গত বছর জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সহিংসতায় সহস্রাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) মামলার বিচার প্রক্রিয়াসহ নানা দিক নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিক। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন। আজকের পত্রিকা পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো—
অনলাইন ডেস্ক
ডয়চে ভেলে: শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে মনবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ, হেলিকপ্টার থেকে গুলির নির্দেশ ছাড়াও সুনির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও রয়েছে সেখানে। আপনি অভিযোগগুলো কীভাবে দেখছেন?
মাহবুব শফিক: আমাদের যে আইসিটি আইন, সেটি আসলে করা হয়েছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, সেটাকে কেন্দ্র করে। এটা সেই সময়ে কনফাইন্ড ছিল। সংবিধানে একটা প্রটেকশন দেওয়া ছিল যে, সেটা ওই সময়ের জন্য। পরে ওই আইন যখন বলবৎ করা হয়, ট্রাইব্যুনাল করা হয়, ট্রায়েল করা হয়, সেটা কিন্তু ওই ১৯৭১ সালকে ধরেই করা হয়েছে এবং সেটাই কিন্তু ছিল। আমরা ভেবেছিলাম ওই সময়ের মানবতাবিরোধী অপরাধ আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধক্ষেত্রে যে অপরাধ, তার জন্য আইনটি। আমরা কিন্তু কখনো চিন্তা করিনি এর পরে কোনো ইস্যুকে ধরে আইনটিতে ট্রায়াল করা যায়। সেটিকে আনার জন্য তারা আইনটি সংশোধন করেছে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধকে চিন্তা করে এবং এই সময়ে জুলাইকে মাথায় রেখে তারা করেছে। এটি কতটুকু আইনসংগত হয়েছে, সেটি কিন্তু একটি সাংবিধানিক ইস্যু। সেটা কিন্তু ডিসাইড করার বিষয় আছে।
ডয়চে ভেলে : ট্রাইব্যুনালের যিনি চিফ প্রসিকিউটর, তিনি তো একসময় এই ট্রাইব্যুনালেই আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন। জামায়াত নেতাদের আইনজীবী ছিলেন। এতে কি নিয়মের কোনো লঙ্ঘন হয়েছে ? এখানে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট হয় কি না...
মাহবুব শফিক: আইনগতভাবে আমাদের এখানে ইস্যুটা হলো এ রকম—আমি যেই পক্ষে কাজ করবে, তার অপর পক্ষে গিয়ে কাজ করতে পারব না। আমার অ্যাপয়ন্টমেন্ট যদি বাদীর পক্ষে হয়, আমি বিবাদীর পক্ষে কাজ করতে পারবে না। এখানে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট এই কারণে, উনারা যেহেতু সেই সময়ে ডিফেন্সের হয়ে কাজ করেছেন, এখন এসে প্রসিকিউশনের হয়ে কাজ করাটা আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এই প্রশ্নগুলো কিন্তু উঠেছিল। আমাদের সিনিয়র অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী সাহেব, তিনি মারা গেছেন, তিনি এই প্রশ্নগুলো তুলে একটা আবেদন করেছিলেন। তার শুনানি হয়েছিল। প্রশ্নগুলো স্পষ্টভাবে এসেছিল। কিন্তু কোর্ট সেটা আমলে নেননি। ওই আদেশ কোনো আইনগত ফোরাম না থাকায় চ্যালেঞ্জ করা যায়নি। তবে ভবিষ্যতে হয়তো এটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে বলে আমি মনে করি।
ডয়চে ভেলে: তাদের বাইরেও তো প্রসিকিউটর নিয়োগের সুযোগ ছিল। তারপরও তাদেরই কেন নিয়োগ দেওয়া হলো?
মাহবুব শফিক: এখানে কোনো পলিটিক্যাল উইল বা ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয়। এটা একাত্তরে যে ঘটনা ঘটেছে ,সেটির প্রতিশোধ হিসেবে চিন্তা করা হচ্ছে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্নও এসেছে এখন। সেটি হয়তোবা হতে পারে।
ডয়চে ভেলে: চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাহেব বলেছেন, ‘এই বিচার কোনো প্রতিশোধের জন্য নয়, এটা হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা ও আগামী প্রজন্মকে একটি নিরাপদ বাংলাদেশ উপহার দেওয়া।’ এই বিচারের মধ্যে কী কোনো প্রতিশোধের বীজ আছে?
মাহবুব শফিক: আমার মনে হয় এখানে ‘নয়’ শব্দটি সার্কাস্টিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে এখানে ইনার মিনিংটা হলো অন্য। আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে আমার মনে হয়েছে, এটা একাত্তরকে মুছে ফেলার একটা চেষ্টার একটা স্টেপ বা প্রথম স্টেপ হিসেবে ধরতে পারি।
ডয়চে ভেলে: চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেছেন, ‘আমরা প্রমাণ করতে চাই একটি সভ্য সমাজ, যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকবে, সেখানে গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না। যে দেশে বিচার থাকবে, সেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না’—আইনের এই যে মহান বাক্যগুলো, তা এই ট্রাব্যুনালের মধ্য দিয়ে আপনি প্রতিষ্ঠার কতটা সুযোগ দেখছেন?
মাহবুব শফিক: আরেকটি বিষয় যা আমার আগেই বলা দরকার ছিল৷ এখানে একটু বলি। এই একই বিষয় নিয়ে কিন্তু পেনাল কোডেও মামলা চলছে। যাদের এখানে আসামি করা হয়েছে, তাদের কিন্তু পেনাল কোডেও মামলার আসামি করা হয়েছে। সেই মামলাগুলোও চলছে। সেখানেও তদন্ত হচ্ছে। রিপোর্ট দিচ্ছে। একই বিষয়ে দুটি জায়গায় মামলা চলতে পারে কি না? যদি সেটা চলে, আমাদের সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদে আছে ডাবল জিওপার্ডি। একই বিষয়ে একই লোককে বা একই ব্যক্তিকে দুবার ট্রায়াল করা যাবে না। সেটির কোনো ব্যত্যয় হচ্ছে কি না, সেটিও দেখার বিষয় আছে।
ডয়চে ভেলে: আবারও প্রশ্নটি করি, এই ট্রাবুন্যাল ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কতটা ভূমিকা রাখবে?
মাহবুব শফিক: যদি প্রতিশোধমূলক চিন্তা থেকে হয় বা আইনের শাসনের পূর্বশর্ত হলো আমাদের সংবিধানের যে বিধানগুলো আছে, সেগুলো সমুন্নত রাখা, সেগুলোকে সত্যিকার অর্থে প্রয়োগ করা। যদি একই ব্যক্তিকে নিয়ে দুটি জায়গায় একই বিষয় নিয়ে মামলা চালাতে উৎসাহিত করা হয়, তাহলে তাকে আমি আইনের পরিপন্থী বলে মনে করি।
ডয়চে ভেলে: সমন্বয়কেরা কেউ কেউ মেটিকিউলাস প্ল্যানের কথা বলছেন। আবার বলছেন এই মেট্রোরেলে হামলা না হলে আন্দোলন সফল হতো না। আবার ৫ আগস্টের পরেও অনেক ঘটনা ঘটেছে।
মাহবুব শফিক: খুবই ইন্টারেস্টিংলি শেখ হাসিনার মামলাটি ডাইরেক্টলি টিভিতে দেখানো হচ্ছে। সেখানে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল সাহেব ইন্টারেস্টিংলি ওখানে বারবার বলেছেন , মেট্রোরেলে আগুন দেওয়া, পুলিশ হত্যা বা ধ্বংসাত্মক যে কাজকর্ম, সেটি শেখ হাসিনাই করেছেন—এ রকম একটি উক্তি দিয়েছেন। যেখানে সমন্বয়কেরা কেউ কেউ বলেছেন, এটা যদি করা না হতো, তাহলে বিপ্লব সফল হতো না। এটা একেবারেই কন্ট্রাডিকটরি। এই কন্ট্রাডিকশন নিয়ে তাঁরা সামনে কীভাবে আগাবে, এটি আসলে সামনে বের হয়ে আসবে মেটিকিউলাস প্ল্যান বলতে তাঁরা কী বোঝাচ্ছেন। এটা একাত্তরের প্রতিশোধ ছিল কি না—এটা আসলে ভবিষ্যৎই বলবে। ইতিহাস এটাকে প্রকাশ করবে।
ডয়চে ভেলে: টবি ক্যাডম্যান তো ওই সময়ে জামায়াতের পরামর্শক ছিলেন। এখন তো চিফ প্রসিকিউটরের পরামর্শক নিযুক্ত হয়েছেন। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
মাহবুব শফিক: এটিও কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের আরেকটি উদাহরণ হলো। এটিও পার্ট অব আ মেটিকিউলাস প্ল্যান কি না, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
ডয়চে ভেলে: জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য কথা উঠেছিল। পরে এখানে সেটা নাকচ করে দেওয়া হলো। সেটার কারণ কী হতে পারে?
মাহবুব শফিক: ওইখানে বিচারের জন্য যদি যেত, তাহলে নিরপেক্ষভাবে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারতে। মেটিকিউলাস প্ল্যানের এভিডেন্সগুলো হয়তো আরও শক্তভাবে আসতে। সেই কারণে হয়তো উনারা সেটা নাকচ করেছেন।
ডয়চে ভেলে: দ্রুত বিচারের দাবি আছে। কিন্তু নিয়মিত আইনগত কোর্সের বাইরে গিয়ে দ্রত বিচার করলে তাতে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হবে, না নিশ্চিত হবে?
মাহবুব শফিক: আইনের কতগুলো বেসিক কথা আছে। জাস্টিস হারিড, জাস্টিস বারিড, জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড। কোনোটিই করা ঠিক নয়। সত্যিকার অর্থে আইনের প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করা হোক। বাদী, বিবাদী উভয়ই যৌক্তিক সময় পাক এবং সত্যটি বেরিয়ে আসুক ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক এবং সেটাই হওয়া উচিত।
ডয়চে ভেলে: শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একই সঙ্গে পাঁচটি অপরাধের অভিযোগে বিচার শুরু হয়েছে। তিনি হত্যার নির্দেশদাতা, গুলি ও হেলিকপ্টার থেকে গুলির নির্দেশদাতা আবার সরাসরি তিনটি হত্যাকাণ্ডেরও অভিযোগ আনা হয়েছে। এই অভিযোগগুলো আপনি কীভাবে দেখেন?
মাহবুব শফিক: আইসিটি আইনটা খুবই স্পেশাল ল। একেকটি কাউন্ট হিসেবে উনারা যদি এনে থাকেন, সেটা আইনের দৃষ্টিতে কতটা সঠিক হবে, সেটা তো যাচাই হবেই এখানে। এখানে ডিফেন্স লইয়ারেরা থাকবেন, বিচারকেরা আছেন, তাঁরা তো সেটা দেখবেন।
ডয়চে ভেলে: যাঁরা আটক হয়েছেন, তাঁদের আইনজীবীরা তো এখানে আছেন৷ শেখ হাসিনার সঙ্গে একই মামলার আসামি আছেন। তাঁরা কি চাপমুক্তভাবে কাজ করতে পারছেন?
মাহবুব শফিক: অনেক ক্ষেত্রে ডিফেন্স লইয়ারদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পাওয়ার যদি কোর্টে দেখাতে পারে, তবেই অ্যালাও করা হচ্ছে।এইসব বিষয় কিন্তু আছে। এটা অনেকটা ওয়ান ইলেভেনের সময় যে ক্যাঙ্গারু কোর্ট ছিল, সেটাকে মনে করিয়ে দেয় আমাদের। যেখানে লইয়ারদের ঢুকতে বাধা দেওয়া হতো, প্রতিটি বই চেক করা হতো—এগুলো আছে।
ডয়চে ভেলে: ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচারপ্রক্রিয়া সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হচ্ছে। কোনো বিচারপ্রক্রিয়া সরাসরি সম্প্রচার বাংলাদেশে এটাই প্রথম। এটা বিচারের স্বচ্ছতা কতটা নিশ্চিত করবে?
মাহবুব শফিক: পৃথিবীর কোনো দেশেই কিন্তু কোনো জুডিশিয়াল প্রসিডিং এভাবে ওপেনলি দেখানো হয় না। যেমন, অ্যামেরিকায় স্কেচ দিয়ে বোঝানো হয়। তারা কী বলেছে সেটাও প্রকাশ করা হয়। কিন্তু লাইভ টেলিকাস্ট পৃথিবীর কোনো দেশেই প্র্যাকটিস হিসেবে নেই। এতে আসলে কোর্ট, পাবলিক প্রভাবিত করার সম্ভাবনা থেকে যায় বা কিছুটা মিডিয়া ট্রায়ালেরও বিষয়টিও এখানে উঠে আসে। এটা সঠিক হলে সবার জন্যই করার দরকার ছিল। অন্যদের ক্ষেত্রে তাঁরা করছেন না। শেখ হাসিনার মামলাটির বেলায়ই তাঁরা করছেন। এটিও ডিসক্রিমিনেশন। এটা আইনগতভাবে জুডিশিয়ারিকে ইনফ্লুয়েন্স করার চেষ্টা বা পাবলিক ওপিনিয়ন নিয়ে সেটাকে ইনফ্লুয়েন্স করার চেষ্টা। এটা না করাই শ্রেয়।
ডয়চে ভেলে: শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে মনবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ, হেলিকপ্টার থেকে গুলির নির্দেশ ছাড়াও সুনির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও রয়েছে সেখানে। আপনি অভিযোগগুলো কীভাবে দেখছেন?
মাহবুব শফিক: আমাদের যে আইসিটি আইন, সেটি আসলে করা হয়েছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, সেটাকে কেন্দ্র করে। এটা সেই সময়ে কনফাইন্ড ছিল। সংবিধানে একটা প্রটেকশন দেওয়া ছিল যে, সেটা ওই সময়ের জন্য। পরে ওই আইন যখন বলবৎ করা হয়, ট্রাইব্যুনাল করা হয়, ট্রায়েল করা হয়, সেটা কিন্তু ওই ১৯৭১ সালকে ধরেই করা হয়েছে এবং সেটাই কিন্তু ছিল। আমরা ভেবেছিলাম ওই সময়ের মানবতাবিরোধী অপরাধ আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধক্ষেত্রে যে অপরাধ, তার জন্য আইনটি। আমরা কিন্তু কখনো চিন্তা করিনি এর পরে কোনো ইস্যুকে ধরে আইনটিতে ট্রায়াল করা যায়। সেটিকে আনার জন্য তারা আইনটি সংশোধন করেছে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধকে চিন্তা করে এবং এই সময়ে জুলাইকে মাথায় রেখে তারা করেছে। এটি কতটুকু আইনসংগত হয়েছে, সেটি কিন্তু একটি সাংবিধানিক ইস্যু। সেটা কিন্তু ডিসাইড করার বিষয় আছে।
ডয়চে ভেলে : ট্রাইব্যুনালের যিনি চিফ প্রসিকিউটর, তিনি তো একসময় এই ট্রাইব্যুনালেই আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন। জামায়াত নেতাদের আইনজীবী ছিলেন। এতে কি নিয়মের কোনো লঙ্ঘন হয়েছে ? এখানে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট হয় কি না...
মাহবুব শফিক: আইনগতভাবে আমাদের এখানে ইস্যুটা হলো এ রকম—আমি যেই পক্ষে কাজ করবে, তার অপর পক্ষে গিয়ে কাজ করতে পারব না। আমার অ্যাপয়ন্টমেন্ট যদি বাদীর পক্ষে হয়, আমি বিবাদীর পক্ষে কাজ করতে পারবে না। এখানে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট এই কারণে, উনারা যেহেতু সেই সময়ে ডিফেন্সের হয়ে কাজ করেছেন, এখন এসে প্রসিকিউশনের হয়ে কাজ করাটা আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। এই প্রশ্নগুলো কিন্তু উঠেছিল। আমাদের সিনিয়র অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী সাহেব, তিনি মারা গেছেন, তিনি এই প্রশ্নগুলো তুলে একটা আবেদন করেছিলেন। তার শুনানি হয়েছিল। প্রশ্নগুলো স্পষ্টভাবে এসেছিল। কিন্তু কোর্ট সেটা আমলে নেননি। ওই আদেশ কোনো আইনগত ফোরাম না থাকায় চ্যালেঞ্জ করা যায়নি। তবে ভবিষ্যতে হয়তো এটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে বলে আমি মনে করি।
ডয়চে ভেলে: তাদের বাইরেও তো প্রসিকিউটর নিয়োগের সুযোগ ছিল। তারপরও তাদেরই কেন নিয়োগ দেওয়া হলো?
মাহবুব শফিক: এখানে কোনো পলিটিক্যাল উইল বা ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয়। এটা একাত্তরে যে ঘটনা ঘটেছে ,সেটির প্রতিশোধ হিসেবে চিন্তা করা হচ্ছে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্নও এসেছে এখন। সেটি হয়তোবা হতে পারে।
ডয়চে ভেলে: চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সাহেব বলেছেন, ‘এই বিচার কোনো প্রতিশোধের জন্য নয়, এটা হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা ও আগামী প্রজন্মকে একটি নিরাপদ বাংলাদেশ উপহার দেওয়া।’ এই বিচারের মধ্যে কী কোনো প্রতিশোধের বীজ আছে?
মাহবুব শফিক: আমার মনে হয় এখানে ‘নয়’ শব্দটি সার্কাস্টিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে এখানে ইনার মিনিংটা হলো অন্য। আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে আমার মনে হয়েছে, এটা একাত্তরকে মুছে ফেলার একটা চেষ্টার একটা স্টেপ বা প্রথম স্টেপ হিসেবে ধরতে পারি।
ডয়চে ভেলে: চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেছেন, ‘আমরা প্রমাণ করতে চাই একটি সভ্য সমাজ, যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকবে, সেখানে গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না। যে দেশে বিচার থাকবে, সেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না’—আইনের এই যে মহান বাক্যগুলো, তা এই ট্রাব্যুনালের মধ্য দিয়ে আপনি প্রতিষ্ঠার কতটা সুযোগ দেখছেন?
মাহবুব শফিক: আরেকটি বিষয় যা আমার আগেই বলা দরকার ছিল৷ এখানে একটু বলি। এই একই বিষয় নিয়ে কিন্তু পেনাল কোডেও মামলা চলছে। যাদের এখানে আসামি করা হয়েছে, তাদের কিন্তু পেনাল কোডেও মামলার আসামি করা হয়েছে। সেই মামলাগুলোও চলছে। সেখানেও তদন্ত হচ্ছে। রিপোর্ট দিচ্ছে। একই বিষয়ে দুটি জায়গায় মামলা চলতে পারে কি না? যদি সেটা চলে, আমাদের সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদে আছে ডাবল জিওপার্ডি। একই বিষয়ে একই লোককে বা একই ব্যক্তিকে দুবার ট্রায়াল করা যাবে না। সেটির কোনো ব্যত্যয় হচ্ছে কি না, সেটিও দেখার বিষয় আছে।
ডয়চে ভেলে: আবারও প্রশ্নটি করি, এই ট্রাবুন্যাল ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কতটা ভূমিকা রাখবে?
মাহবুব শফিক: যদি প্রতিশোধমূলক চিন্তা থেকে হয় বা আইনের শাসনের পূর্বশর্ত হলো আমাদের সংবিধানের যে বিধানগুলো আছে, সেগুলো সমুন্নত রাখা, সেগুলোকে সত্যিকার অর্থে প্রয়োগ করা। যদি একই ব্যক্তিকে নিয়ে দুটি জায়গায় একই বিষয় নিয়ে মামলা চালাতে উৎসাহিত করা হয়, তাহলে তাকে আমি আইনের পরিপন্থী বলে মনে করি।
ডয়চে ভেলে: সমন্বয়কেরা কেউ কেউ মেটিকিউলাস প্ল্যানের কথা বলছেন। আবার বলছেন এই মেট্রোরেলে হামলা না হলে আন্দোলন সফল হতো না। আবার ৫ আগস্টের পরেও অনেক ঘটনা ঘটেছে।
মাহবুব শফিক: খুবই ইন্টারেস্টিংলি শেখ হাসিনার মামলাটি ডাইরেক্টলি টিভিতে দেখানো হচ্ছে। সেখানে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল সাহেব ইন্টারেস্টিংলি ওখানে বারবার বলেছেন , মেট্রোরেলে আগুন দেওয়া, পুলিশ হত্যা বা ধ্বংসাত্মক যে কাজকর্ম, সেটি শেখ হাসিনাই করেছেন—এ রকম একটি উক্তি দিয়েছেন। যেখানে সমন্বয়কেরা কেউ কেউ বলেছেন, এটা যদি করা না হতো, তাহলে বিপ্লব সফল হতো না। এটা একেবারেই কন্ট্রাডিকটরি। এই কন্ট্রাডিকশন নিয়ে তাঁরা সামনে কীভাবে আগাবে, এটি আসলে সামনে বের হয়ে আসবে মেটিকিউলাস প্ল্যান বলতে তাঁরা কী বোঝাচ্ছেন। এটা একাত্তরের প্রতিশোধ ছিল কি না—এটা আসলে ভবিষ্যৎই বলবে। ইতিহাস এটাকে প্রকাশ করবে।
ডয়চে ভেলে: টবি ক্যাডম্যান তো ওই সময়ে জামায়াতের পরামর্শক ছিলেন। এখন তো চিফ প্রসিকিউটরের পরামর্শক নিযুক্ত হয়েছেন। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখেন?
মাহবুব শফিক: এটিও কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের আরেকটি উদাহরণ হলো। এটিও পার্ট অব আ মেটিকিউলাস প্ল্যান কি না, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
ডয়চে ভেলে: জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য কথা উঠেছিল। পরে এখানে সেটা নাকচ করে দেওয়া হলো। সেটার কারণ কী হতে পারে?
মাহবুব শফিক: ওইখানে বিচারের জন্য যদি যেত, তাহলে নিরপেক্ষভাবে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারতে। মেটিকিউলাস প্ল্যানের এভিডেন্সগুলো হয়তো আরও শক্তভাবে আসতে। সেই কারণে হয়তো উনারা সেটা নাকচ করেছেন।
ডয়চে ভেলে: দ্রুত বিচারের দাবি আছে। কিন্তু নিয়মিত আইনগত কোর্সের বাইরে গিয়ে দ্রত বিচার করলে তাতে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হবে, না নিশ্চিত হবে?
মাহবুব শফিক: আইনের কতগুলো বেসিক কথা আছে। জাস্টিস হারিড, জাস্টিস বারিড, জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড। কোনোটিই করা ঠিক নয়। সত্যিকার অর্থে আইনের প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করা হোক। বাদী, বিবাদী উভয়ই যৌক্তিক সময় পাক এবং সত্যটি বেরিয়ে আসুক ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক এবং সেটাই হওয়া উচিত।
ডয়চে ভেলে: শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একই সঙ্গে পাঁচটি অপরাধের অভিযোগে বিচার শুরু হয়েছে। তিনি হত্যার নির্দেশদাতা, গুলি ও হেলিকপ্টার থেকে গুলির নির্দেশদাতা আবার সরাসরি তিনটি হত্যাকাণ্ডেরও অভিযোগ আনা হয়েছে। এই অভিযোগগুলো আপনি কীভাবে দেখেন?
মাহবুব শফিক: আইসিটি আইনটা খুবই স্পেশাল ল। একেকটি কাউন্ট হিসেবে উনারা যদি এনে থাকেন, সেটা আইনের দৃষ্টিতে কতটা সঠিক হবে, সেটা তো যাচাই হবেই এখানে। এখানে ডিফেন্স লইয়ারেরা থাকবেন, বিচারকেরা আছেন, তাঁরা তো সেটা দেখবেন।
ডয়চে ভেলে: যাঁরা আটক হয়েছেন, তাঁদের আইনজীবীরা তো এখানে আছেন৷ শেখ হাসিনার সঙ্গে একই মামলার আসামি আছেন। তাঁরা কি চাপমুক্তভাবে কাজ করতে পারছেন?
মাহবুব শফিক: অনেক ক্ষেত্রে ডিফেন্স লইয়ারদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। পাওয়ার যদি কোর্টে দেখাতে পারে, তবেই অ্যালাও করা হচ্ছে।এইসব বিষয় কিন্তু আছে। এটা অনেকটা ওয়ান ইলেভেনের সময় যে ক্যাঙ্গারু কোর্ট ছিল, সেটাকে মনে করিয়ে দেয় আমাদের। যেখানে লইয়ারদের ঢুকতে বাধা দেওয়া হতো, প্রতিটি বই চেক করা হতো—এগুলো আছে।
ডয়চে ভেলে: ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচারপ্রক্রিয়া সরাসরি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হচ্ছে। কোনো বিচারপ্রক্রিয়া সরাসরি সম্প্রচার বাংলাদেশে এটাই প্রথম। এটা বিচারের স্বচ্ছতা কতটা নিশ্চিত করবে?
মাহবুব শফিক: পৃথিবীর কোনো দেশেই কিন্তু কোনো জুডিশিয়াল প্রসিডিং এভাবে ওপেনলি দেখানো হয় না। যেমন, অ্যামেরিকায় স্কেচ দিয়ে বোঝানো হয়। তারা কী বলেছে সেটাও প্রকাশ করা হয়। কিন্তু লাইভ টেলিকাস্ট পৃথিবীর কোনো দেশেই প্র্যাকটিস হিসেবে নেই। এতে আসলে কোর্ট, পাবলিক প্রভাবিত করার সম্ভাবনা থেকে যায় বা কিছুটা মিডিয়া ট্রায়ালেরও বিষয়টিও এখানে উঠে আসে। এটা সঠিক হলে সবার জন্যই করার দরকার ছিল। অন্যদের ক্ষেত্রে তাঁরা করছেন না। শেখ হাসিনার মামলাটির বেলায়ই তাঁরা করছেন। এটিও ডিসক্রিমিনেশন। এটা আইনগতভাবে জুডিশিয়ারিকে ইনফ্লুয়েন্স করার চেষ্টা বা পাবলিক ওপিনিয়ন নিয়ে সেটাকে ইনফ্লুয়েন্স করার চেষ্টা। এটা না করাই শ্রেয়।
‘বাংলাদেশের মানুষ যদি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ কিংবা অনুপাতভিত্তিক ভোটব্যবস্থা বুঝত! উল্টো তারা বলবে, আমরা এসব বুঝি না! আমি তোমাকে ভোট দেব, কয় টাকা দেবে? সহজ ভাষায় বললে বিষয়টি তা-ই—তুমি টাকা দাও, আমি ভোট দেব—দেশে ভোটের চর্চা এমনই।’
১ দিন আগেড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো এবং বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন বিষয়ে বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক।
১৬ দিন আগে২০২৪ সালে সংঘটিত ‘মনসুন রেভল্যুশন’-এর পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে নেতৃত্বশূন্যতা ও প্রশাসনিক অচলাবস্থা। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ আহমেদ মুশফিক মোবারক তুলে ধরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণ, আইনশৃঙ্খলা সংকট, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক কর্মসংস্থানের উদ্যোগসহ নানা...
১৮ মে ২০২৫বদরুদ্দীন উমর লেখক, গবেষক ও বামপন্থী রাজনীতিক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিপিই ডিগ্রি পান। দেশে ফিরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে
১৭ মে ২০২৫