Ajker Patrika

ইলন মাস্কের টুইটারে বাক্‌স্বাধীনতা কতটা থাকবে

আব্দুর রহমান
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২২, ১৮: ০৮
ইলন মাস্কের টুইটারে বাক্‌স্বাধীনতা কতটা থাকবে

প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার কিনে নিতে যাচ্ছেন টেক জায়ান্ট টেসলা ও স্পেস-এক্সের মালিক ইলন মাস্ক। এই খবর পুরোনো। কিন্তু হঠাৎ ইলেকট্রিক গাড়ি ও রকেট ইঞ্জিন প্রযুক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগকারীর টুইটার কিনে নেওয়ার কারণটা কী? মাস্ক নিজেই এই প্রশ্নের একটি সহজ জবাব দিয়েছেন। আর তা হলো—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বাক্‌স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। 

মাস্ক নিজেকে সব সময়ই ‘বাক্‌স্বাধীনতার একজন নিরঙ্কুশ সমর্থক’ হিসেবে দাবি করেছেন। গত সোমবার টুইটার কিনে নেওয়া প্রসঙ্গে দেওয়া এক বিবৃতিতে মাস্ক টুইটারের সব ব্যবহারকারীকে নতুন নতুন ফিচার উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এমনকি মাস্ক এক টুইটে জানিয়েছেন, ‘বাক্‌স্বাধীনতা একটি কার্যকরী গণতন্ত্রের ভিত্তি এবং টুইটার হলো সেই ডিজিটাল জনপরিসর যেখানে মানবতার ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক হয়।’ 

মাস্ক বলেছেন, ‘আমি টুইটারকে আরও ভালো অবস্থানে নিতে চাই।’ নতুন ফিচার যুক্ত করা, আস্থা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এর অ্যালগরিদম উন্মুক্ত (ওপেন সোর্স) করা, স্প্যাম প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং সেই সঙ্গে সব ব্যবহারকারীর পরিচয় নিশ্চিতের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে সেই লক্ষ্য অর্জন করতে চান তিনি। আরেক টুইটে ইলন মাস্ক বলেছেন, ‘আমি আশা করি, আমার সবচেয়ে কঠোর ও বাজে সমালোচকও টুইটারে বহালতবিয়তে থাকবেন। কারণ, এটাই হলো স্বাধীন মত বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা।’ 

অবশ্য গত কয়েক বছর ধরে মিথ্যা ও ভুয়া তথ্যের বিস্তার প্রতিরোধ নিয়ে হিমশিম খেতে থাকা টুইটারকে আরও স্বচ্ছ ও নিরাপদ করতে ইলন মাস্ক আসলে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেবেন, সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। তিনি তাঁর পরিকল্পনার কথা কখনো পরিষ্কার করে বলেনও না। তবে ইলন মাস্কের মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে অসাধ্য কিছু করে দেখানোর বিষয়টি খুব ভালোমতোই যায়। এর আগেও একাধিকবার মাস্ক অসাধ্যসাধন করে দেখিয়েছেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, অন্যান্যবারের তুলনায় তাঁর এবারের যাত্রাটি একেবারেই আলাদা। অন্যান্যবার যেখানে মাস্কের সামনে প্রযুক্তিগত বাধা ছিল, এবার তার পরিবর্তে তাঁর সামনে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক বাধা প্রবলভাবে হাজির হবে। এবং এই বাধাগুলো উতরে যাওয়াই হবে ইলন মাস্কের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের একমাত্র উপায়। 

যাত্রা শুরুর পর থেকে মাত্র দুই অর্থবছরে লাভের মুখ দেখতে পেরেছে টুইটার। যদিও ব্যবহারকারীর সংখ্যার ভিত্তিতে বিশ্বের সেরা ১০ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তালিকায় নেই টুইটার, রয়েছে ১৫ নম্বরে। ইলন মাস্ক তবে কেন এমন একটি প্রতিষ্ঠানের পেছনে ৪৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করলেন? এর উত্তর দিয়েছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিডিয়া ম্যাটারসের প্রধান অ্যাঞ্জেলো ক্যারুসোন। তিনি বলেছেন, ‘আর্থিক কারণে মাস্ক টুইটার কেনেননি, যদিও তিনি মনে করেন এ থেকে কিছু অর্থ আয় করাও সম্ভব। তবে তিনি মূলত এটি কিনেছেন মতাদর্শগত কারণে। এবং এটিই সবচেয়ে ভয়ের বিষয়।’ 

টুইটারের বাক্‌স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য মাস্ককে লড়তে হবে বিভিন্ন ফ্রন্টেভুল তথ্য ও ঘৃণাত্মক বক্তব্য ছড়ানোর বিষয়টিই আজকের দুনিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। টুইটারও এর বাইরে নয়। গতবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে টুইটার প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ভুল তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছিল। এই ভুল তথ্য ও ঘৃণাত্মক বক্তব্য ছড়ানো ঠেকাতে কী করা হবে, তার সামান্য ইঙ্গিত মাস্ক দিলেও উন্মুক্ত জনপরিসর হওয়ায় এ ধরনের কনটেন্টের পরিমাণ আরও বেড়ে যায় কি না, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা রয়েছে। তাঁদের মতে, চরমপন্থা, অতি-ডান, অতি-বামের মতো রাজনৈতিক মতাদর্শও এ সুযোগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। 

এ প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড পলিটিকসের অধ্যাপক জেভ স্যান্ডারসন বলেছেন, ‘যদি তিনি (মাস্ক) বাক্‌স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গিয়ে ঘৃণাত্মক বক্তব্য ও ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে টুইটারের এত দিনের লড়াকু নীতিকেও নিশ্চিহ্ন করে দেন, তবে তা টুইটারের জন্য একটি খারাপ দিক হতে চলেছে।’ 

বাক্‌স্বাধীনতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে কী কী বাধার সম্মুখীন হতে পারেন ইলন মাস্ক, তার একটি প্রামাণ্য উদাহরণ হতে পারে চীনের আলীবাবার জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট কিনে নেওয়ার ঘটনা। চীনা কর্তৃপক্ষ হংকং আন্দোলনের বিষয়টি কোনোভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে বিশ্বের সামনে হাজির করতে দেয়নি। এই ঘটনার সূত্র ধরে বিশ্লেষকদের ধারণা—আলীবাবা যেমন প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল, তেমনি গোপন ঝুঁকিতে পড়তে হতে পারে ইলন মাস্ককেও। 

যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, টুইটারকে চলতে হবে দেশটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম-সংক্রান্ত নিয়মকানুন মেনেই। একই রকম হুমকি দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও। ইউরোপিয়ান কমিশনার ফর ইন্টারনেট মার্কেট থিয়েরি ব্রেটন টুইটারকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন। কেবল তা-ই নয়, মাস্কের টুইটার কিনে নেওয়ার বিষয়টি চীনের নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।  

ফলে কেবল বিশ্বজুড়ে প্রতিকূল রাজনৈতিক আবহাওয়াই নয়, মাস্ককে বাক্‌স্বাধীনতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে গেলে মোকাবিলা করতে হবে আরও কিছু বিষয়। তবে তার মধ্যে একটির সমাধান মাস্ক নিজেই দিয়ে রেখেছেন—অ্যালগরিদম উন্মুক্ত রাখার ঘোষণা দিয়ে। তবে এর বাইরে আরও একটি বিষয় বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তা হলো—মাস্কের বাক্‌স্বাধীনতা নিশ্চিতের ঘোষণার বিষয়টি বিজ্ঞাপনদাতাদের বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে। থিংক ট্যাংক হারগ্রিভস ল্যান্সডাউনের বিশ্লেষক সুসানাহ স্ট্রিটার বলেন, মাস্কের বিতর্কিত বাক্‌স্বাধীনতা-বিষয়ক বক্তব্য দেওয়ার পর টুইটারের জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানের আয় বৃদ্ধির বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। 

রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও টুইটারে বাক্‌স্বাধীনতা নিশ্চিতের বিষয়টি নিয়ে ইলন মাস্ক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে এগোতে চাইতে পারেন। তার জন্য অবশ্যই মাস্ককে স্পষ্ট করতে হবে যে, তিনি টুইটারে বাক্‌স্বাধীনতা নিশ্চিত বলতে কতটুকু সীমা নির্ধারণ করবেন এবং টুইটার থেকে তিনি আসলে কী অর্জন করতে চান। তাঁর সেই বক্তব্য না পাওয়া অবধি অপেক্ষাই ভরসা।  

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, দ্য ভার্জ, বিবিসি ও রয়টার্স

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত