Ajker Patrika

রূপপুরের বালিশ-কাণ্ডে এক প্রকৌশলীকে বাধ্যতামূলক অবসর, অন্যজনের নিম্ন গ্রেডে অবনমন

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ৩৭
রূপপুর গ্রিন সিটি প্রকল্প। ছবি: সংগৃহীত
রূপপুর গ্রিন সিটি প্রকল্প। ছবি: সংগৃহীত

রূপপুর গ্রিনসিটি প্রকল্পের (২০১৯ সালে নির্মাণাধীন) ২০ ও ১৬তলা ভবনের আসবাব ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় এবং ভবনে ওঠানোর কাজে ‘অস্বাভাবিক ব্যয়ের’ অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এ কারণে অভিযুক্ত গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুই উপসহকারী প্রকৌশলীকে গুরুদণ্ড দিয়েছে সরকার। তাঁদের মধ্যে একজনকে বাধ্যতামূলক অবসর এবং অন্যজনকে নিম্ন বেতন গ্রেডে অবনমিত করা হয়েছে।

গতকাল শুক্রবার গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, উপসহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) মো. শাহীন উদ্দিনকে ‘বাধ্যতামূলক অবসর’ এবং উপসহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) মো. আলমগীর হোসেনকে ‘নিম্ন বেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ’ করা হয়েছে।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের পাবনা উপবিভাগে কর্মরত থাকাকালীন মো. শাহীন উদ্দিন এবং রাজশাহী গণপূর্ত জোনে কর্মরত থাকাকালীন মো. আলমগীর হোসেনের বিরুদ্ধে আসবাব ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় এবং সেগুলো ভবনে ওঠানোর কাজে অস্বাভাবিক ব্যয়ের অভিযোগ ওঠে। এই বিষয়টি ২০১৯ সালে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে, ২০১৯ সালের ১৯ মে গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। উভয় কমিটির দাখিল করা তদন্ত প্রতিবেদনে অস্বাভাবিক ব্যয়ের বিষয়টি প্রমাণিত হয়।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, এই দুই প্রকৌশলী অস্বাভাবিক ব্যয়ের প্রাক্কলন প্রস্তুতের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থেকে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন, যা সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ৩ উপবিধি (খ) অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।

এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের পরামর্শক্রমে এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ৪-এর উপবিধি ৩-এর (খ) অনুযায়ী মো. শাহীন উদ্দিনকে ‘বাধ্যতামূলক অবসর’ প্রদান করা হয়েছে।

একইভাবে, মো. আলমগীর হোসেনকে একই বিধিমালার বিধি ৪-এর উপবিধি ৩ (ক) অনুযায়ী ‘নিম্ন বেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ’ গুরুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।

যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এবং সরকারি কর্ম কমিশনের পরামর্শ গ্রহণের পর, রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে ৪ সেপ্টেম্বর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত পৃথক আদেশের মাধ্যমে এই দুই প্রকৌশলীকে গুরুদণ্ড দেওয়া হয় বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।

২০১৯ সালে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ওই প্রকল্পের আবাসিক ভবনের জন্য ১৬৯ কোটি টাকার কেনাকাটায় পদে পদে দুর্নীতি হয়েছে। গণপূর্ত অধিদপ্তরে কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন জোনভিত্তিক যে কেনাকাটা হয়ে থাকে, তার বার্ষিক একটি পরিকল্পনা থাকে। সে ক্ষেত্রে ৩০ কোটি টাকার নিচে কেনাকাটা হলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অনুমোদন লাগে না, স্থানীয় পর্যায়েই করা যায়। এর সুযোগ নিয়ে ১৬৯ কোটি টাকার কাজ ৬টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়। ফলে প্রতিটি কাজের মূল্য ৩০ কোটি টাকার নিচে হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন পড়েনি।

সেখানে প্রতিটি বালিশ কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। আর প্রতিটি বালিশ আবাসিক ভবনের খাটে তোলার মজুরি দেখানো হয়েছে ৭৬০ টাকা। কভারসহ কমফোর্টারের (লেপ বা কম্বলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত) দাম ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৮০০ টাকা। যদিও এর বাজারমূল্য সাড়ে ৪ হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ হাজার টাকা। একইভাবে বিদেশি বিছানার চাদর কেনা হয়েছে ৫ হাজার ৯৩৬ টাকায়। এর বাজারমূল্য অবশ্য ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা।

পাঁচটি ২০তলা ভবনের জন্য এসব কেনাকাটা হয়েছে। প্রতিটি তলায় রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য কমফোর্টার শুধু বেশি দামে কেনাই হয়নি, কেনার পর দোকান থেকে প্রকল্প এলাকায় পৌঁছাতে আলাদা ট্রাক ব্যবহার করা হয়েছে। মাত্র ৩০টি কমফোর্টারের জন্য ৩০ হাজার টাকা ট্রাকভাড়া দেখানো হয়েছে। আর একেকটি কমফোর্টার খাট পর্যন্ত তুলতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ২ হাজার ১৪৭ টাকা। কমফোর্টার ঠিকঠাকমতো খাট পর্যন্ত তোলা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য তত্ত্বাবধানকারীর পারিশ্রমিক দেখানো হয়েছে প্রতিটির ক্ষেত্রে ১৪৩ টাকা। ঠিকাদারকে ১০ শতাংশ লাভ ধরে সম্পূরক শুল্কসহ সব মিলিয়ে প্রতিটি কমফোর্টারের জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ২২ হাজার ৫৮৭ টাকা। শুধু কমফোর্টার নয়, চাদরের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। ৩০টি চাদর আনতে ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি ট্রাক ভাড়া করা হয়েছে। আর ভবনের নিচ থেকে খাট পর্যন্ত তুলতে প্রতিটি চাদরের জন্য মজুরি দেখানো হয়েছে ৯৩১ টাকা।

এই ঘটনায় ওই বছরের ডিসেম্বরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলমসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা হলেন—পাবনা গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে রিজার্ভ, সেগুনবাগিচা) মাসুদুল আলম, তিন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী তাহাজ্জুদ হোসেন, আহমেদ সাজ্জাদ খান ও মোস্তফা কামাল, উপসহকারী প্রকৌশলী আবু সাইদ, জাহিদুল হক, শফিকুল ইসলাম ও রওশন আলী, সহকারী প্রকৌশলী সুমন কুমার নন্দী, মোর্শেদ তারেক ও আমিনুল ইসলাম এবং দুই ঠিকাদার সাজিন কনস্ট্রাকশনের মালিক শাহাদাত হোসেন ও মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের মালিক আসিফ হোসেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ