Ajker Patrika

ঐক্যে ফাটল ধরায় নৈরাজ্য

  • গত কয়েক দিনে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ।
  • ঢাকা, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জসহ কয়েকটি স্থানে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ।
  • নির্বাচন সামনে রেখে বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।
রেজা করিম ও তানিম আহমেদ, ঢাকা 
আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০২৫, ০২: ৪১
গত ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ছবি: সংগৃহীত
গত ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। ছবি: সংগৃহীত

জুলাই আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তাতে এখন ফাটল ধরেছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট প্রশ্নে বিপরীত মেরুতে চলে গেছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেছে সমমনা দলগুলোও। এমন বিভক্তির সুযোগ নিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জুলাইয়ের পরাজিত শক্তি। দেশের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছে নৈরাজ্য। যানবাহনে একের পর এক আগুন দেওয়া হচ্ছে। ধর্মীয় উপাসনালয়, রাজনৈতিক দলের কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো লক্ষ্য করে ছোড়া হচ্ছে ককটেল।

সরকারঘোষিত সময় অনুযায়ী, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাজনৈতিক দলগুলো এখন নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। পাশাপাশি জুলাই জাতীয় সনদ ও গণভোট নিয়ে নিজেদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মাঠে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা আট দল। এমন একসময়ে রাজধানীসহ দেশজুড়ে নৈরাজ্য ও অস্থিরতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, নানা কারণে সে ঐক্যে ফাটল ধরেছে। জুলাই জাতীয় সনদ ও গণভোট প্রশ্নে মতভিন্নতায় দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েনের সুযোগ নিচ্ছে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীরা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে পারছে না। দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ায় তাদের মধ্যে বিভাজনটা সৃষ্টি হয়েছে এবং মতভেদ বেড়েছে। সময়ের সঙ্গে যা সংকটে পরিণত হয়েছে। এর দায় তাদের নিতে হবে।

আগামীকাল ১৩ নভেম্বর শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা করবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এদিনকে ঘিরে ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। দলটির বিদেশে অবস্থানকারী নেতারা একের পর এক হুমকি দিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছেন। গত কয়েক দিনে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ঢাকা, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহসহ কয়েকটি স্থানে যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গতকালও রাজধানীর সূত্রাপুরে একটি বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

গত সপ্তাহে চট্টগ্রামে নির্বাচনী গণসংযোগকালে গুলিবিদ্ধ হন বিএনপির মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ। একই সময়ে সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান চট্টগ্রামের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলা। গত সোমবার দিনদুপুরে রাজধানীতে গুলি করে মারা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। এ দুই ঘটনা দীর্ঘদিন পর আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। এ অবস্থায় জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামীতে আরও বড় ধরনের নাশকতার আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এসব ঘটনায় চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে জনমনে, প্রশাসনে দেখা দিয়েছে গভীর উদ্বেগ।

এমন অবস্থার জন্য দলগুলোর ব্যর্থতার পাশাপাশি সরকারের ভূমিকাকেও দায়ী করেছেন অনেক বিশ্লেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগের চেয়ারম্যান শারমীন আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন শক্তি এখানে কাজ করছে। যারা নির্বাচনকে সঠিক সময়ে হতে দিতে চায় না বা সুষ্ঠু নির্বাচনে যাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনায় অসুবিধা হতে পারে, তাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারগুলো আছে।

বিরাজমান পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনের কারণ নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছে না দেশের প্রধান দুই দল বিএনপি ও জামায়াত। দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। গতকাল মঙ্গলবার গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটার সঙ্গে বর্তমানে সৃষ্ট যে অসন্তোষ বা অশান্তি, তার কোনো সম্পর্ক নেই বলে আমরা মনে করি।’ তিনি বলেন, ‘এখানে নির্বাচনকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারছে না, নানাভাবে দেশে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে, তারাই এ বিশৃঙ্খলা করছে।’

চলমান নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য অবশ্য সরাসরি সরকারের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছে জামায়াতে ইসলামী। জানতে চাইলে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘এটা তো রাজনৈতিক দল বা নেতাদের ব্যর্থতা নয়। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের, তাদের এত বাহিনী কী করে, গোয়েন্দা বাহিনী কী করে? তাদের কাজ তো এগুলো দমন করা। এ ব্যর্থতা হলো সরকারের, সরকারের প্রশাসনের।’

বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকার ও রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতাকে সমানভাবে দায়ী করছে জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি)। বিভিন্ন ইস্যুতে দলগুলোর অনৈক্যে ফ্যাসিবাদী শক্তিকে দেশে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ করে দিচ্ছে বলে মনে করেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন। একই সঙ্গে সরকারের ভূমিকাকেও দায়ী করে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণ ও আগুন জ্বালিয়ে ফ্যাসিবাদী শক্তি পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছে এবং জনমনে ভীতি ছড়াচ্ছে। সরকার ও প্রশাসন নির্বিকার বলেই এসব ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও ব্যর্থতা রয়েছে। এ ছাড়া আমরা দেখেছি, বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া অনেক অপরাধীই জামিন পেয়ে গেছে। তারা কারাগার থেকে বের হয়ে এখন দেশকে অস্থিতিশীল এবং পুরোনো বন্দোবস্তে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।’

রাজধানীতে বাসে আগুন, ককটেল বিস্ফোরণের বিষয়ে গতকাল সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, এখানে গোয়েন্দাদের কোনো ব্যর্থতা নেই। এগুলো যেন আর না হয়, সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এগুলো যারা করছে তারা দুষ্কৃতকারী। এসব দুষ্কৃতকারীকে প্রতিহত করা শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ নয়, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’

বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চ। গতকাল মঞ্চের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি ও গণভোটের সময় প্রশ্নে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থান এবং সরকারের দায়সারা আচরণের ফলে যে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ সুযোগে পরাজিত মাফিয়া গোষ্ঠী অস্থিরতা বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন হুমকির মুখে পড়েছে। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘সি’ গ্রেডের গভর্নর খেতাব পেলেন ড. আহসান মনসুর

বাসে আগুন দেওয়ার সময় ‘বিশেষ জেলার’ একজন গ্রেপ্তার: ডিএমপি কমিশনার

গুলশান থেকে উদ্ধার রক্তাক্ত লাশটি পটুয়াখালীর ছাত্রদল নেতার

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারির সুযোগ নেই, প্রজ্ঞাপন হতে পারে: সালাহউদ্দিন

সংবিধান মতেই সব হলে নির্বাচন হবে ২০২৯ সালে: হামিদুর রহমান আযাদ

এলাকার খবর
Loading...