয়।

ওপেনএআইয়ের মূল লক্ষ্য ছিল কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা তৈরি করা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি দ্রুত বড় হয়েছে এবং বর্তমানে এটি চ্যাটজিপিটি, ডাল-ই, কোডেক্স, হুইসপারসহ বিভিন্ন শক্তিশালী এআই পণ্য বাজারে এনেছে।

স্যামের বরখাস্ত হওয়ার খবরে ৬০০ কর্মী চাকরি ছাড়েন

প্রশ্ন হলো, প্রতিষ্ঠাতাকে কি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যায়? উত্তর হলো, হ্যাঁ। প্রতিষ্ঠাতা হওয়া মানে বেতন বা সিইওর ক্ষমতা পাওয়া নয়। স্যাম সব সময় প্রতিষ্ঠাতা থাকবেন, কিন্তু সিইও পদ থেকে সরানো সম্ভব। বোর্ডের বক্তব্য অনুযায়ী, স্যাম প্রতিষ্ঠানের সবকিছুর বিষয়ে পরিষ্কার তথ্য দেননি। গুগল মিটের সেই মিটিংয়ে বোর্ডের সব সদস্য উপস্থিত ছিলেন এবং স্যামকে জানানো হয়, তিনি আর সিইও থাকতে পারবেন না। এরপর ঘটে নাটকীয় মোড়।

ওপেন এআইয়ের ৬০০ কর্মী একটি চিঠি প্রকাশ করেন। তাঁরা জানান, যদি স্যাম ফেরত না আসেন, তাঁরা সবাই চাকরি ছেড়ে দেবেন। এমনকি স্যামের সঙ্গী প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগ ব্রোকম্যানও ছিলেন সেই তালিকায়।

মাইক্রোসফটে যোগদান

স্যাম অল্টম্যানকে ওপেনএআইয়ের সিইও পদ থেকে সরানো হলে প্রযুক্তি জগতে অনেক নাটকীয় মোড় আসে। স্যাম তখন মাইক্রোসফটের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। একই সময়ে তাঁর সহপ্রতিষ্ঠাতা গ্রেগ ব্রোকম্যানও চাকরি ছেড়ে দেন এবং মাইক্রোসফটে যোগ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। এমনকি মাইক্রোসফট ঘোষণা দেয়, তারা সেই ৬০০ কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে আসতে রাজি। এমনকি মাত্র এক দিনের মধ্যে ৬০০ কর্মীর জন্য অফিস গুছিয়ে ফেলে মাইক্রোসফট। সেই এক ঘোষণায় শেয়ারবাজারে মাইক্রোসফটের শেয়ারের দাম হয়ে যায় ঊর্ধ্বমুখী।

স্যাম আবারও ফিরলেন

স্যামের চলে যাওয়ায় ওপেনএআই তখন প্রায় ফাঁকা। এমন অবস্থায় পুরোনো বোর্ডের সবাই পদত্যাগ করেন। নতুন বোর্ড গঠনের সঙ্গে যুক্ত হন প্রযুক্তিবিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি। এই নতুন বোর্ডের প্রথম সিদ্ধান্ত হয় স্যামকে সিইও পদে রাখার। সেই সঙ্গে ফিরে আসেন ৬০০ কর্মীও।

বলা হয়, এআই এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাবে, যেখানে মানুষের প্রয়োজনই থাকবে না। চ্যাটজিপিটি নিজেই নিজের ইনস্ট্রাকশন তৈরি করে সমস্যার সমাধান করবে। আর এই উদ্ভাবনের নাম এজিআই। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, স্যাম অল্টম্যান হয়তো শিগগির এজিআই-কে বাজারে নিয়ে আসবেন।

এখন কেবল অপেক্ষা, এজিআই ও তার ভবিষ্যতের গল্প কোথায় গড়ায়, সেটা দেখার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হলো লতিফ সিদ্দিকীর ভাইকে

হাতকড়া ও শিকল পরিয়ে আরও ৩০ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাল যুক্তরাষ্ট্র

গোয়ালন্দে ‘নুরাল পাগলার’ লাশ তুলে পুড়িয়ে দিল বিক্ষুব্ধরা, আহত অর্ধশত

গরম মাড় পড়ে শিশু দগ্ধ, গলা টিপে হত্যার পর বস্তায় ভরে পুকুরে ফেলেন চাচি

পবায় মাইকে স্লোগান দিয়ে খানকা ভাঙচুর, নীরব ছিল দুই গাড়ি পুলিশ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত