Ajker Patrika

বিনা মূল্যের পাঠ্যবই: নিম্নমানের ১৫ লাখ বইয়ে চলছে পড়া

  • নিম্নমানের পাঠ্যবই ছাপানোর জন্য অভিযুক্ত ২৯ মুদ্রণপ্রতিষ্ঠান।
  • বইয়ের মান যাচাইয়ের প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে এনসিটিবিতে।
  • মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তাদের উল্টো অভিযোগ যাচাই নিয়ে।
রাহুল শর্মা, ঢাকা
আপডেট : ২৫ জুন ২০২৫, ০৯: ১৪
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

চলতি শিক্ষাবর্ষে দরপত্রের শর্ত পূরণ না করে ১৫ লাখের বেশি নিম্নমানের পাঠ্যবই ছাপানো হয়েছে। বিনা মূল্যের এসব বই শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণও হয়েছে। নিম্নমানের এসব বই ছাপানোর সঙ্গে জড়িত ২৯টি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান।

বিনা মূল্যের ছাপানো পাঠ্যবইয়ের মান যাচাইয়ের জন্য নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান হাই-টেক সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন সার্ভিস বিডির প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়। সারা দেশের মাঠপর্যায় থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাব টেস্টের পর এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি ১৮ জুন বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপানো ও বিতরণকারী সংস্থা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) জমা দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ১৫ লাখ বইয়ে নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করা হয়েছে। কাগজের পুরুত্ব, আকার ও মুদ্রণের মানও ঠিক নেই; যা দরপত্রের শর্তের লঙ্ঘন। দরপত্রের শর্তে ৮০ জিএসএমের কাগজে বই ছাপাতে বলা থাকলেও এসব বই ছাপানো হয়েছে ৫৬ থেকে ৭৫ জিএসএমের কাগজে। বেশ কিছু বইয়ে মুদ্রণ, বাঁধাই, কাটিংও নিম্নমানের।

তবে অভিযোগ ওঠা মুদ্রণকারী কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অভিযোগ, যাচাইয়ে প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি। এনসিটিবি বলছে, অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী বই ছাপিয়ে বিতরণের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। না হলে তাদের জামানতের ২০ শতাংশ অর্থ কেটে রাখা হবে।

চলতি শিক্ষাবর্ষে সারা দেশের চার কোটির মতো শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সাড়ে ৩৯ কোটির বেশি বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপানো ও বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে মাধ্যমিকে (মাদ্রাসার ইবতেদায়িসহ) মোট বইয়ের সংখ্যা ৩০ কোটি ৪০ লাখ ৪১ হাজার ৬৯২টি। প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজারের মতো। দরপত্রের মাধ্যমে এসব বইয়ের কাজ পায় ১১৬টি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান। পাঠ্যবই ছাপানো ও বিতরণে ব্যয় হয় ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

পাঠ্যবইয়ের মান নিয়ে হাই-টেক সার্ভে অ্যান্ড ইন্সপেকশন সার্ভিসের প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, চলতি শিক্ষাবর্ষে নিম্নমানের বই ছাপানোর কারণে ২৯টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিয়েছে ইন্সপেকশন প্রতিষ্ঠান। এখন বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অবশ্য মান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। তাঁরাও বলছেন, যাচাইয়ে প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি। কারণ, যেসব প্রতিষ্ঠান বেশি পরিমাণ বই ছাপানোর কাজ পেয়েছে বা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তাদের কারও নাম এই তালিকায় নেই।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২৯টি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান চলতি শিক্ষাবর্ষে মোট ১৫ লাখ ৬ হাজার ৯৪টি নিম্নমানের বই ছেপেছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিম্নমানের পাঠ্যবই ছেপেছে অ্যারিস্ট্রোক্রেট সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠান ২ লাখ ৪০ হাজার ৬৪২টি বই নিম্নমানের কাগজে ছেপেছে। পাঞ্জেরি প্রিন্টার্স ১ লাখ ৯৯ হাজার ৮৫১টি, লেটার অ্যান্ড কালার ১ লাখ ১৭ হাজার ৯৩৪টি, মাস্টার সিমেক্স পেপার লি. ৯৫ হাজার ১৬৯টি এবং নাহার প্রিন্টার্স ৮৯ হাজার ৪০০টি বই নিম্নমানের কাগজে ছেপেছে। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আমাজন প্রেস ৭১ হাজার বই, টাঙ্গাইল অফসেট প্রেস ৫৭ হাজার ৮২৭টি, বর্ণমালা প্রেস ৪৪ হাজার ১৫০টি, দিগন্ত অফসেট প্রিন্টার্স ৪৪ হাজার ৬২৩টি, রেদওয়ানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন ৪৫ হাজার ৪২১টি, দ্য গুডলাক প্রিন্টার্স ৩০ হাজার ৬৭৬টি, মিলন প্রিন্টিং প্রেস ৩১ হাজার ৬৬৯টি, সুবর্ণা প্রিন্টার্স ২৯ হাজার ৭৫৫টি, নাইমা আর্ট প্রিন্টার্স ৩৫ হাজার পাঠ্যবই নিম্নমানের কাগজে ছেপেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো ৩০০ থেকে ২০ হাজারটি করে নিম্নমানের বই ছেপেছে। সেগুলো হলো আনন্দ প্রিন্টার্স লি., অক্সফোর্ড প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন, শাফিন প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন, আমিন আর্ট প্রেস, সরকার প্রেস, অনুপম প্রিন্টার্স লি., মেসার্স ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, দোয়েল প্রিন্টার্স, পিবিএস প্রিন্টার্স, সরকার অফসেট প্রেস, ন্যাশনাল প্রিন্টার্স, ঢাকা প্রিন্টার্স, ভাই ভাই প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন, জিতু অফসেট প্রেস ও মহানগর অফসেট প্রিন্টিং প্রেস।

নিম্নমানের পাঠ্যবই ছাপানোর অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে অ্যারিস্ট্রোক্রেট সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস, পাঞ্জেরি প্রিন্টার্স, লেটার অ্যান্ড কালারসহ কয়েকটি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কেউই নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। তাদের ভাষ্য, এ বিষয়ে তারা এনসিটিবির চিঠি পায়নি। চিঠি পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের অভিযোগ, ওই প্রতিবেদনে মাঠপর্যায়ের সঠিক চিত্র আসেনি। এর বিরুদ্ধে তারা আপিল করবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী গতকাল মঙ্গলবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, যারা নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই সরবরাহ করেছে, তাদের ভালো কাগজে নতুন করে ছাপিয়ে বই রিপ্লেস করে দিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যদি তারা তা না করে, তাহলে তাদের জমা রাখা অর্থ থেকে ২০ শতাংশ কেটে নেওয়া হবে। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে আরও কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত