Ajker Patrika

বিমানের আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা

  • গত এক মাসে অন্তত ৯টি উড়োজাহাজে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি।
  • প্রশ্ন উঠেছে বিমানের নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া নিয়ে।
মনজুরুল ইসলাম ঢাকা
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ। ফাইল ছবি
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ। ফাইল ছবি

আকাশে যেন দুর্যোগের মেঘ। বিপদ হেঁটে চলেছে পাশ ঘেঁষে, আর অল্পের জন্য রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে বিমান। উড়ন্ত উড়োজাহাজে যেভাবে একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ছে, তাতে যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

গত এক মাসে উড়াল দেওয়ার আগে-পরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের অন্তত ৯টি উড়োজাহাজে বিভিন্ন ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়েছে। তবে আশার কথা হলো, কিছু ক্ষেত্রে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো গেছে অলৌকিকভাবে। যাত্রী ও ক্রুরা নিরাপদ থাকেলেও ঘন ঘন যান্ত্রিক ত্রুটির এসব ঘটনায় রাষ্ট্রায়ত্ত এই আকাশ পরিবহন সংস্থার নিরাপত্তার মান ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের তথ্য বলছে, গত ৩০ দিনে ঢাকাসহ আবুধাবি, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর ও কুয়ালালামপুর রুটের একাধিক আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে মাঝ আকাশে যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। কোথাও টয়লেটের ফ্লাশ বিকল হয়ে ফেরত আসতে হয়েছে, কোথাও ইঞ্জিনে ত্রুটি ধরা পড়ে জরুরি অবতরণ করতে হয়েছে। কিছু ফ্লাইট যাত্রা শুরু করার পরই মিয়ানমার বা ভারতের আকাশ থেকে ফিরে আসে, আবার কিছু ফ্লাইট উড্ডয়নের আগে রানওয়েতে আটকে যায়। এর ফলে শত শত যাত্রীকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানবন্দরে অপেক্ষা করতে হয়েছে, অনেকের সংযোগ ফ্লাইট মিস হয়েছে, কেউ কেউ গন্তব্যে যেতে পারেননি।

এই অবস্থায় অভিযোগ উঠেছে, বিমানের হ্যাঙ্গারে কর্মরত প্রকৌশলীরা উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণে দায়সারা কাজ করছেন। একাধিক সূত্র জানায়, নির্ধারিত ‘চেক’ ও ‘সার্ভিসিং’ সঠিকভাবে না হওয়া, অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর ঘাটতি এবং যন্ত্রাংশের অভাবে ত্রুটি বেড়ে চলছে।

একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটির ঘটনায় চলতি মাসে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিমান কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে যেকোনো উড়োজাহাজ উড্ডয়নের আগে পূর্ণাঙ্গ কারিগরি পরীক্ষার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। সর্বশেষ গত রোববার (১০ আগস্ট) বিমানের প্রকৌশল বিভাগের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন এয়ারলাইনসটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কিন্তু এসব বৈঠক ও জরুরি নির্দেশনা কোনো কাজে আসছে না। উল্টো রোববার উড়োজাহাজের ডানার ফ্ল্যাপে ত্রুটির কারণে রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বিমানবন্দরে ‘গ্রাউন্ডেড’ করতে হয় বিমানের একটি বোয়িং ড্রিমলাইনার।

প্রকৌশলীরা উড়োজাহাজটির ডানার ফ্ল্যাপে ত্রুটি শনাক্ত করেন, যা উড্ডয়ন নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ। লন্ডন থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ পাঠানোর পর মেরামত করে একই উড়োজাহাজে যাত্রীদের দেশে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিকল্প কোনো ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে না পেরে ২৬২ যাত্রীকে বিমানের খরচে হোটেলে রাখা হয়। অন্যদিকে রোম বিমানবন্দরে অতিরিক্ত অবস্থানের জন্য বিমানকে অতিরিক্ত ফি দিতে হবে।

এই ঘটনার পরদিন গতকাল সোমবার ড‍্যাস-৮ মডেলের একটি উড়োজাহাজের কেবিনের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ২০ মিনিট উড়ে ঢাকায় ফিরে আসে চট্টগ্রামগামী একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট। পরে যাত্রীদের অন্য একটি উড়োজাহাজে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়।

অতি সাম্প্রতিক এ দুটি ঘটনা ছাড়াও চলতি আগস্ট মাসে আরও তিনটি উড়োজাহাজে যান্ত্রিক ত্রুটিতে পড়ে বিমান। ৬ আগস্ট ব্যাংককগামী একটি বোয়িং ৭৩৭ ইঞ্জিনে অতিরিক্ত কম্পন অনুভূত হওয়ায় মিয়ানমারের আকাশ থেকে ফিরে আসে। ৭ আগস্ট আবুধাবিগামী একটি বোয়িং তিনটি টয়লেটের ফ্লাশ বিকল হওয়ায় ১ ঘণ্টা উড়ে ঢাকায় ফিরে আসে। ৯ আগস্ট সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর একটি বোয়িংয়ে সমস্যা দেখা দিলে তা সারিয়ে ২ ঘণ্টা বিলম্বে ঢাকায় ফেরানো হয়।

বিমানের প্রকৌশল বিভাগের তথ্য বলছে, ৬ আগস্ট মিয়ানমারের আকাশ থেকে ফিরে আসা ব্যাংককগামী বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজটি প্রায় আট মাস হ্যাঙ্গারে রেখে মেরামত করা হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, মেরামতের পর যথাযথ মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা ছাড়া সেটিকে উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুত ঘোষণা করা হয় এবং আকাশে ওঠার পরই নতুন করে ত্রুটি দেখা দেয়।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিমানের সাম্প্রতিক ধারাবাহিক যান্ত্রিক ত্রুটিগুলো কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়; বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত রক্ষণাবেক্ষণ-ব্যবস্থার প্রতিফলন। তাঁদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বহরের উড়োজাহাজগুলো নিয়মিত ও পূর্ণাঙ্গভাবে পর্যবেক্ষণ এবং মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষার আওতায় না আসায় ছোটখাটো কারিগরি সমস্যা সময়মতো ধরা পড়ছে না। ফলে এসব ত্রুটি ধীরে ধীরে জটিল আকার ধারণ করে উড্ডয়ন-নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, যা শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, যাত্রীদের জীবনহানির ঝুঁকিও বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।

এ প্রসঙ্গে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ধারাবাহিক যান্ত্রিক ত্রুটির এসব ঘটনা বিমানের ভাবমূর্তি আরও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বাজারে যেখানে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম পুনর্গঠনের প্রয়োজন, সেখানে বারবার এই বিপত্তি যাত্রীদের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। যদিও বিমানের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ দক্ষতার সঙ্গে প্রতিটি ত্রুটি সমাধানের চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, বিমানের বহরের বেশির ভাগ উড়োজাহাজ দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে বয়সজনিত কারণে নানা ধরনের ত্রুটি ও প্রযুক্তিগত বিচ্যুতি নিয়মিতভাবে দেখা দিচ্ছে। এর ফলে যাত্রীরা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন এবং বাজারে নেতিবাচক প্রভাব আরও গভীর হচ্ছে।

গত জুলাই মাসেও বিমানের উড়োজাহাজে ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। ১৬ জুলাই দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘চাকায় ত্রুটি’র কারণে একটি বোয়িং ৭৮৭-৯ ড্রিমলাইনার গ্রাউন্ডেড হয়, যা মেরামতের পর ৩০ ঘণ্টা বিলম্বে দেশে ফেরে। ২৪ জুলাই দুবাই থেকে আসা আরেকটি ড্রিমলাইনারের ল্যান্ডিং গিয়ারের দরজা ঠিকভাবে বন্ধ না হওয়ায় সেটি চট্টগ্রামে ফিরে আসে এবং ত্রুটি সারিয়ে ২ ঘণ্টা পর আবার ঢাকায় যায়। ২৮ জুলাই দাম্মামগামী একটি বোয়িং ৭৭৭-ইআর কেবিন প্রেশারের ত্রুটির সংকেত পেয়ে ঢাকায় ফিরে আসে, পরে যাত্রীদের অন্য উড়োজাহাজে পাঠানো হয়। ৩০ জুলাই শারজা বিমানবন্দরে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে একটি বোয়িং ৭৩৭ ছয় ঘণ্টা আটকে থাকে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এ বি এম রওশন কবীর বলেন, যাত্রীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পরিচালিত হচ্ছে। কোনো উড়োজাহাজে সামান্যতম ত্রুটি শনাক্ত হলে তা শতভাগ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সেটি আকাশে ওড়ানো হয় না। তিনি আরও বলেন, বিমানের দক্ষ মেইনটেন্যান্স টিম দ্রুত যেকোনো কারিগরি সমস্যা মেরামত করে থাকে এবং বিলম্ব হলে যাত্রীদের হোটেলে থাকার ব্যবস্থা, খাবার সরবরাহসহ নিয়মিত সেবা নিশ্চিত করা হয়।

বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে মোট ২১টি উড়োজাহাজ রয়েছে, যার মধ্যে ১৬টি বোয়িং। এগুলোর মধ্যে ছয়টি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার, চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর এবং ছয়টি ন্যারোবডি বোয়িং ৭৩৭। এ ছাড়া স্বল্প দূরত্বের রুটে চলাচলের জন্য বহরে পাঁচটি ড্যাশ-৮০০ উড়োজাহাজ রয়েছে। তবে এসব উড়োজাহাজের বড় একটি অংশ প্রায়ই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিকল হয়ে থাকে, যা সরাসরি ফ্লাইট শিডিউলে বিঘ্ন ঘটায় এবং যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ায়।

বহর প্রসঙ্গে বিমানের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, যাত্রীদের এই ভোগান্তি কমাতে দুটি নতুন উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে এবং আরও কয়েকটি উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। লিজ নেওয়া উড়োজাহাজগুলো দ্রুতই বহরে যুক্ত হবে; তবে ক্রয়প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কিছুটা সময় লাগবে। তাঁর মতে, নতুন উড়োজাহাজ সংযোজন করা হলে বহরের সক্ষমতা বাড়বে এবং ফ্লাইট শিডিউল বিঘ্নিত হওয়ার প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে।

প্রসঙ্গত, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৮৪ সালে। ওই বছরের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা একটি ফকার এফ-২৭ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় পড়ে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কয়েকবার অবতরণের চেষ্টার পর রানওয়ের ৫০০ মিটার আগে মুখ থুবড়ে পড়ে উড়োজাহাজটি। ওই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৪৯ জন। এটাই বিমানের বাণিজ্যিক ফ্লাইটের একমাত্র বড় ধরনের দুর্ঘটনা, যেখানে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘বিচারপতি খায়রুলকে হাতকড়া পরানো মানে পুরো বিচার বিভাগকে হাতকড়া পরানো’

রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী আটক

কোথাও ঘুরতে ইচ্ছা করলে আমাকে জানাবে—ছাত্রীকে খুবি অধ্যাপক

আগামী সপ্তাহের মধ্যে ৫ ইসলামী ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু: গভর্নর

মৌচাকে হাসপাতালের পার্কিংয়ে প্রাইভেট কার থেকে উদ্ধার দুই মরদেহের পরিচয় মিলেছে

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত