Ajker Patrika

ভাইরাস ছড়িয়েছে গ্রামে থাকা মশার প্রজাতিতেও

  • আক্রান্তের ৭৭ শতাংশই রাজধানীর বাইরে।
  • ২০২৩ সাল থেকে ঢাকার বাইরে রোগী বেশি।
  • গ্রামে মিলছে শহরের ডেঙ্গুবাহী প্রজাতির মশাও।
  • অভিযোজন সক্ষমতা বাড়ছে মশার।
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
ভাইরাস ছড়িয়েছে গ্রামে থাকা মশার প্রজাতিতেও

দেশে ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে। বিশেষ করে রাজধানীর বাইরে। চলতি বছর দেশে সবচেয়ে বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা বরগুনায়। গ্রামাঞ্চলে সাধারণভাবে বাস করা অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মশাও ডেঙ্গু ভাইরাসবাহী হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে সেখানে বিস্তার ঘটেছে শহর থেকে যাওয়া এডিস ইজিপ্টাই মশার। এতে গ্রামে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি বেড়েছে। ডেঙ্গুবাহী মশার অভিযোজন সক্ষমতাও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কীটতত্ত্ববিদদের তথ্য অনুযায়ী, শহরাঞ্চলে এডিস ইজিপ্টাই প্রজাতির মশা বেশি থাকে। নগরের বাসিন্দারা ভাইরাসবাহী এই মশার মাধ্যমেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। আর গ্রামাঞ্চলে থাকে অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মশা। বন ও ঝোপঝাড়ের মতো প্রাকৃতিক উৎসে এদের আবাস। এই দুই প্রজাতির মশার ডিম পাড়া তথা বংশ বিস্তারের স্থান আলাদা। কিন্তু গ্রামের মশাগুলোও ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এটি ছড়িয়ে দিচ্ছে। গ্রামের মানুষের শহরে যাতায়াত এবং শহরের বিস্তারের কারণে গ্রামেও ইজিপ্টাই মশা দেখা যাচ্ছে। উভয় ধরনের মশার উপস্থিতির কারণে গ্রামাঞ্চলে এখন ডেঙ্গু রোগী বেশি।

চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা দেশে ৬ হাজার ৪৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এদের মধ্যে মারা গেছে ৩০ জন। চলতি বছরে ডেঙ্গু রোগীদের ২৩ শতাংশ রাজধানী ঢাকায় চিকিৎসা নিয়েছে। আর বাকি ৭৭ শতাংশই রাজধানীর বাইরে। এককভাবে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছে বরিশাল বিভাগে। দক্ষিণাঞ্চলের এই বিভাগে এ পর্যন্ত রোগী ২ হাজার ৯৮০ জন। এর মধ্যে বরগুনায় ১ হাজার ৮৩২ ও বরিশাল জেলায় ৫৭৫ জন। রাজধানীতে ১৭ জন আর রাজধানীর বাইরে ১৩ জন মারা গেছে। শুধু বরিশাল বিভাগেই ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘রোগের প্রাদুর্ভাব এখানে কেন বেশি তার সুনির্দিষ্ট কারণ আইইডিসিআর বলতে পারবে। আমাদের মনে হচ্ছে, জলবায়ুর পরিবর্তন একটা কারণ হতে পারে। এখানকার আর্দ্রতা, তাপমাত্রা মশার জন্য উপযোগী। লবণাক্ত পানিতেও মশা অভিযোজন করে নিচ্ছে। এ ছাড়া লোকজনের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। বরগুনা ডায়রিয়াপ্রবণ এলাকা। মানুষ প্রচুর ডাবের পানি খায় এবং খোসাগুলো বাড়ির আঙিনায় ফেলে রাখে। হাসপাতালের ডেঙ্গু রোগীরাও মশারি ব্যবহার করতে চায় না। ফলে তাদের মাধ্যমেও রোগটি ছড়াতে পারে।’

সিভিল সার্জন কয়েক মাস ধরে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি না থাকায় মশকনিধন কার্যক্রম ভালোভাবে না চলার কথাও বলেন। তিনি বলেন, বরগুনার পয়োনালা ব্যবস্থা (ড্রেনেজ সিস্টেম) অপরিকল্পিত। মশা নির্মূলে ওষুধ ছিটালেও কিছু সময় পরে পরিস্থিতি আগের মতোই হয়ে যায়।’

সরকারের তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, ২০১৯ সালে প্রথম রাজধানীর বাইরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগী দেখা যায়। রাজধানীর বাইরেই বেশি রোগী দেখা যায় ২০২৩ সালে। ২০১৯ সালে মোট রোগীর ৪৯ শতাংশ ছিল রাজধানীর বাইরে। এর পর থেকে ২০২১ সালে ১৭ শতাংশ, ২০২২ সালে ৩৭ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৬৬ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে ৬০ শতাংশ রোগী রাজধানীর বাইরে পাওয়া যায়।

সরকারের ডেঙ্গুবিষয়ক পরিসংখ্যান মূলত নির্ধারিত কিছু সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি। এর বাইরে সারা দেশে বহু হাসপাতালে রোগী থাকলেও তাদের তথ্য নেওয়া হয় না। অনেকে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে থাকছে, কেউ কেউ মারাও যাচ্ছে, সে বিষয়টি পর্যবেক্ষণের বাইরে থাকছে।

রাজধানীর বাইরে ডেঙ্গুর বিস্তার সম্পর্কে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার আজকের পত্রিকাকে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এডিস ইজিপ্টাই ও অ্যালবোপিকটাস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। ইজিপ্টাই শহর এবং অ্যালবোপিকটাস গ্রামাঞ্চলের মশা। অ্যালবোপিকটাস মশা বন-জঙ্গল, বাঁশের ঝাড়, গাছের বাকলের মতো স্থানে থাকে। এ মশা আগে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত ছিল না। এখন তারাও ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করছে। আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীকে কামড় দিয়ে তারাও ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে নগরে ডেঙ্গু ছড়ানো ইজিপ্টাই মশা যেকোনোভাবে গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করেছে। এখন দুই প্রজাতি মশাই সমান তালে ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করছে। এ ছাড়া বিরূপ পরিবেশেও টিকে থাকার (অভিযোজন) সক্ষমতা তৈরি করছে এসব মশা।’

ড. গোলাম ছারোয়ারের মতে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সঠিক ‘কন্ট্রাক ট্রেসিং’ (রোগী ও তার অবস্থান শনাক্ত করে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা) অতি জরুরি। কিন্তু এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে মশা নির্মূলের উদ্যোগ নেই। সে কারণে অন্য কোনো অঞ্চল থেকে আক্রান্ত হয়ে এলেও রোগী যেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাচ্ছে, সে জায়গা তালিকায় থাকছে। এতে আক্রান্ত মশাকে আড়াল করে তাদের বংশ বিস্তারের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ এবং সংক্রমণ কমাতে করণীয় সম্পর্কে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘চিকিৎসার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। আর হাসপাতালে ভর্তির বাইরেও প্রচুর রোগী রয়েছেন, যাঁদের শনাক্ত করা হচ্ছে না। সঠিক রেকর্ড রাখতে হবে। প্রতিরোধ কার্যক্রমের ঘাটতি এ রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. হালিমুর রশিদ বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি নেই। প্রতিরোধের কাজটি স্থানীয় সরকার বিভাগের। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে।’

স্থানীয় সরকার বিভাগকে অনুরোধ

এদিকে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে অনুরোধ করেছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। গত রোববার পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, সকল সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকা, বিশেষ করে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, বরিশাল, বরগুনাসহ যেসব এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে সেখানে মশক নিধন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম এবং জলাবদ্ধতা নিরসন অতি জরুরি। চিঠিতে তৃণমূল পর্যায়ের স্বাস্থ্য কমিটিগুলোর মাধ্যমে জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণেরও অনুরোধ জানানো হয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মেয়াদের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় চালুর পরিকল্পনা সরকারের

নারীর সঙ্গে এনসিপি নেতা তুষারের কথোপকথন ফাঁস নিয়ে যা বললেন সহযোদ্ধা ইমি

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা সম্ভব নয়, স্বীকার করল ইসরায়েল

ঐকমত্য কমিশনের মঙ্গলবারের সংলাপ ‘বয়কট’ করল জামায়াত

চোখের সামনে খামেনির অন্তরঙ্গ মহল ফাঁকা করে দিচ্ছে ইসরায়েল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত