Ajker Patrika

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ

বাছাই কমিটির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের প্রস্তাব

  • নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ৯০ দিন।
  • নির্বাচন না হলে আরও ৩০ দিন দায়িত্ব পালন করতে পারবে ওই সরকার।
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২০ জুলাই ২০২৫, ২৩: ৪১
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) এবং সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি বাছাই কমিটি করা হবে। ওই কমিটি একজনকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে চূড়ান্ত করবে এবং রাষ্ট্রপতি তাঁকেই প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত করবেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যে সংশোধিত প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে, তাতে এমনটিই বলা হয়েছে।

ঐকমত্য কমিশন আজ রোববার দলগুলোর কাছে লিখিতভাবে এই খসড়া প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটির বিষয়ে দলগুলোকে আজকের মধ্যে মতামত জানাতে বলা হয়েছে, যা নিয়ে আগামী মঙ্গলবার কমিশন তাদের অবস্থান জানাবে।

রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ১৫তম দিনের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় আজ। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে সংলাপ শুরু হয়। এতে আলোচ্য সূচি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান। আলোচনার শুরুতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং কমিশনের প্রস্তাব নিয়ে একটি সমন্বিত প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়, যা নিয়ে বেলা ২টার পর পর্যন্ত আলোচনা হয়। সে সময় বলা হয়, আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি নতুন সমন্বিত প্রস্তাব দেওয়া হবে। দুপুরের বিরতিতে কমিশন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দলগুলোকে লিখিত আকারে প্রস্তাবটি দেয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কমিশনের দেওয়া সমন্বিত প্রস্তাবে বিদ্যমান সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদ সংশোধনের কথা বলা হয়। মেয়াদ শেষ বা অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে তার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবে। সংবিধানের ৫৮(খ) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংসদের মেয়াদ শেষের ১৫ দিন আগে কিংবা কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে তার ১৫ দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ চূড়ান্ত করতে হবে বলেও উল্লেখ করা হয় কমিশনের প্রস্তাবে।

কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, ৭৫ বছরের বেশি বয়সী কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারবেন না। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে ৯০ দিন। তবে দৈবদুর্বিপাকের কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন না হলে আরও সর্বোচ্চ ৩০ দিন দায়িত্ব পালন করতে পারবে ওই সরকার। নতুন প্রধানমন্ত্রী কার্যভার গ্রহণের তারিখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সংশোধিত প্রস্তাবে বলা হয়, মেয়াদে শেষ হওয়ার ৩০ দিন আগে স্পিকারের সভাপতিত্বে সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দলের) এবং সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধির সমন্বয়ে ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি’ গঠিত হবে। এই কমিটি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দল এবং জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের কাছ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন একজন করে ব্যক্তির নাম নেবে। প্রস্তাবিত নাম নিয়ে বাছাই কমিটি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে একজনকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নির্ধারিত করতে পারবে এবং রাষ্ট্রপতি তাঁকে নিযুক্ত করবেন।

বাছাই কমিটি গঠনের পাঁচ দিনের (১২০ ঘণ্টা) মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করতে না পারলে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের জন্য সংসদের সরকারি দল/জোট, প্রধান বিরোধী দল/জোট ৩ জন করে এবং তৃতীয় বৃহত্তম দল ২ ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার বৈঠক করে সরকারি দল তৃতীয় বৃহত্তম দল হতে একজনকে, একইভাবে বিরোধী দল বা জোট একজনকে বাছাই করবে। তৃতীয় বৃহত্তম দল সরকারি দল/জোট, বিরোধী দল/জোট প্রস্তাবিত তালিকা হতে আলাদা আলাদা দুজনকে বাছাই করবে। বাছাই করার ব্যক্তিদের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ হবেন। তা না হলে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে স্পিকারের তত্ত্বাবধানে বাছাই কমিটির সদস্যরা র‌্যাংঙ্কড চয়েজ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে একজনকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। সংসদ বহাল অবস্থায় তিনি শপথ নিতে পারবেন না। নিয়োগ লাভের পরে প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটির পরামর্শে অনধিক ১৫ ব্যক্তিকে উপদেষ্টা পদের জন্য বাছাই করবেন।

বৈঠক শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, প্রস্তাবটিতে বিস্তারিতভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে এবং এই প্রস্তাবের অধিকাংশ বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে। এই খসড়া প্রস্তাবটির ওপর ভাষাগত ও খুঁটিনাটি দিক পর্যালোচনা করে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত প্রদানের পরিপ্রেক্ষিতে আগামীকাল এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে কমিশন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পর গতকাল পরে প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান নিয়েও আলোচনা হয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তাঁরা এর আগেও এ বিষয়ে দলীয় অবস্থান যৌক্তিকভাবে তুলে ধরেছেন। সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদনেতাকেই মূলত প্রধানমন্ত্রী করা হয়। তবে সব সময় সেটা হয় না। দলীয় প্রধান হওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য অযোগ্য হবেন, এটা গণতান্ত্রিক প্র্যাকটিসের সঙ্গে যায় না। গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত যুক্তরাজ্যেও দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী হন। কোনো কোনো সময় এটা হয়নি। আর প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেতা একই ব্যক্তি হবেন, এটা একটি রীতি। সংসদনেতার কার্যত তেমন কোনো ভূমিকা নেই। তিনি মূলত সুপার হুইপ হিসেবে কাজ করেন, এটা আলংকারিক। একই ব্যক্তি একসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদনেতা হতে কোনো অসুবিধা নেই।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদনেতা একই ব্যক্তি হতে পারেন। এখানে দুজন হলে কিছু ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ভঙ্গ হতে পারে। তবে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী এক ব্যক্তি যাতে না হন, তার প্রস্তাব দেন তিনি। বলেন, ‘বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে এটা আনা হয়েছে। দেশকে সংস্কারের চেষ্টা করছি ক্ষমতার ভারসাম্য বা কিছু ক্ষমতা সীমিত করে। দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে তেমন জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই। এ ক্ষেত্রে দুজন আলাদা ব্যক্তি হলে সেটা উত্তম হবে। তারপরও তিনি দলীয় ফোরামে এ বিষয়ে আলোচনা করবেন।’

এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব কমিশনের প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। তিনি বলেন, তিনটি জায়গায় একই ব্যক্তি থাকলে বিকল্প নেতৃত্ব বিকশিত হয় না। তিনটি জায়গা আলাদা হলে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হবে। নির্বাচনের পরে দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী হলে দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে বলেও মত দেন তিনি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত