Ajker Patrika

এএফপির প্রতিবেদন /বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে পরিকল্পিত হামলার আশঙ্কায় সংখ্যালঘুরা

অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image
দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ধউরের লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির। ছবি: এএফপি

ঢাকার ঠিক বাইরে অবস্থিত একটি গ্রাম ধউর। গত ৭ ডিসেম্বর গ্রামের ৫০ বছরের পুরোনো লক্ষ্মী দেবীর মন্দিরে প্রবেশ করে প্রতিমাগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে রাজধানীর বাইরের এই ছোট মন্দিরটিতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পূজা-অর্চনা করে আসছেন হিন্দুরা। গত আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দীর্ঘদিনের কর্তৃত্ববাদী শাসক শেখ হাসিনার পতনের চলতি মাসের এই ঘটনা দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো হামলাগুলোর একটি।

গ্রামের বাসিন্দা স্বপ্না ঘোষ বলেন, ‘আমরা নিরাপদ বোধ করছি না।’ মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক রতন কুমার ঘোষ (৫৫) জানান, আক্রমণকারীরা সিসিটিভি ক্যামেরা এড়িয়ে মন্দিরের টিনের চাল কেটে ভেতরে প্রবেশ করে। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে আগুন দেখতে পেয়ে দ্রুত তা নিভিয়ে ফেলে। নইলে মন্দিরটা ছাই হয়ে যেত।’

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে হিন্দুরা প্রায় ৮ শতাংশ। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরের দিনগুলোতে হিন্দুদের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব হামলার অনেকগুলোই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে। অর্থাৎ, এসব হিন্দুদের কেউ কেউ শেখ হাসিনার শাসনকে সমর্থন করেছে বলে মনে করা হয়। পাশাপাশি ইসলামি কট্টরপন্থীরা মুসলিম সুফি মাজারগুলোর ওপরও চালিয়েছে।

রতন ঘোষ বলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষ বা গ্রামের কেউ—ধর্মবিশ্বাস নির্বিশেষে—এমন সাম্প্রদায়িক হামলা কখনো দেখেনি। এই ঘটনাগুলো সম্প্রীতি এবং বিশ্বাস ভেঙে দেয়।’

এর আগে, ৫ আগস্ট ৭৭ বছর বয়সী হাসিনা ভারতে চলে যান। সেখানে তাঁকে তাঁর পুরোনো মিত্র—বিশেষ করে দেশটির ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকার—আতিথ্য দিচ্ছে। এই বিষয়টি বাংলাদেশিদের ক্ষুব্ধ করেছে। বাংলাদেশিরা চায়, শেখ হাসিনাকে ‘গণহত্যার’ অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হোক।

অধিকারকর্মী আবু আহমেদ ফাইজুল কবির বলেন, বাংলাদেশে হিন্দু মন্দিরে আক্রমণ নতুন কিছু নয় এবং এসব সহিংসতার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নেওয়া উচিত। হাসিনার আমলে হিন্দুরা তাঁর শাসনের কাছে সুরক্ষা চেয়েছিল। এর অর্থ হলো—তার বিরোধীরা তাদের পক্ষপাতদুষ্ট অনুগত হিসেবে দেখেছে। আইন ও সালিস কেন্দ্রের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘গত এক দশকের তথ্য বিশ্লেষণ করলে, এমন একটি বছরও পাবেন না যেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়নি।’

চলতি বছর অর্থাৎ, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আইন ও সালিস কেন্দ্র হিন্দুদের লক্ষ্য করে ১১৮টি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। আগস্ট মাসে সর্বোচ্চ ৬৩টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব সহিংসতায় দুজন নিহতও হয়েছেন। গত নভেম্বর মাসে সাতটি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

তবে চলতি বছরের ১১ মাসে যে পরিমাণ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। গত বছর অর্থাৎ, ২০২৩ সালে সংখ্যালঘুদের ওপর ২২টি হামলা এবং ৪৩টি ভাঙচুরের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল। ২০১৪ সালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় একজন নিহত, ২ নারী ধর্ষিত, ২৫৫ জন আহত এবং ২৪৭টি মন্দিরে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। ২০১৬ সালে সাতজন নিহত হয়।

চন্দন সাহা (৫৯) নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘পরিস্থিতি হয়তো আগের চেয়ে খারাপ হয়নি, কিন্তু কোনো অগ্রগতিও হয়নি। রাজনৈতিক শাসকেরা বারবার সংখ্যালঘুদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেছে।’

শেখ হাসিনার পতনের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে এবং নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের হিন্দুদের অবস্থার বিষয়ে ভারতীয় মিডিয়ার মিথ্যা প্রচারণার অভিযোগ করেছে। ঢাকা এ মাসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বাংলাদেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মোতায়েনের আহ্বানের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। হেফাজতে ইসলাম নয়াদিল্লিকে বাংলাদেশ বিরোধী ‘বিদ্বেষমূলক প্রচারণা’ চালানোর অভিযানের অভিযোগ করেছে। তবে ভারত এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

ধর্মীয় সম্প্রীতির জায়গা আগের তুলনায় নড়বড়ে হয়ে গেছে। নভেম্বরে হিন্দু বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষের কারণে সৃষ্ট অশান্তি এই নড়বড়ে আবহাওয়ার পালে আরও জোরে হাওয়া দিয়েছে। এই ঘটনায় রাষ্ট্রপক্ষের এক আইনজীবী নিহত হন।

এদিকে, শেখ হাসিনার আমলে দমন-পীড়নের শিকার হওয়া বাংলাদেশি ইসলামি গোষ্ঠীগুলোও মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছে। মুসলিম সুফি ও মরমি বাউল সম্প্রদায়ের সদস্যদেরও—যাদের ইসলামি কট্টরপন্থীরা অপছন্দ করে—হুমকি দেওয়া হয়েছে। এসব সহিংসতার ঘটনা নথিভুক্ত করা সৈয়দ তারিক নামে একজন বলেন, ‘ধ্বংসযজ্ঞের একটি ঢেউ বয়ে চলছে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ৮৪ বছর বয়সী নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে সমালোচকেরা বলছেন এটি যথেষ্ট নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া বলেন, ‘একটি শান্তিপূর্ণ দেশ প্রতিষ্ঠা করতে যেখানে সব ধর্ম সহাবস্থান করবে, রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়মিত ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যেতে হবে।’

বাংলাদেশের হিন্দু আইনজীবীদের সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সুমন রায় বলেছেন, ‘সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক দলগুলো একক ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা আমাদের সব সময় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তিনি বলেন, হিন্দুরা অতীতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়ের আমলেই হুমকির মুখে পড়েছে।

সুমন রায় বলেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগকে সমর্থন না করলে হুমকি পেয়েছি, আর বিএনপি আমাদের আওয়ামী লীগের পক্ষ নেওয়ার জন্য দোষারোপ করেছে। এই চক্রটি শেষ হওয়া দরকার।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত