Ajker Patrika

প্রাচীনতম আধুনিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মুসতানসিরিয়া

কাউসার লাবীব
প্রাচীনতম আধুনিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মুসতানসিরিয়া

বাগদাদের দজলা নদীর তীরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক অনন্য কীর্তি—মুসতানসিরিয়া। আব্বাসীয় খলিফা আল-মুসতানসির বিল্লাহর অমর স্মৃতি বহনকারী এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু একটি পুরোনো স্থাপনা নয়, বরং এটি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ও শ্রেষ্ঠ একটি বিশ্ববিদ্যালয়। আব্বাসীয় খিলাফতের শেষ সময়ে জ্ঞান ও সভ্যতার যে অসাধারণ নিদর্শনগুলো গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে এই মুসতানসিরিয়া আজও কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে।

আল-মুসতানসির বিল্লাহ ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ ও দূরদর্শী শাসক। তিনি তাঁর পিতা আল-জাজিরের মতোই রাষ্ট্রীয় জীবনের দুর্নীতি ও অন্যায় দূর করে জনগণের কল্যাণ সাধনে সচেষ্ট ছিলেন। ১৭ বছর ধরে শাসনকার্য পরিচালনা করার সময় তিনি অসংখ্য জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন। সেতু, সরাইখানা, অতিথিশালা—এমন সব জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি তিনি শিক্ষার প্রসারেও মনোযোগী হন। তাঁর সেই দূরদর্শী চিন্তা থেকেই মুসতানসিরিয়ার মতো এক মহাকীর্তির জন্ম হয়।

প্রতিষ্ঠা ও জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধন

৬২৫ হিজরি (১২২৭ খ্রি.) সালে খলিফা আল-মুসতানসির বাগদাদের দজলা নদীর পাশে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির নির্মাণকাজ শুরু করেন। খিলাফতের তৎকালীন প্রধান স্থপতি মুহাম্মদ ইবনুল আলকামি এর নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধান করেন। এর নির্মাণব্যয় ছিল প্রায় ৭ লাখ দিনার। ৬৩১ হিজরি (১২৩৩ খ্রি.) সালে এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করা হয়। সেদিন এক হাজার ছাগল জবাই করা হয়েছিল এবং নানা ধরনের সুস্বাদু খাবার দিয়ে বিশাল ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। পুরো বাগদাদ শহরে সেই খাবার বিতরণ করা হয়েছিল।

জ্ঞানচর্চার এক সমন্বিত কেন্দ্র

মুসতানসিরিয়া শুধু একটি মাদ্রাসা ছিল না, বরং এটি ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে কোরআন, হাদিস, ফিকহ (আইন), চিকিৎসাবিজ্ঞান, গণিতসহ বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হতো। মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে এই প্রথম এখানে চারটি প্রধান ফিকহ (হানাফি, শাফেয়ি, মালিকি ও হাম্বলি) একসঙ্গে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া এখানে কোরআন ও হাদিস গবেষণার জন্য আলাদা দুটি ভবন ছিল। এই সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা তৎকালীন জ্ঞানচর্চাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মুসতানসিরিয়ার অনুসরণে মিসর ও বাগদাদে আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, যেখানে ফিকহের চারটি মাজহাবই পড়ানো হতো।

অতুলনীয় শিক্ষাব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধা

মুসতানসিরিয়ায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ই ছিলেন খুবই উচ্চমানের। তৎকালীন শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ ও আলেমদের এখানে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি মাজহাবের জন্য একজন করে শিক্ষক এবং চারজন করে সহযোগী শিক্ষক বা ‘মুইদ’ ছিলেন। ছাত্র নির্বাচনের ক্ষেত্রেও মেধার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো।

শিক্ষার প্রসারে মুসতানসিরিয়া যেন সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছিল। এখানে ৮০ হাজার বইয়ের বিশাল একটি গ্রন্থাগার ছিল, যা শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও জ্ঞানার্জনের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। শুধু তা-ই নয়, এখানে একটি হাসপাতালও ছিল, যেখানে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে চিকিৎসাবিজ্ঞান শিখতে পারত। শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রা যাতে কোনোভাবে ব্যাহত না হয়, সে জন্য খলিফা এর জন্য বিশাল সম্পত্তি ওয়াক্‌ফ করে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের জন্য নিয়মিত বেতন, খাবার, বাসস্থান এবং পড়াশোনার সব উপকরণ যেমন কালি, কাগজ, কলম ইত্যাদি সরবরাহ করা হতো। এমনকি গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা পানি এবং শীতকালে গরম পানির ব্যবস্থা ছিল।

কালের আবর্তনে মুসতানসিরিয়ার নীরবতা

মুসতানসিরিয়া প্রায় চার শতাব্দী ধরে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ছিল। যদিও মাঝে মাঝে এর কার্যক্রমে ছেদ পড়েছিল। ১২৫৮ সালে মোগলদের আক্রমণে বাগদাদ ধ্বংস হলে এর স্বাভাবিক কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তৈমুর লংয়ের আক্রমণে এটি আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর মহামূল্যবান গ্রন্থাগারটি হারিয়ে যায়। এরপর প্রায় দুই শতাব্দী ধরে এটি বন্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে এটি বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো যাত্রীদের সরাইখানা, কখনো সামরিক বাহিনীর ব্যারাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। অবহেলা ও অযত্নে এর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়।

অবশেষে ১৯৪০ সালে ইরাকের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে পুনরুদ্ধার করে এবং সংস্কারের পর এটিকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। মুসতানসিরিয়া আজও তার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যা আব্বাসীয় সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মানবিকতার এক অনন্য নিদর্শন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত