Ajker Patrika

নির্বাচিত সরকার এলে চুপচাপ সরে যাব: ড. ইউনূস

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১৮ জুন ২০২৫, ১৬: ১৩
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের সূচনায় বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা। ছবি: সংগৃহীত
ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের সূচনায় বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টা। ছবি: সংগৃহীত

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আগামী এপ্রিলের মধ্যেই দেশ নির্বাচিত সরকার পাবে, এবং এরপর বর্তমান সরকার চুপচাপ সরে যাবে। ১২ জুন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এই কথা বলেন। অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান আরও বলেন, রাজনৈতিক আন্দোলনের এক বছর পেরিয়ে গেলেও মানুষ এখনো সরকারকে শত্রু হিসেবে দেখে।

ড. ইউনূসের ভাষায়, ‘নতুন বাংলাদেশে’ বিশ্বাস আনতে হলে গ্রামের পর গ্রাম, সরকারের প্রতিটি স্তর থেকে দুর্নীতি দূর করা ছাড়া উপায় নেই। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস জানান, গত জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পতনের পর তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন। এখন তিনি চান, এমন একটি রাষ্ট্র গড়ে উঠুক, যা সাধারণ মানুষকে কিছু ফিরিয়ে দিতে পারবে। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে মানুষ মনে করে, সরকার তাদের কোনো কিছুই দেয় না।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পাসপোর্ট থেকে শুরু করে ব্যবসার লাইসেন্স নিতে গেলে ঘুষ দিতে হয়। সরকারের সদস্যরা টাকা আত্মসাৎ করেছে। প্রতিটি স্তরে দুর্নীতির বিস্তার রয়েছে। তিনি বলেন, ‘সব সময়ই কেউ না কেউ ওত পেতে থাকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য। মানুষ মনে করে, সরকার হলো তাদের চিরস্থায়ী শত্রু। এই শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেই বাঁচতে হয়। এই শত্রু এতই শক্তিশালী যে মানুষ তার কাছ থেকে দূরে থাকতে চায়।’

সরকারি চাকরিতে কোটার মাধ্যমে আওয়ামী লীগপন্থীদের সুবিধা দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ থেকে আন্দোলন শুরু হলেও এর পেছনে অন্য কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল—জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় ও তরুণদের সুযোগের অভাব। আওয়ামী লীগপ্রধান হাসিনা ধীরে ধীরে একনায়কতান্ত্রিক হয়ে উঠেছিলেন। বিরোধীদের দমন করছিলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করছিলেন। ব্যাংকিং খাত ভেঙে পড়েছিল তাঁর দলের লোকজনের দুর্নীতির কারণে। এলিট শ্রেণির একাংশ বিশাল অঙ্কের ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করায় সাধারণ মানুষ নিজের টাকাও তুলতে পারছিল না।

২০২৪ সালের সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অনেকে আশা করেছিলেন, দেশের বিষাক্ত ও দ্বন্দ্বপূর্ণ রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। যেখানে দুই প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বারবার ক্ষমতার জন্য মুখোমুখি হয়েছে। ইউনূস বলেন, ‘আমাদের শুরুটা ছিল এক ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি, এক বিপর্যস্ত সমাজ নিয়ে। প্রশাসন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। আমরা জানতাম না, আমাদের বিলগুলো মেটাতে পারব কি না। বিপুল অঙ্কের সম্পদ যেন কারও মালিকানায় নেই, এমনভাবে লুটপাট করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছে, কিন্তু তারা জানত এটা ঋণ নয়, উপহার—যা আর কখনোই ফিরে আসবে না।’

চলতি বছরের জানুয়ারিতে নির্বাচনী ব্যবস্থা, দুর্নীতি আর জনকল্যাণ নিয়ে কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। ড. ইউনূস এখন চেষ্টা করছেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য গড়ে তুলতে। আগামী জুলাইয়ে আন্দোলনের এক বছর পূর্তির আগেই ‘জুলাই সনদ’ নামে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পন্ন করতে চান তিনি, যেন এরপর এপ্রিলের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া যায়।

ইউনূস বলেন, ‘এই চুক্তি হবে ঐতিহাসিক। সব দলকে একত্র করবে। কমিশনগুলো যে সুপারিশ দিয়েছে, সেগুলো সাধারণ নয়। এগুলো ভাসা-ভাসা কিছু নয়, একটু ভালো করার বা সামান্য পরিবর্তনের পরামর্শ নয়। আমাদের দায়িত্ব এসব বাস্তবায়ন করা এবং দেশকে এক কার্যকর, স্বাভাবিক ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়া।’

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘তারপর আমরা গর্ব করে বলতে পারব, একটা নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছে।’ তবে ইউনূস স্বীকার করেন, সব পক্ষের মধ্যে ঐকমত্য আনা সহজ হবে না। বিএনপি এখন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল এবং নির্বাচনে জয়ের ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে। তারা দ্রুতই ভোট চায়। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী পদে দুই মেয়াদের সীমাবদ্ধতার বিরোধিতা করছে।

তবু ইউনূস মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখন যেভাবে আলোচনার পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সেটি আগের বাংলাদেশে দেখা যায়নি। যেখানে দীর্ঘদিন ধরেই একে অপরের সঙ্গে মতৈক্যের কোনো নজির ছিল না। রাষ্ট্র কীভাবে মানুষের জন্য কাজ করবে—সেটি বদলাতে চান ইউনূস। তিনি চান, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা কিংবা অন্যান্য খাতে কাজ হোক। তিনি নিজেই যে মাইক্রোক্রেডিট মডেল তৈরি করেছিলেন, সেটিকে আরও সম্প্রসারিত করতে চান।

এই খাত বর্তমানে এনজিও-নির্ভর। যারা দরিদ্র মানুষকে ছোট ঋণ দিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসা করতে সাহায্য করে। ইউনূস চান, এটি একটি আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা হোক। যেখানে ক্ষুদ্রঋণের জন্য বিশেষায়িত ব্যাংক থাকবে। তাঁর ভাষায়, এতে উদ্যোক্তা তৈরি হবে। কারণ দরিদ্র মানুষ সাধারণ ব্যাংকের কাছে যেতে পারে না, তারা ঋণ দেয় না।

মাইক্রোক্রেডিট নিয়ে নেতিবাচক ভাবনা তৈরি হয়েছে। কারণ, কিছু ঋণদাতা উচ্চ সুদ আরোপ করেছে। তবে ইউনূস বলেন, এই মডেল বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘মানুষ ভাবে, মাইক্রোক্রেডিট দরিদ্রদের কাছ থেকে টাকা কেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু আসলে তা নয়। তাই একে খারাপ নাম দেওয়া হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, এটা ঠিক করতে হবে। কিন্তু আমি বলি, ঠিক করার কিছু নেই। মাইক্রোক্রেডিটের কোনো ভুল নেই।’

ইউনূস বরাবরই প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার সমালোচক। কারণ, এতে দরিদ্রদের প্রবেশাধিকার নেই। আবার একই সঙ্গে এই ব্যাংক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে ক্ষমতাসীনদের ঋণখেলাপির কারণে। মানুষ পর্যন্ত নিজের জমানো টাকা তুলতে পারেনি।

এক বছর আগেও শেখ হাসিনা তাঁকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করতেন। হঠাৎ করেই তাঁকে সরকারে নিয়ে আসা হয়। ইউনূস বলেন, তিনি এপ্রিলের নির্বাচন পর্যন্তই দায়িত্ব পালন করবেন। এরপর আর সরকারের সঙ্গে থাকবেন না। এখন তাঁর কাজ হলো বিভিন্ন রাজনৈতিক চাপের ভারসাম্য রক্ষা করে সংস্কার বাস্তবায়ন।

ইউনূস বলেন, ‘আগে আওয়ামী লীগের লোকেরা আমাকে আক্রমণ করত, এখন সবাই করে। এটা স্বাভাবিক। এই দায়িত্বে থাকলে সবাই আপনাকে নিয়ে কিছু বলবেই। আপনাকে সেটা মেনে নিতে হবে।’ ইউনূস বলেন, ‘এপ্রিলের পর আমরা একটি নির্বাচিত সরকার পাব। আর আমরা চুপচাপ সরে যাব।’

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সকালে পরীক্ষা, রাতেই ফল: সেই নিয়োগের তদন্তে কমিটি

চোখের সামনে খামেনির অন্তরঙ্গ মহল ফাঁকা করে দিচ্ছে ইসরায়েল

এপ্রিলে নির্বাচিত সরকার পাবে দেশ, এরপর চুপচাপ সরে যাব: প্রধান উপদেষ্টা

আমাদের হয়ে ‘নোংরা কাজটা’ করে দিচ্ছে ইসরায়েল: জার্মান চ্যান্সেলর

গোমস্তাপুরে পুলিশের লাঠিপেটায় আহত ১১ নারী: ওসি ও এসআই প্রত্যাহার

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত