Ajker Patrika

গ্যাস উৎপাদনে ধস, তীব্র সংকটে শিল্প

আরিফুজ্জামান তুহিন, ঢাকা
আপডেট : ১৩ জুন ২০২৫, ১০: ০৮
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

দেশের খনি থেকে প্রাপ্ত গ্যাস এবং বিদেশ থেকে আমদানি মিলিয়ে ২০২৪ সালের ২৮ মে গ্যাসের সরবরাহ ছিল ২৬১ কোটি ২৭ লাখ ঘনফুট। সেই উৎপাদন গত ২৮ মে নেমে এসেছে ২০০ কোটি ৪৮ লাখ ঘনফুটে। তার মানে, এক বছরের ব্যবধানে দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন কমেছে ৬০ কোটি ঘনফুট।

গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ কমেছে। এই অবস্থায় লোডশেডিং কমাতে তেলভিত্তিক কেন্দ্র চালু করেছে সরকার। শিল্পে গ্যাস নেই, বাসাবাড়ির চুলাও জ্বলছে না।

সামনে সংকট আরও বাড়তে পারে। কারণ, আগের সরকারের দেওয়া তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দুটি টার্মিনাল বাতিল করে দেওয়ায় এই সরকারের হাতে দ্রুত গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর কোনো পথ নেই। দেশের দুটি এলএনজি টার্মিনাল দিয়ে সর্বোচ্চ ১১০ কোটি ঘনফুট আমদানি করা সম্ভব, এখন সর্বোচ্চ আমদানিই করা হচ্ছে। হাতে এলএনজি কেনার ডলার থাকলেও গ্যাসের আমদানি আর বাড়ানো যাবে না। দেশীয় গ্যাসের মজুত আরও কমলে শিল্পকারখানা সব ডুবতে বসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং পেট্রোবাংলা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

দেশের সব থেকে বড় গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন পিএলসি। তিতাস গ্যাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা শিল্পে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে চেষ্টা করছি। তিতাসে যতখানি গ্যাস দেওয়া হচ্ছে, তার সর্বোত্তম ব্যবহারের চেষ্টা করা হচ্ছে। উৎসে গ্যাস সরবরাহ বাড়লে আমরা আরও ভালো সেবা দিতে পারব।’

কমছে উৎপাদন

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ মে ২৪০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করেছে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজি ৫৯ কোটি ঘনফুট। গত বছর ঠিক এই দিনে (৩০ মে) গ্যাসের সরবরাহ ছিল ২৭৩ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে আমদানি করা এলএনজির পরিমাণ ৭৭ কোটি ঘনফুট। ৩১ মে ২০২৪ সালে গ্যাস সরবরাহ করা হয় ২৬১ কোটি ৭০ লাখ ঘনফুট; এর মধ্যে আমদানি করা এলএনজি ছিল ৬০ কোটি ঘনফুট। ঠিক এক বছর পরে এসে গত ৩১ মে গ্যাসের সরবরাহ ছিল ২৪৬ কোটি ৬৫ লাখ ঘনফুট। এর মধ্যে আমদানি করা এলএনজির পরিমাণ ৬১ কোটি ৭০ লাখ ঘনফুট।

কমেছে শিল্পে গ্যাস

গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন শিল্পমালিকেরা। চলছে না কলকারখানা। গত বছরের ৩০ মে শিল্পকারখানায় নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্রে; যা ক্যাপটিভ পাওয়ার নামে পরিচিত, সেখানে গ্যাস সরবরাহ ছিল ১০ কোটি ১১ লাখ ঘনফুট। আর গত ৩০ মে ক্যাপটিভ পাওয়ারে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে ৮ কোটি ৩৭ লাখ ঘনফুট। শিল্পকারখানার নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র, যা জেনারেটরের মাধ্যমে উৎপাদিত হয়, সেখানে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় অনেক কারখানা উৎপাদন কমিয়ে এনেছে।

গত ২৫ মে রাজধানীতে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ ৯টি সংগঠনের শীর্ষ নেতারা যৌথ সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, গ্যাসের কারণে বন্ধ রয়েছে বস্ত্র খাতের ৫০ শতাংশ কারখানা।

সংবাদ সম্মেলন থেকে শিল্পমালিকেরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শিল্পে গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি করেন। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত স্থগিত, শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহে মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের আহ্বান জানান তাঁরা।

বাসাবাড়িতেও গ্যাস-সংকট

রাজধানীর পান্থপথের বউবাজারের বাসিন্দা মান্নান মোল্লা আজকের পত্রিকাকে বলেন, দিনের বেলা গ্যাসের চাপ না থাকায় বাসায় রান্না করা যায় না। রাতে গ্যাসের চাপ যখন বাড়ে, তখন রান্না করতে গেলে রাত অনেক বেশি হয়। এই সমস্যা কয়েক মাস ধরেই চলছে।

একই রকম পরিস্থিতিতে পড়েছেন রাজধানীর বনশ্রী এলাকার ব্লক-এর ১৬ তলা ভবনের বদরুল ইসলামের পরিবার। এই ব্যবসায়ীর বাড়িতে চুলা জ্বলে দিনে একবার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাড্ডা, রামপুরা, বনশ্রী, যাত্রাবাড়ী, কলাবাগান, মিরপুরের কোথাও কোথাও চুলা জ্বালানোর মতো গ্যাসের চাপ থাকে না। এতে এসব এলাকার বাসিন্দারা সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছেন।

সংকটের সমাধান কোথায়

২০১৮ সাল থেকে দেশীয় গ্যাসের জোগান কমতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার তার আগেই দুটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ শুরু করেছিল। এর একটি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সিলারেটের। অন্যটি দেশীয় কোম্পানি সামিটের। এ দুটি টার্মিনাল দিয়ে দিনে ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবাহ করা যায়। পেট্রোবাংলার হাতে তথ্য ছিল, ২০২৬ সালে গিয়ে দেশীয় গ্যাসের জোগান আরও কমবে। এটি উল্লেখযোগ্য হারে কমতে থাকবে ২০২৫ সাল থেকে। এ জন্য আরও দুটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল সরকার। অবশ্য আগের দুটি ও পরের দুটি টার্মিনাল বিনা দরপত্রে বিশেষ আইনে দেওয়া হয়েছিল। এখানে সামিটকে বিশেষ সুযোগ দেওয়ার অভিযোগ পুরোনো। পরের দুটিও এক্সিলারেট ও সামিট পেয়েছিল। গত ৫ আগস্ট সরকার গঠনের পর সরকার নতুন দুটি এলএনজি টার্মিনালই বাতিল করে দেয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেট্রোবাংলার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানী লিমিটেড (আরপিজিসিএল) এলএনজি আমদানি করে। এই প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করা যেত। সাগরে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বিদেশ থেকে জাহাজ কিনে বা দীর্ঘ মেয়াদে ভাড়ায় এনে স্থাপন করা হয়।

উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট ১৬ বছরের পুরোনো জাহাজ দিয়ে বাংলাদেশে এলএনজি সরবারহ শুরু করেছে। আর সামিটের এলএনজি টার্মিনালের সব কারিগরি সরবরাহ, লোকবল এমনকি জাহাজ ভাড়াও এক্সিলারেট দিয়েছে; এ ক্ষেত্রে শুধু অনুমতিপত্রটাই সামিটের। সরকারি কোম্পানি আরপিজিসিএলের ক্ষেত্রেও এমনটি করা যেত বলে তাঁরা মনে করছেন।

তবে দেশীয় গ্যাস উত্তোলনের বিকল্প দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। কারণ, দীর্ঘ মেয়াদে এলএনজি আমদানি করার মতো আর্থিক সক্ষমতা নেই বাংলাদেশের। দীর্ঘ মেয়াদে বড় আকারে এলএনজি আমদানি করলে তার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও পড়বে বলে মনে করেন তাঁরা।

এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিগত সরকারের মধ্যে দুটি পক্ষ ছিল। একটি ছিল এলএনজি আমদানি করার পক্ষে, অন্যটি দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পক্ষে। আর এ সরকারের আমলে কোনো পক্ষ নেই। এলএনজি আমদানিই তাদের মূলনীতি।

শামসুল আলম আরও বলেন, এই সরকার দেশের স্থলভাগের গ্যাসও বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিতে চায়। অথচ এ কাজে বাপেক্সের চেয়ে দক্ষ কেউ নেই। সরকারের উচিত ছিল বাপেক্সকে দিয়ে বড় আকারে স্থলভাগের গ্যাস উত্তোলনে ব্যবস্থা নেওয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় গ্যাস উত্তোলনে জোর দেওয়া, তারা সেটা করছে না। আগামীতে জ্বালানি সংকট ভয়াবহ হবে, এটা অনেকে ভাবতে পারছে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ইসরায়েলে হামলা অব্যাহত, পারমাণবিক স্থাপনার কাছে ড্রোন ভূপাতিত করল ইরান

দুই ঘণ্টা আগে একই বিমানে ভ্রমণের দাবি এক ব্যক্তির, জানালেন ভয়াবহ তথ্য

নির্বাচন নিয়ে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে যে কথা হলো

ইরানে ইসলামি শাসনের অবসান হতে পারে—মার্কিন কর্মকর্তাদের আশঙ্কা

আ.লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ৭ জন আহত, গ্রেপ্তার ১

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত