Ajker Patrika

উদাসীনতায় নীরবে বেড়েছে ডেঙ্গুতে মৃত্যু

  • এ বছর দেশে ডেঙ্গুর ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু।
  • রোগী ব্যবস্থাপনা, সমন্বিত উদ্যোগের ঘাটতিসহ নানা কারণে বাড়ছে ডেঙ্গু।
  • মশকনিধনে জোর দেওয়ার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।
মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ, ঢাকা
ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগ। বিশেষজ্ঞদের মতে, মশকনিধন ও রোগী ব্যবস্থাপনায় অবহেলার কারণে দুই দশকেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। ফলে এই শীতেও ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে রোগীদের। গতকাল রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: আজকের পত্রিকা
ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগ। বিশেষজ্ঞদের মতে, মশকনিধন ও রোগী ব্যবস্থাপনায় অবহেলার কারণে দুই দশকেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। ফলে এই শীতেও ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে রোগীদের। গতকাল রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ছবি: আজকের পত্রিকা

দেশে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সাড়ে পাঁচ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এডিস মশাবাহিত এই রোগে মৃত্যুর এ সংখ্যা দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এ ছাড়া চলতি বছর আক্রান্ত হয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। এই হিসাব শুধু হাসপাতালভিত্তিক। এর বাইরে কত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ও মারা গেছেন, তার পরিসংখ্যান নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের উদাসীনতা বরাবরের মতো এখনো রয়ে গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের শুরু থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা দেশের হাসপাতালগুলোয় ১ লাখ ৪৯১ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৫৬৫ জনের। এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার শূন্য দশমিক ৫৬ জন।

মাসভিত্তিক হিসাবে গত জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ১ হাজার ৫৫ জন, মৃত্যু হয় ১৪ জনের। ফেব্রুয়ারিতে ভর্তি হয় ৩৩৯ জন, মারা যায় ৩ জন। মার্চে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৩১১ জনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। এপ্রিলে ৫০৪ জন রোগীর মধ্যে মারা গেছে ২ জন। মে মাসে ৬৪৪ জন রোগীর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের, জুনে ৭৯৮ জনের মধ্যে ৮, জুলাইয়ে ২ হাজার ৬৬৯ জনের মধ্যে ১২, আগস্টে ৬ হাজার ৫২১ জনের মধ্যে ২৭, সেপ্টেম্বরে ১৮ হাজার রোগীর মধ্যে ৮০, অক্টোবরে ৩০ হাজার ৮৭৯ জনের মধ্যে ১৩৫ এবং নভেম্বরে ২৯ হাজার ৬৫২ রোগীর মধ্যে ১৭৩ জন মারা গেছে। ডিসেম্বরের গতকাল পর্যন্ত ৯ হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাঁদের মধ্যে মারা গেছে ৭৭ জন।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন, আড়াই দশক ধরে বাংলাদেশ ডেঙ্গু মোকাবিলা করছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু প্রতিরোধ, চিকিৎসা, রোগ ব্যবস্থাপনায় অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। তবে এর কোনো প্রতিফলন এখনো দেখা যাচ্ছে না। এডিস মশা নির্মূলে ও রোগী ব্যবস্থাপনায় জনস্বাস্থ্য-সংক্রান্ত চিন্তাভাবনাগুলো এখনো উপেক্ষিত। শুরু থেকেই সমন্বিত উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ একে অপরের প্রতি দোষারোপ করছে। ফলে বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার বিশ্বে শীর্ষে। এদিকে এডিশ মশার স্বভাব অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আবহাওয়াসহ নানা কারণে ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগ।

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. গোলাম সারোয়ার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মশার মধ্যে ভাইরাসের মিউটেশন (রূপান্তর) বেশি হচ্ছে। ফলে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। মশার স্বভাবে পরিবর্তন এসেছে। মশা নির্মূলে যে কীটনাশক দেওয়া হচ্ছে, তা কাজ করছে না আর। মশা কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।’

এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, যে পদ্ধতিতে মশা নিধন করার কথা, সেভাবে হচ্ছে না। কীটনাশক, রাসায়নিক কাজ করছে কি না, তা নিয়মিত পরীক্ষা করা হচ্ছে না। মশা প্রতিরোধী হয়ে উঠল কি না দেখতে হবে। যে এলাকায় রোগী পাওয়া যাচ্ছে, সে এলাকায় মশকনিধন কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। যত ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া রয়েছে, তা প্রয়োগ করতে হবে। স্থানীয়দের সংযুক্ত করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে ডেঙ্গুকে রোগতত্ত্বের গুরুত্ব দেওয়া হয় ২০০০ সালে। এরপর ২০২২ সাল পর্যন্ত ২৩ বছরে ডেঙ্গু রোগীর মোট সংখ্যা ছিল আড়াই লাখ। এই ২২ বছরে মারা গেছেন ৮৫০ রোগী। ২০২৩ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সে বছর হাসপাতালে ভর্তি হন ৩ লাখ ২১ হাজারের বেশি রোগী। মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। আর চলতি বছর এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৫৬৫ জনের, যা দেশে ডেঙ্গুর ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু জামিল ফয়সাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ডেঙ্গুর ব্যবস্থাপনা করছে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে। তবে এখনো আশানুরূপ নিয়ন্ত্রণ সরকার দেখাতে পারেনি। যতটুকু দেখা যাচ্ছে, তা মূলত রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে। অতিদ্রুত সংক্রমণ ছড়াতে সক্ষম এ রোগটিকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম নেই।’

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকার ডেঙ্গুবিষয়ক যে তথ্য দিচ্ছে, তা মূলত হাসপাতালভিত্তিক চিত্র। রাজধানীর ১৮টি সরকারি ও ৫৯টি বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর বাইরে সরকারি পর্যায়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা বা জেনারেল হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে সারা দেশে বিভিন্ন পর্যায়ের বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিলেও তা সরকারের সম্মিলিত তথ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ ছাড়া ডেঙ্গু শনাক্ত হলেও বড় ধরনের জটিলতা না থাকায় অনেক রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন বাড়িতে।

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও সংস্থাটির পরামর্শক মুশতাক হোসেন বলেন, ‘হিসাবের বাইরে কয়েকগুণ বেশি রোগী রয়েছে। কেউ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন সে সংখ্যা আমাদের জানা নেই। রোগী ব্যবস্থাপনা যে ঠিক নেই, এ কথা আমরা বহু বছর ধরে বলে আসছি। রোগ এবং রোগীর ব্যবস্থাপনা না হলে কোনো রোগই নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করা যায় না। আর ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়নি। বেশির ভাগ রোগী ঢাকায় ভিড় করছেন। এতে চিকিৎসা বিলম্বিত হয়।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) মো. ফরহাদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এডিশ মশার নিধনে আমাদের কার্যক্রম নেই। আমরা সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। এ বছর বৃষ্টি দেরিতে শুরু হয়েছে এবং তা নভেম্বর পর্যন্ত ছিল। এতে ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধি পেয়েছিল। হাসপাতালের বাইরে রোগীর হিসাব নেওয়া হয় না। আমরা একটা পরিকল্পনা করছি, যেন আগামী বছর থেকে হাসপাতালের বাইরের রোগীর হিসাবও রাখা হয়। তাতে মৃত্যুর হারও কমে আসবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চকরিয়া থানার ওসিকে প্রত্যাহারের নির্দেশ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার

হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজের আগেই বের হয়ে যেতে বলা হয় জেলেনস্কিকে

‘আমাদের অনুমতি ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করলে থানা ঘেরাও করব’, সরকারি কর্মকর্তার বক্তব্য ভাইরাল

সিরিয়ায় রাশিয়ার ঘাঁটি রাখতে যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের তদবির

এনসিপির কর্মীদের ঢাকায় আনতে সরকারের বাস রিকুইজিশন, সমালোচনার ঝড়

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত