Ajker Patrika

ককন কুদি নদী আইসে, কওয়া যায় না...

গোলাম কবির বিলু, পীরগঞ্জ (রংপুর) 
আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২১, ১৮: ১৪
ককন কুদি নদী আইসে, কওয়া যায় না...

‘ককন কুদি (কোন দিকে) নদী আইসে, কওয়া যায় না। কারণ তিস্তা হৈল্ পাগলা নদী। যিদিক-সিদিক যায়। পানি হইলে ঘর ভাংগে। বাড়িঘর সারে (সরিয়ে) নি যাই। এ পর্যন্ত পেরায় (প্রায়) একশবার বাড়িঘর সারাচি।’ 

সব হারিয়ে তিস্তার বাঁধে আশ্রয় নেওয়া মুনছুর আলীর ষাটোর্ধ্ব স্ত্রী জোহরা বেগম জীবনের অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত সার এটিই! রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের মহিপুর সেতুর বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে জোহরার পরিবার।

ওই ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা নদী। নদীটির গর্ভে জোহরাদের মতো হাজারো মানুষের স্বপ্ন, বসতভিটা, জমি-জিরাত চলে গেছে। গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। তারপরও তাঁরা নদীর পাড় ছাড়েন না। কারণ, যদি তাঁদের জীবদ্দশায় ভেঙে যাওয়া জমিতে ফের চর জাগে, সে আশায় বছরের পর বছর ধরে নদীভাঙনের সঙ্গে লড়াই বসবাস করছেন। তাঁরা বোঝেন না নদী সিকস্তি বা নদী পয়স্তি আইন। তাঁরা শুধু আশায় থাকেন- কখন নদীতে স্বপ্নের মতো জেগে উঠবে বাপ-দাদার জমি। 

তিস্তার ভাঙনে সব হারানো জাহিদুলের একমাত্র ভরসা এই ফুচকার দোকানজোহরা বেগমের দুই ছেলে-মেয়ে। ছেলে জাহিদুল ইসলাম (৪৫) এবং মেয়ে মঞ্জিলা বেগম। তাঁদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলের সংসারে থাকেন বাবা মুনছুর আলী ও মা জোহরা বেগম। মুনছুর আলী লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের জয়রাম মাজার গ্রামের বাসিন্দা। জয়রাম মাজার গ্রামের বাড়িটি অনেক আগেই তিস্তার পেটে গেছে। সঙ্গে সাড়ে ৩ দোন জমিও গেছে। ৩০ শতকে এক দোন। এ হিসেবে ১০৫ শতাংশ জমি গিলে ফেলেছে তিস্তা। এখন তাঁরা ভূমিহীন। 

মুনছুর আলী বয়োবৃদ্ধ, কর্মক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে গেছে। জয়রাম মাজারের বাড়ি ভেঙে গেলে পার্শ্ববর্তী বিজয় বাঁধ গ্রাম, শংকরদহ, মহিপুরসহ কয়েকটি স্থানে ঘর-বসতি করেন মুনছুর। কিন্তু তিস্তা কোনোখানেই তাঁকে নিস্তার দেয়নি। এভাবে এক জীবনে প্রায় একশবার বাড়ি সরিয়ে নিয়েছেন বলে জানান জোহরা ও তাঁর ছেলে জাহিদুল ইসলাম। 

 ১৩ বছর আগে বিয়ে করেছেন জাহিদুল। স্ত্রী সুমি বেগম। তাঁদের সংসারে ৩ ছেলে ১ মেয়ে। বড় ছেলে সোহাগ মিয়া তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তার ছোট সিয়াম হোসেন প্রথম শ্রেণিতে। আর ৫ বছরের জেমি খাতুন এবং ছোট ছেলে সামিউল ইসলামের তিন বছর বয়স। 

জাহিদুল বলেন, ‘এখন হামরা ভূমিহীন। মহিপুর শেখ হাসিনা সেতুর পূর্বে বাঁধের পাশে অন্যের জমিতে বসবাস করতিছি। জমির মালিক ঘর সরাতে বললে খাসজমি বা অন্যের জমিতে ঘর করা নাগবি। হামার সংসারোত আট জন মানুষ খানেঅলা।’ 

জাহিদুলের স্ত্রী সুমি বেগম বলেন, ‘একসময় আমার শ্বশুরের বাড়িঘর, জমি-জাগা সগি আছিল। এখন হামরা পতের ফকির। অন্যের জমিত থাকি।’ জাহিদুল বলেন, ‘প্রতিদিন মহিপুরের সেতু দেকতে মানুষ আইসে। আর মুই এ্যাকনা দোকান দিয়া ফুচক্যা ব্যাচো। সাত আটশ ট্যাকা ব্যাচা হয়। যে লাব হয়, সেইটা দি সংসার চলাও। এ ছাড়া নদীর পাড়োত আয়ের পথ নাই! একন বালুর চর। বাইশ্যার (বর্ষা) সোমায় পানিতে ভরপুর।’ 

বারবার তিস্তার আঘাতে ক্লান্ত হতাশ জাহিদুলের মা জোহরা তবু তিস্তাপাড় ছাড়তে নারাজ। তাঁর কণ্ঠে ঝরে অসহায়ত্বের সুর। বলেন, ‘নদীর বাতা (ধার) ছাড়ি যাই ক্যাংকরি। যদি ট্যাকা থাকিল হায়, তাহলি কি এটি থাকি! কোনোমতে কষ্ট-মষ্ট করি এ্যাটে কোনা দিন কাটাই হামরা। তিস্তার মহিপুর সেতুর বাঁধের পাশোত এ্যাকন হামরা মানষের জমিত ঘর করি আছি। জমিঅলা যদি কয় তোরা জমি ছাড়ো, তাহলে হামার মরণ। যাওয়ার জাগা শ্যাষ। সরকার হামাক এ্যাকনা ঘর বানে দিলে বাকি জেবনটা থাকনো হয়।’ 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

বগুড়ায় ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, পাঁচ নেতা-কর্মীকে শোকজ

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত