Ajker Patrika

পাহাড় থেকে বিসিএসেই প্রশাসন ক্যাডার

খাগড়াছড়ির রামগড়ের প্রত্যন্ত এলাকায় বেড়ে উঠেছেন মো. আজাদ হোসেন। তিনি রামগড় সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ফেনী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা ডেন্টাল কলেজ থেকে বিডিএস পাস করেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন আকাশ ছুঁবেন, সে স্বপ্ন পূরণও হয়েছে। ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। বর্তমানে বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত। তিনি তাঁর বিসিএস যাত্রার গল্প ও নতুনদের পরামর্শ নিয়ে কথা বলেছেন। সেই গল্প শুনেছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম

আনিসুল ইসলাম নাঈম, ঢাকা
আপডেট : ২৬ মে ২০২৫, ১৪: ৪২
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ফাইভে উঠেও পড়তে-লিখতে জানতাম না

পড়াশোনার এমন হাল ছিল যে ক্লাস ফাইভে উঠেও ঠিকঠাক পড়তে লিখতে জানতাম না। হঠাৎ একদিন স্কুল ভিজিটে আসেন এক শিক্ষা অফিসার। তাঁর কাছে মনে হলো আমি ব্রাইট স্টুডেন্ট; ভালো গাইডেনস পেলেই ভালো করতে পারব। তিনি পাশের একটা ভালো স্কুলে কিছুদিন আমাকে পড়ার সুযোগ করে দিলেন। সেটি ছিল জীবন বদলে যাওয়া মুহূর্ত। তারপর রামগড় সরকারি হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। সেই থেকে আমার স্বপ্নের পথযাত্রা শুরু। আমার পড়াশোনা কোন গতিপথে গেছে সেটা ভাবতে নিজেরই অবাক লাগে। পাহাড়ে আমাদের জীবনে দারিদ্র্যের চেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল অজ্ঞতা।

বই কেনার টাকা থাকত না

আমরা বা আমাদের পরিবার জানতাম না, পড়াশোনার গুরুত্ব আসলে কী! কোথায় পড়তে হবে, কীভাবে পড়তে হবে, কেন পড়তে হবে—এসব জিনিসের উত্তর একেবারে অজানা ছিল। তবে একভাবে নিজেকে লাকি মনে করি। কারণ জীবনে যেখানে আটকে গেছি, সেখানে কাউকে না কাউকে পেয়েছি। কেউ ফ্রিতে বছর ধরে পড়িয়েছেন, কেউবা উপবৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। শত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পেরেছি। মনে আছে নোট বই কিংবা গ্রামার বই কেনার টাকা থাকত না কোনো ক্লাসেই। ধার করে বই নিয়ে চালিয়েছি। কখনো শুধু মেইন বই পড়েই পরীক্ষা দিতে হয়েছে। প্রথমবারের মতো যখন জেএসসি পরীক্ষা হলো, এমন প্রস্তুতিতে পুরো উপজেলায় একমাত্র ছাত্র হিসেবে আমি ‘এ’ প্লাস পেয়েছিলাম।

অভাব ঘোচাতে গৃহশিক্ষক থেকেছি

এসএসসির পরে এইচএসির জন্য ভর্তি হলাম ফেনী সরকারি কলেজে। নিজের খরচ আর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল একটি বাড়িতে গৃহশিক্ষক হিসেবে। ছাত্রজীবনের সবচেয়ে স্ট্রাগলিং পিরিয়ড হয়তো এই সময়টা ছিল। দিনরাত টিউশনি করে নিজের পড়ার সময় হতো না। আবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে সবাই যখন মেডিকেল অ্যাডমিশন বা ভার্সিটি অ্যাডমিশনের কোচিং করছিল, আমার সে সুযোগও ছিল না। নিজের মতো পড়েই মেডিকেল অ্যাডমিশন টেস্ট থেকে সুযোগ পাই ঢাকা ডেন্টাল কলেজে। এখান থেকে বিডিএস করি। ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল থেকে পরবর্তীকালে ইন্টার্নশিপ শেষ করি।

স্বপ্ন দেখার শুরু

স্কুলে থাকতে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ বা নানান প্রোগ্রামে ইউএনও স্যারকে দেখতাম। ক্যাডার অফিসার হওয়া বলতে ততটুকুই জানতাম। তবে ব্যাচেলর শেষ করার কিছু আগে থেকে চিন্তা করছিলাম কোন দিকে ক্যারিয়ার গড়ব। তখন সবকিছু মিলিয়ে ঠিক করলাম বিসিএস দেব। বিসিএস যাত্রার শুরু ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষা শেষ করার পর থেকে। পরীক্ষা শেষ করার পরের দিন থেকে পড়তে বসে গিয়েছিলাম। মনে মনে টার্গেট নিয়েছিলাম এক বছর নিজেকে সময় দেব।

যেভাবে ক্যাডার পেলাম

বিসিএসের প্রস্তুতির সময় টিউশনি করানো বাদ দিয়েছি। টাকা ধার করে একাগ্রতার সঙ্গে কয়েক মাস পড়ে গেছি। এরপর মেডিকেলের ইন্টার্নশিপ শুরু হলে সময় বাঁচিয়ে দিনের সর্বোচ্চ সময় পড়াশোনায় দিয়েছি। সে সময় স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ সব বিক্রি করে দিয়েছিলাম, যাতে পড়াশোনায় ক্ষতি না হয়। প্রিপারেশনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল কনসেপ্ট ক্লিয়ার করা। প্রথমে সব বিষয়ের খুব দ্রুত কনসেপ্ট ক্লিয়ার করে গেছি। এরপর বিসিএসের বিগত সালের প্রশ্ন অনেক ভালো অ্যানালাইসিস করেছি।

বিসিএস যাত্রার পুরুটা সময় যে ভালো গেছে তা না। হতাশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তবে একবার যখন আপনি প্রিপারেশনের মধ্যেই মজা পেয়ে যাবেন, তখন আপনার জন্য প্রিপারেশনটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। ৪৩তম প্রথম বিসিএস ছিল বিধায় সবচেয়ে বেশি ভয় পেতাম। কীভাবে ভাইভা মোকাবিলা করব? প্রিলি পাস করার পরপরই মনে হয়েছে লিখিত পাস করে যাব। প্রিলি থেকেই কনসেপ্ট ক্লিয়ার করে পড়ায় লিখিত সহজ হয়ে গিয়েছিল। লিখিত পাস করার জন্য রেগুলার যে প্রিপারেশন, সেটাই নিয়েছিলাম। তবে ভাইভার জন্য অনেক মাস সময় নিয়ে প্রিপারেশন নিয়েছিলাম।

নিজেকে প্রমাণের অদম্য ইচ্ছে ছিল

প্রিপারেশন খুব ভালো ছিল। তাই আশা করছিলাম যেকোনো একটি ক্যাডার অবশ্যই পাব। তবে রেজাল্টে প্রশাসন ক্যাডার পাওয়ার পর কাছের বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের উচ্ছ্বাস দেখে নিজেকে সফল মনে হয়েছিল। তখন কয়েকবার রেজাল্ট শিটে নিজের রোল চেক করছিলাম। এই সাফল্যের অনুপ্রেরণা হিসেবে সব সময় আমার বেড়ে ওঠা ইচ্ছাশক্তি কাজে দিয়েছে। নিজেকে প্রমাণের অদম্য ইচ্ছাই সব সময় সাহস জুগিয়েছে। সব সময় মনে হতো পাহাড় থেকে এত চড়াই-উতরাই পার হয়ে এতটুকু যখন আসতে পেরেছি, বাকি পথও পাড়ি দিতে হবে।

নতুনদের বিসিএস প্রস্তুতি

প্রথম কথা হলো, ঠিকঠাক পরিকল্পনা করে ফেলুন। নিজের শক্তি আর দুর্বলতার জায়গাগুলো চিহ্নিত করুন। কীভাবে নিজেকে পড়ার টেবিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখতে পারবেন, সে ছক কষে ফেলুন। বাকিটা অদম্য ইচ্ছাশক্তি আপনাকে গন্তব্যে নিয়ে যাবে। অধ্যবসায়, লেগে থাকার অদম্য ইচ্ছা আর সঠিক পরিকল্পনা বিসিএস প্রস্তুতির কঠিন পার্ট। এ ছাড়া কোন্ বই পড়বেন, কোথা থেকে পড়বেন, তা জানলেই হবে। আমার কাছে পড়ার থেকে নিয়মিত পরীক্ষা দেওয়া আর সে অনুযায়ী প্রতিনিয়ত দুর্বলতার জায়গাগুলো ঠিক করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। নতুনেরা এই কাজ নিয়মিত করার চেষ্টা করবেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

সব সময় পরিবার, সমাজ ও দেশের কাজে আসতে চাই। বিদেশ থেকে হেলথ ইকোনমিকস অথবা পাবলিক হেলথে মাস্টার্স করার ইচ্ছে আছে। পাশাপাশি দেশের স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নে পলিসি মেকার হিসেবে অবদান রাখতে চাই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

শেখ হাসিনা যাঁকে ঢাকায় ‘হত্যা করলেন’, তিনি ময়মনসিংহে জীবিত!

চরফ্যাশন থেকে গেটিসবার্গ কলেজ

জীবিত ভাইকে জুলাই আন্দোলনে নিহত দেখিয়ে মামলায় সাক্ষীও দুই ভাই, নেপথ্যে যা জানা গেল

নগদে স্ত্রীর চাকরি, স্বার্থের সংঘাতে জড়ালেন নাহিদের সাবেক পিএ আতিক মুর্শেদ

যুক্তরাষ্ট্রে সি চিন পিংয়ের মেয়েকে বহিষ্কারের দাবি, হঠাৎ কেন এই বিতর্ক

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত