Ajker Patrika

নথি পোড়াতেই কি পরিকল্পিত নাশকতা

� আগুন লাগার ধরন ও মাত্রা দেখে সন্দেহ হচ্ছে

� দুর্নীতির নথি পোড়ানোর কথা বলছেন কেউ কেউ

� বিশেষজ্ঞদের কাছেও স্বাভাবিক ঠেকছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১: ৫০
Thumbnail image
গত বুধবার দিবাগত মধ্যরাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগে। ছবি: আজকের পত্রিকা

বিশাল বড় এক ভবনে একসঙ্গে আগুন জ্বলছে তিন জায়গায়। আগুনও লাগল মধ্যরাতে। ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও আগুন নেভাতে সময় লেগে গেল ১০-১১ ঘণ্টা।

সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের এই আগুন তাই যেন স্বাভাবিক ঠেকছে না কারও কাছেই। সরকারের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলের নেতা ও বিশেষজ্ঞদের বয়ানে তাই সন্দেহ আর সংশয়। তাঁদের কেউ কেউ ধারণা করছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির নথি ধ্বংস করার জন্যই এই আগুন লাগানো হয়ে থাকতে পারে। এর সঙ্গে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেউ জড়িত থাকতে পারেন।

আগুনের ঘটনা তদন্তে ইতিমধ্যে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। শিগগিরই তদন্ত কমিটি পাওয়া যাবে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছে সরকারের তরফে। তাতে হয়তো মিলতে পারে আগুন লাগার কারণ।

সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি, ভবনগুলোর নিরাপত্তায় রাতে দায়িত্ব পালন করেন নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী ও নৈশপ্রহরীরা। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তাঁদের কাছেও সন্দেহজনক। তাঁদের মধ্যে একজন নিরাপত্তাকর্মী মাহফুজ মিয়া বর্ণনা দিয়ে বলেন, তিনি একটি স্টোররুমে ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ নিশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। ঘুম থেকে জেগে দেখেন ভেতরে ধোঁয়া। দ্রুত বের হয়ে ওপরের দিকে তাকাতেই দেখেন আগুন। তিনি কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। দ্রুত ভবন থেকে বের হয়ে যান।

আরেক নিরাপত্তাকর্মী জামাল মিয়া বলেন, আগুন কীভাবে লাগল তাঁরা বুঝতে পারেননি। তবে প্রথমে ভবনের মাঝখানে আগুন দেখেন, পরে আবার দেখেন বহু দূরে পশ্চিম পাশে ভবনের একাংশ জ্বলছে। এরপর পূর্ব পাশেও ভিন্ন তলায় আগুন দেখেন। ভবনটির তিনটি তলায় এবং অনেক দূরত্বের তফাতে তিন জাগায় তিনি আগুন দেখেন।

আগুনের ধরন ও ছড়িয়ে পড়ার বর্ণনা শুনে নাশকতার আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরাও। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আলী আহমেদ খান বলেন, তাঁর কাছে আগুনের ধরন দেখে নাশকতা মনে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের আগুন হলে দূরত্ব দিয়ে ৩-৪ জায়গায় সাধারণত লাগার কথা নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে, এটা লাগানো আগুন। শর্টসার্কিটের আগুন কখনো এভাবে লাগে না। এর মধ্যে কাল তো সচিবালয় বন্ধ ছিল। সুতরাং, সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

ভবনটির বহির্গমন সিঁড়ি পশ্চিম এবং পূর্ব পাশের সিঁড়ির দিক থেকে আগুন শুরু হওয়ায় এটাও সন্দেহের কারণ বলে মনে করছেন অনেকেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ভবনের দুই পাশের ও মাঝের তিন সিঁড়ির পাশে আগুনের তীব্রতা বেশি ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, সিঁড়ির পাশ দিয়ে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।

বড়দিনে বন্ধের রাতেই আগুন

গত বুধবার বড়দিনের ছুটি ছিল। সচিবালয়ের সব কার্যক্রম ছিল বন্ধ। এর মধ্যে এই আগুনের ঘটনা নিয়ে আরও সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। বন্ধের এ সুযোগটা নাশকতাকারীরা নিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, সচিবালয়ে সব সময় কড়াকড়ি থাকে। নিরাপত্তার ইস্যুতে এখানে কাউকে ছাড় দেওয়া হয় না। যদি নাশকতা হয়ে থাকে, তাহলে পরিকল্পনা করেই বন্ধের দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে।

সচিবালয়ের এই আগুন পরিকল্পিত হতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নৌবাহিনীর জ্যেষ্ঠ চিফ পেটি অফিসার (পিও) আমিনুল ইসলাম। কেন এটি পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড মনে হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘শর্টসার্কিটের আগুন লাগে এক জায়গা থেকে, সব জায়গায় একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে না। এই আগুন একসঙ্গে বিভিন্ন স্থানে লেগেছে।’

দুর্নীতির নথিই কি লক্ষ্য ছিল

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও আগুনের ঘটনাকে সরাসরি নাশকতা বলেছেন। এর নেপথ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি ও অপরাধের প্রমাণ ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়া দেখছেন তাঁরা।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, শেখ হাসিনা ও তাঁর দোসরদের নথি চাওয়ার পর সচিবালয়ে ভয়াবহ আগুন লাগা ও অনেক নথি পুড়ে যাওয়া দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। এর আগেও দেখেছি যখন কোনো মন্ত্রী-সচিবের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ আসে, তখন সচিবালয়ের ফাইল গায়েব হয়ে যায়। আগুন লেগে যায়।

একই অভিযোগ করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। তাঁর মতে, সচিবালয়ে ঘাপটি মেরে থাকা হাসিনার দালালেরা তাদের অপকর্মের ফাইলগুলো আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে প্রশাসনে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা চাটার দলকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলতে হবে।

সচিবালয়ে আগুনের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘দিন–রাত ২৪ ঘণ্টা সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সেখানে কীভাবে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে, তা আমাদের বোধগম্য নয়।’

তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ধারণার ওপর ভিত্তি করে এখনই তারা কোনো মন্তব্য করতে চায় না। সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘সচিবালয়ে রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল থাকে। ফলে এ বিষয়টিকে সরকার খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। যার জন্য স্বরাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রাথমিক প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত