Ajker Patrika

দিল্লিতে বাংলাদেশের জামদানির ব্যতিক্রম প্রদর্শনী, মুগ্ধ ‘উমরাও জান’-এর পরিচালক

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭: ০৭
দিল্লিতে চলছে জামদানি শাড়ির ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী। ছবি: সংগৃহীত
দিল্লিতে চলছে জামদানি শাড়ির ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী। ছবি: সংগৃহীত

জামদানি শাড়ির নিপুণ কারিগরি এবং এর পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা গল্প যেন এক জীবন্ত শিল্পকর্ম। এটি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার কাছেও এক দারুণ অভিজ্ঞতা। ভারতের জাতীয় কারুশিল্প জাদুঘর ও হস্তকলা একাডেমিতে আয়োজিত ‘সেলিব্রিটিং জামদানি: অ্যা লিভিং হেরিটেজ ফ্রম বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রদর্শনীতে এসে এমনটাই জানালেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মুজাফফর আলি। তাঁর পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘উমরাও জান’–এ নায়িকা রেখাকে তিনি একটি বাংলাদেশি জামদানি শাড়িতে সাজিয়েছিলেন। শনিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত এই প্রদর্শনীতে মুজাফফর আলি সেই মুগ্ধতার স্মৃতিচারণ করেন। আয়োজন করেছে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন।

প্রদর্শনী কক্ষে শিল্প সমালোচক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং অসংখ্য শাড়িপ্রেমী ভিড় জমিয়েছিলেন। তাঁরা প্রতিটি জামদানি শাড়ির অনন্য নকশা ও বুননের বৈচিত্র্য দেখে মুগ্ধ হন। জামদানি শুধু একটি পোশাক নয়, এটি হাজার বছরের একটি ঐতিহ্য, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাহিত হয়ে আসছে।

দিল্লিতে চলছে জামদানি শাড়ির ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী। ছবি: সংগৃহীত
দিল্লিতে চলছে জামদানি শাড়ির ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী। ছবি: সংগৃহীত

প্রদর্শনীতে সরাসরি জামদানি বুনন প্রক্রিয়া দেখানো হয়, যা দর্শনার্থীদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। দিল্লির বাসিন্দা এক জাপানি নারী সাকুরা (৩৯)। তিনি এই অভিজ্ঞতা দেখে উচ্ছ্বসিত। তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে গিয়েছি এবং সেখান থেকে শাড়িও কিনেছি। কিন্তু জীবনে এই প্রথম দেখলাম কীভাবে হাতে জামদানি বোনা হয়! এটি অবিশ্বাস্য!’

নারায়ণগঞ্জের ৪১ বছর বয়সী তাঁতি মোহাম্মাদ জামাল হোসেন বলেন, ‘কেউ জামদানি শাড়ি নকল করতে পারে না, কারণ এটি মেশিনে তৈরি নয়, সম্পূর্ণ হাতে বোনা। দুজন তাঁতি মিলে একটি শাড়ি বোনার সময় একজন আরেকজনকে গল্প শোনান এবং সেই গল্পের ছন্দ অনুযায়ী শাড়ির নকশা তৈরি হয়।’

উমরাও জান চলচ্চিত্রে জামদানি শাড়িতে রেখা। ছবি: সংগৃহীত
উমরাও জান চলচ্চিত্রে জামদানি শাড়িতে রেখা। ছবি: সংগৃহীত

তিনি জানান, একটি জটিল নকশার শাড়ি বুনতে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তিনি দাবি করেন, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরের বাতাসে বিশেষ মাত্রার জলীয় বাষ্পের কারণে এখানকার সুতাগুলো নিখুঁত হয়। তাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁওয়ের আশপাশে বোনা জামদানিই সবচেয়ে সেরা। বর্তমানে প্রায় ২০টি গ্রামের প্রায় ১ হাজার ৫০০ তাঁতি পরিবার এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

রূপগঞ্জের তাঁতি মোহাম্মাদ সজীব জামদানি শাড়ির অর্থনৈতিক দিকটি ব্যাখ্যা করেন। তিনি জানান, নকশার জটিলতা অনুসারে একটি শাড়ি বুনতে দুই সপ্তাহ থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগে। একটি শাড়ির মূল্য ১০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা হতে পারে, যার মধ্যে উপকরণের দাম মাত্র ২ শতাংশ, বাকিটা শ্রমের মূল্য। এই তথ্য থেকে বোঝা যায়, জামদানি শুধু একটি পণ্য নয়, এটি তাঁতিদের শ্রম, ধৈর্য এবং শিল্প নৈপুণ্যের প্রতিচ্ছবি। এটি শুধুমাত্র হাতে বোনা শিল্প নয়, বরং একটি জীবন্ত ঐতিহ্য।

উমরাও জান চলচ্চিত্রের পরিচালক মুজাফ্ফর আলী। ছবি: সংগৃহীত
উমরাও জান চলচ্চিত্রের পরিচালক মুজাফ্ফর আলী। ছবি: সংগৃহীত

২০১৩ সালে ইউনেসকো জামদানি বুননকে ‘অমূল্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে। তবে যান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এর রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে এই শিল্পটি এখন হুমকির মুখে। হাতে বোনা জামদানি শাড়ির তুলনায় মেশিনে তৈরি সস্তা শাড়ির সহজলভ্যতা এই শিল্পের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করতে এই প্রদর্শনীটি আয়োজিত হয়।

দিল্লিতে চলছে জামদানি শাড়ির ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী। ছবি: সংগৃহীত
দিল্লিতে চলছে জামদানি শাড়ির ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী। ছবি: সংগৃহীত

ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের পারস্পরিক যোগসূত্র এবং ঐতিহ্যগুলোই আমাদের সম্পর্ককে সংজ্ঞায়িত করে। বাংলাদেশি জামদানি শাড়ি তেমনই একটি বন্ধন, যা নতুন করে আলোচনা শুরু করার প্রতিশ্রুতি দেয়। তাই আমরা এই প্রদর্শনীটি ভারতীয় রাজধানীতে উপস্থাপন করেছি।’ এই ধরনের সাংস্কৃতিক বিনিময় শুধু দুই দেশের মানুষের মধ্যে বন্ধনই মজবুত করে না, বরং ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলোকে টিকিয়ে রাখতেও সহায়তা করে।

তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বঙ্গভবনে সিইসি

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ৫৬
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন সিইসি। ছবি: আজকের পত্রিকা
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন সিইসি। ছবি: আজকের পত্রিকা

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনাররা বঙ্গভবনে পৌঁছেছেন।

বঙ্গভবনের একটি সূত্র আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন, আজ বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ইসির বৈঠকের শিডিউল রাখা আছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বাংলাদেশের ‘টাঙ্গাইল শাড়ি বুনন শিল্প’ অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ইউনেসকোর স্বীকৃতি

বাসস, ঢাকা  
টাঙ্গাইল শাড়িতে অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মিম। ছবি: ফেসবুক
টাঙ্গাইল শাড়িতে অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মিম। ছবি: ফেসবুক

টাঙ্গাইলের শাড়ি বুনন শিল্পকে অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেসকো। গতকাল মঙ্গলবার ভারতের নয়াদিল্লিতে ইউনেসকো কনভেনশনের চলমান ২০তম আন্তঃরাষ্ট্রীয় পর্ষদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এই কনভেনশনের আওতায় এটি বাংলাদেশের ষষ্ঠ একক নিবন্ধন। সভায় প্রথমবারের মতো সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর বিগত চার বছরে এটি দ্বিতীয় নিবন্ধন।

সভায় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের প্রধান এবং ইউনেসকো সাধারণ পরিষদের সভাপতি ও বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত খন্দকার এম. তালহা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জানান, ‘এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য অসামান্য গৌরবের বিষয়। দীর্ঘ দুই শতকের বেশি সময় ধরে টাঙ্গাইলের তাঁতিদের অনবদ্য শিল্পকর্মের বৈশ্বিক স্বীকৃতি এটি।’

তিনি আরও বলেন, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের সকল নারীর নিত্য পরিধেয়, যা এই শাড়ি বুনন শিল্পের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।’

এই অর্জনকে বাংলাদেশের সকল তাঁতি ও নারীদের প্রতি উৎসর্গ করেছেন রাষ্ট্রদূত খন্দকার এম. তালহা।

বাংলাদেশের অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সামগ্রিক সুরক্ষায় এই স্বীকৃতি নতুন মাত্রা যোগ করবে উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত তালহা বলেন, ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেসকোর স্বীকৃতি অর্জনের মতো বাংলাদেশের অপরিমেয় সাংস্কৃতিক উপাদান রয়েছে।

নথি প্রস্তুত করার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কনভেনশন সংক্রান্ত অভিজ্ঞ জনবল তৈরি করার মাধ্যমে আরও অনেক ঐতিহ্যের ইউনেসকো-স্বীকৃতি অর্জনের সুযোগ রয়েছে।

এর আগে, গত ৭ ডিসেম্বর আন্তঃরাষ্ট্রীয় পর্ষদের চলমান ২০তম সভা উদ্বোধন করেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শংকর। অনুষ্ঠানে ইউনেসকোর নবনিযুক্ত মহাপরিচালক খালেদ এল. এনানি উপস্থিত ছিলেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আজ সংবাদ সম্মেলনে আসছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ৩৪
ভারতকে হারানোর পর ২ কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।ছবি: ফাইল ছবি
ভারতকে হারানোর পর ২ কোটি টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।ছবি: ফাইল ছবি

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তোড়জোড়ের মধ্যে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আসছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

সমসাময়িক বিষয়ে আজ বুধবার বেলা ৩টায় স্থানীয় সরকার বিভাগের সম্মেলনকক্ষে আসিফ মাহমুদের সংবাদ সম্মেলন হবে বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।

সমসাময়িক কোন বিষয়ে আসিফ মাহমুদ সংবাদ সম্মেলনে কথা বলবেন, মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণপত্রে তা উল্লেখ করা হয়নি। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজকের সংবাদ সম্মেলন থেকে উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে পারেন তিনি।

আজ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করার পর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার জন্য ভাষণের রেকর্ড করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। আজ সন্ধ্যায় বা আগামীকাল বৃহস্পতিবার এই তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও আজ পদত্যাগের ঘোষণা দিতে পারেন বলে আলোচনা রয়েছে।

উপদেষ্টার পদে থেকে নির্বাচন করতে আইনি বাধা না থাকলেও তফসিল ঘোষণার আগে সরকারে থাকা দুজন ছাত্র উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলনে অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আসিফ মাহমুদ। তাঁদের আন্দোলন একপর্যায়ে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে রূপ নেয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর ওই বছরের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন আসিফ মাহমুদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব মেনেও মনবদল ইয়াহিয়ার

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০: ১৮
ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব মেনেও মনবদল ইয়াহিয়ার

মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযানে পাকিস্তানি বাহিনীর একের পর এক অবস্থানের পতনে মুক্ত হচ্ছিল বাংলাদেশের একেকটি অঞ্চল। এগিয়ে আসছিল স্বাধীনতার মুহূর্তটি। যদিও ঠিক কখন, কীভাবে সেদিনটি আসবে, তখনো তা স্পষ্ট নয় সাধারণ মানুষের কাছে। তবে সবাই অধীর আগ্রহে ক্ষণ গুনছিল।

সেতু বিধ্বস্ত হওয়ায় ১০ ডিসেম্বর রায়পুরা অঞ্চলে ১৪টি হেলিকপ্টারের সাহায্যে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর অগ্রবর্তী অংশ তখনকার বিশাল, প্রশস্ত মেঘনা পার হয়। স্থানীয় জনসাধারণ ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় শত শত নৌকার সাহায্যে অবশিষ্ট সেনা ও যুদ্ধ-সরঞ্জাম পরিবহনে সহায়তা করে।

প্রচণ্ড চাপে পড়ে আগের দিন ঢাকায় পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ও গভর্নর মালেক সৈন্যসহ পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেদিন দাউদকান্দির পতনের পর তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন, ঢাকাই যৌথ বাহিনীর পরবর্তী লক্ষ্য। পাকিস্তানিদের সম্পূর্ণ পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পূর্ণ অনুমোদন লাভ করে।

সহায়তাকারী ভারতীয় বাহিনীর রায়পুরায় অবতরণের পর প্রায় ৩ ঘণ্টা ঢাকার পাকিস্তানি সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর বিমান হামলা চলে। তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা, গণহত্যার অন্যতম সহযোগী রাও ফরমান আলী ঢাকায় অবস্থানকারী জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব পল মার্ক হেনরিকে ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির’ আয়োজন করার আবেদন জানান। বাঙালিদের ওপর ৯ মাস হত্যাযজ্ঞ চলার পর এত দিনে এসে তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা এবং এই অঞ্চলে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা সম্পন্ন করার আহ্বান জানান। জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব এ প্রস্তাব জাতিসংঘ সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দেন।

নিরাপত্তা পরিষদে রাও ফরমান আলীর এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ চলার সময় হঠাৎ খবর আসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রস্তাবটি নাকচ করে দিয়েছেন। ঘটনা হচ্ছে, খবরটি ওয়াশিংটনে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন সরকার ইয়াহিয়াকে জানান, পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য সপ্তম নৌবহর ইতিমধ্যেই বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হয়েছে। এ কারণেই ইয়াহিয়ার মত বদলে যায়। পাকিস্তান নিজে থেকে ‘সম্মানজনকভাবে’ সেনা প্রত্যাহারের জন্য উদ্যোগী হলেও সেই উদ্যোগকে সমর্থন না করে মার্কিন সরকার বরং তা রদ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তার ওপর ভারতকে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সম্মত করানোর তাগিদ দিয়ে ৯ ও ১০ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভকে দুই দফা বার্তা পাঠান। যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার ব্যাপারে ভারতকে সম্মত করতে ব্রেজনেভের ওপর চাপের মাত্রা বাড়ানো হয়। তাঁকে জানানো হয়, ভারত যদি এরপরও সম্মত না হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র নিজে এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে।

উপমহাদেশের সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ‘শক্ত ব্যবস্থা’ গ্রহণ করতে পারে, তা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভালো করেই জানা ছিল। সোভিয়েত সরকার তাদের নৌবাহিনীকে সতর্ক রাখে। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের যাত্রারম্ভের আগেই সোভিয়েতরা তাদের ভারত মহাসাগরীয় নৌবহরের শক্তি বৃদ্ধি শুরু করে।

১০ ডিসেম্বর মার্কিন সপ্তম নৌবহর চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরকে সংযোগকারী পাঁচ শ’ মাইল দীর্ঘ মালাক্কা প্রণালির ওপারে ছিল। ভারত মহাসাগরে সোভিয়েত নৌবহরের সমাবেশ তখন সম্পূর্ণ হয়নি। এই অবস্থায় জানা যায়, মার্কিন সপ্তম নৌবহরের গতিবিধি জানার জন্যই সোভিয়েত সরকার কসমস নামের নজরদারি কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে।

এদিকে চূড়ান্ত পর্বের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের আশঙ্কায় ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে থাকেন অনেক সাধারণ মানুষ। আগের দিন সরকার স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছিল। গুজব ছড়িয়ে পড়ে, রাস্তায় রাস্তায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে লড়াই হবে বলে মুক্তিযোদ্ধারা লোকজনকে শহর ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। অনেক লোককে দেখা যায়, পরিবার-পরিজন, পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে রিকশা বা বেবিট্যাক্সিতে (সিএনজি অটোর আগের সংস্করণ) করে শহর থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ লটবহর মাথায় নিয়ে হেঁটেই চলেছেন। এ যেন ২৫ মার্চের গণহত্যার পর ঢাকা ছাড়ার যে ঢল নেমেছিল কিছুটা প্রতিচ্ছবি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত