অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাস পূর্ণ হচ্ছে ৮ ফেব্রুয়ারি। এ সময়ে দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা বলেছেন পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আজকের পত্রিকার বাণিজ্য সম্পাদক শাহ আলম খান।
শাহ আলম খান
আজকের পত্রিকা: অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: যখন সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল, তখন অর্থনীতি ভারসাম্য হারিয়ে ছিটকে পড়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল। আর্থিক খাত দেউলিয়াত্বের দিকে যাচ্ছিল, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তা ঘোষণা করা হয়নি। রিজার্ভ, মুদ্রাস্ফীতি, বিনিয়োগ, ব্যাংকিং খাত—সব ক্ষেত্রেই অনিশ্চয়তা ছিল। এখন আপনারা কী দেখছেন? আমরা সেই ভারসাম্যহীন অবস্থা থেকে ধাপে ধাপে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছি। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের মতো কিছু সূচক ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। ব্যাংক খাতকে দেউলিয়াত্বের শঙ্কা থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা গেছে এবং রিজার্ভ পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়নি। যদিও এখনো মানুষের মধ্যে আস্থার ঘাটতি আছে, কিন্তু আমরা স্থিতিশীলতার পথে এগোচ্ছি।
আজকের পত্রিকা: রিজার্ভ সংকট ও ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: রিজার্ভ সংকট সমাধানে আমরা দুই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি; আমদানির অপ্রয়োজনীয় খাতগুলোতে নিয়ন্ত্রণ এবং বৈদেশিক আয়ের উৎসগুলোকে চাঙা করা। রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে নীতিগত পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং রপ্তানি আয়েও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের ক্ষেত্রে, দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে এটি প্রায় ধসে পড়ার অবস্থায় ছিল। সরকার জরুরি ভিত্তিতে নীতি সংস্কার করেছে, তারল্যসংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিয়েছে এবং আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও সংকট পুরোপুরি কাটেনি, তবে আগের মতো চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানেও নেই।
আজকের পত্রিকা: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা টাকার অতিরিক্ত সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করেছি, আমদানি ব্যয় কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করছি। সরকারের বিভিন্ন নীতির ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হওয়ার প্রবণতা কমেছে। যদিও মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তবে পরিস্থিতি আর খারাপ হচ্ছে না; বরং ধাপে ধাপে উন্নতির দিকে যাচ্ছে।
আজকের পত্রিকা: অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার এই সংস্কার কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবে?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা যেমন বেড়েছে, তেমনি অন্তর্বর্তী সরকারও কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। বিভিন্ন খাতে সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের সুপারিশ মূল্যায়নের প্রক্রিয়া চলছে। এসব সুপারিশ যথেষ্ট বাস্তবসম্মত ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রাখার মতো। তবে সীমিত সময় ও ক্ষমতার পরিধির কারণে হয়তো অন্তর্বর্তী সরকার সবকিছু একসঙ্গে বাস্তবায়ন করতে পারবে না। তাই অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে ধাপে ধাপে কাজ করা হচ্ছে।
কিছু ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, অর্থ পাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর প্রচেষ্টা জোরদার হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে, যাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করে জরুরি খাতগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ানো যায়। বাজেটের কাঠামো পর্যালোচনা করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে।
তবে এই সংস্কারের সুফল রাতারাতি দৃশ্যমান হবে না। কিছু পরিবর্তন তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা না গেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করছে, যাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়।
আজকের পত্রিকা: কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও জনগণের মধ্যে এখনো আস্থা পুরোপুরি ফিরে আসেনি। সেটি কেন?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: এটি খুবই স্বাভাবিক। যখন কোনো অর্থনৈতিক খাত দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল অবস্থায় থাকে, তখন মানুষ দ্রুত আস্থা ফিরে পায় না। ব্যাংকিং খাতে আমরা স্থিতিশীলতা আনতে পেরেছি, তারল্যসংকটও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু মানুষের মনস্তাত্ত্বিক আস্থার জায়গাটি পুনরুদ্ধার করতে সময় লাগবে। বাজারের আস্থা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনতে হলে আরও কিছু সময় প্রয়োজন, তবে দিকনির্দেশনা ইতিবাচক।
আজকের পত্রিকা: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও মানুষের অসন্তোষ আছে। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক দুর্বলতা ও নিরাপত্তাব্যবস্থার ত্রুটি এক দিনে কাটিয়ে ওঠা যায় না। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নানা মহলে অসন্তোষ থাকলেও এটি দিন দিন আগের চেয়ে উন্নতির দিকে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বাহিনীকে আরও কার্যকর করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে পুরো কাঠামো পুনর্গঠনের প্রয়োজন আছে। সেটি হলে পরিস্থিতির আরও দৃশ্যমান উন্নতি হবে।
আজকের পত্রিকা: আপনি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ছিলেন। সেবারের অভিজ্ঞতা ও এবারের অভিজ্ঞতার মধ্যে কী পার্থক্য দেখছেন?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে অর্থনীতি কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর তিন মাস বন্ধ ছিল, যা সংকটের গভীরতা বোঝায়। সে সময় আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্রুত সচল করা এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন নিশ্চিত করা। সরকার সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে সমন্বিতভাবে কাজ করেছিল এবং আমি স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিলাম। আমাদের মূল মনোযোগ ছিল স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং জনগণের আস্থা অর্জন করা, যা কিছুটা হলেও সফলভাবে সম্ভব হয়েছিল।
কিন্তু এবারের বাস্তবতা ভিন্ন এবং অনেক বেশি জটিল। সংকট শুধু অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই, প্রশাসন, আর্থিক খাতসহ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার প্রায় সব স্তরেই অনিয়ম ও অদক্ষতা প্রবল হয়ে উঠেছে। নীতি ও শৃঙ্খলার অভাব স্পষ্ট, ফলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও জটিলতা দেখা দিচ্ছে। এর পাশাপাশি সব মহল থেকেই নানা দাবিদাওয়া আসছে, যার সব কিছু মানাও অসম্ভব, কিছু আবার উপেক্ষাও করা যাচ্ছে না। ফলে কেবল অর্থনীতিকে চাঙা করাই যথেষ্ট নয়, বরং সামগ্রিক প্রশাসনিক ও নীতিগত কাঠামোর গভীর সংস্কারও অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এখনকার চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি বহুমাত্রিক, তাই কৌশলগতভাবে আরও সুগভীর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া সামনে এগোনো কঠিন হবে।
আজকের পত্রিকা: সরকার কি দাবিদাওয়া মেটানোর চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: অবশ্যই। অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য টেকসই পরিবর্তনের ভিত গড়া। স্বল্প মেয়াদে যৌক্তিক কিছু দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া হলেও তা শুধু তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য। তবে সবকিছু মেনে নিলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। সরকার এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চায় না, যা ভবিষ্যতের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই মূল অগ্রাধিকার হচ্ছে কাঠামোগত সংস্কার, যা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনবে।
আজকের পত্রিকা: সরকার কি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে পারবে?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: এটি আমাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। তবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন মানে শুধু ভোটগ্রহণের দিনটি নয়; বরং সামগ্রিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবেশ এমন হতে হবে, যেখানে আস্থার সঙ্গে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে। আমরা সেই পরিবেশ তৈরির কাজ করছি, তবে রাজনৈতিক দলগুলোকেও গঠনমূলক ভূমিকা নিতে হবে। এককভাবে সরকারের পক্ষে সবকিছু সম্ভব নয়, তাই এই দায়িত্ব সবার।
আজকের পত্রিকা: সরকারের সামগ্রিক সাফল্য আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: সরকার প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে; যেখানে প্রশাসন, অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা সংকটের মধ্যে ছিল। আমরা অর্থনীতিকে ভারসাম্যহীন অবস্থা থেকে বের করে এনেছি, আর্থিক খাতকে স্থিতিশীল করেছি এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের চেষ্টা করছি। সবকিছু রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়, তবে সঠিক পথে এগোচ্ছি। অর্থনীতির সূচকগুলো এখন স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাঠামোগত পরিবর্তন চালু হয়েছে। এসবই সরকারের সফলতার প্রমাণ।
আজকের পত্রিকা: অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: যখন সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল, তখন অর্থনীতি ভারসাম্য হারিয়ে ছিটকে পড়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল। আর্থিক খাত দেউলিয়াত্বের দিকে যাচ্ছিল, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তা ঘোষণা করা হয়নি। রিজার্ভ, মুদ্রাস্ফীতি, বিনিয়োগ, ব্যাংকিং খাত—সব ক্ষেত্রেই অনিশ্চয়তা ছিল। এখন আপনারা কী দেখছেন? আমরা সেই ভারসাম্যহীন অবস্থা থেকে ধাপে ধাপে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছি। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সের মতো কিছু সূচক ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। ব্যাংক খাতকে দেউলিয়াত্বের শঙ্কা থেকে মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা গেছে এবং রিজার্ভ পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়নি। যদিও এখনো মানুষের মধ্যে আস্থার ঘাটতি আছে, কিন্তু আমরা স্থিতিশীলতার পথে এগোচ্ছি।
আজকের পত্রিকা: রিজার্ভ সংকট ও ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: রিজার্ভ সংকট সমাধানে আমরা দুই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি; আমদানির অপ্রয়োজনীয় খাতগুলোতে নিয়ন্ত্রণ এবং বৈদেশিক আয়ের উৎসগুলোকে চাঙা করা। রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়াতে নীতিগত পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং রপ্তানি আয়েও ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের ক্ষেত্রে, দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের কারণে এটি প্রায় ধসে পড়ার অবস্থায় ছিল। সরকার জরুরি ভিত্তিতে নীতি সংস্কার করেছে, তারল্যসংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিয়েছে এবং আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও সংকট পুরোপুরি কাটেনি, তবে আগের মতো চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানেও নেই।
আজকের পত্রিকা: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমরা টাকার অতিরিক্ত সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করেছি, আমদানি ব্যয় কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করছি। সরকারের বিভিন্ন নীতির ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হওয়ার প্রবণতা কমেছে। যদিও মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তবে পরিস্থিতি আর খারাপ হচ্ছে না; বরং ধাপে ধাপে উন্নতির দিকে যাচ্ছে।
আজকের পত্রিকা: অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার এই সংস্কার কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবে?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে আলোচনা যেমন বেড়েছে, তেমনি অন্তর্বর্তী সরকারও কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। বিভিন্ন খাতে সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের সুপারিশ মূল্যায়নের প্রক্রিয়া চলছে। এসব সুপারিশ যথেষ্ট বাস্তবসম্মত ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রাখার মতো। তবে সীমিত সময় ও ক্ষমতার পরিধির কারণে হয়তো অন্তর্বর্তী সরকার সবকিছু একসঙ্গে বাস্তবায়ন করতে পারবে না। তাই অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে ধাপে ধাপে কাজ করা হচ্ছে।
কিছু ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যাংকিং কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, অর্থ পাচার রোধ ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর প্রচেষ্টা জোরদার হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে, যাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় হ্রাস করে জরুরি খাতগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ানো যায়। বাজেটের কাঠামো পর্যালোচনা করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ পুনর্বিন্যাস করা হচ্ছে।
তবে এই সংস্কারের সুফল রাতারাতি দৃশ্যমান হবে না। কিছু পরিবর্তন তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা না গেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করছে, যাতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়।
আজকের পত্রিকা: কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও জনগণের মধ্যে এখনো আস্থা পুরোপুরি ফিরে আসেনি। সেটি কেন?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: এটি খুবই স্বাভাবিক। যখন কোনো অর্থনৈতিক খাত দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল অবস্থায় থাকে, তখন মানুষ দ্রুত আস্থা ফিরে পায় না। ব্যাংকিং খাতে আমরা স্থিতিশীলতা আনতে পেরেছি, তারল্যসংকটও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু মানুষের মনস্তাত্ত্বিক আস্থার জায়গাটি পুনরুদ্ধার করতে সময় লাগবে। বাজারের আস্থা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনতে হলে আরও কিছু সময় প্রয়োজন, তবে দিকনির্দেশনা ইতিবাচক।
আজকের পত্রিকা: আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও মানুষের অসন্তোষ আছে। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক দুর্বলতা ও নিরাপত্তাব্যবস্থার ত্রুটি এক দিনে কাটিয়ে ওঠা যায় না। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নানা মহলে অসন্তোষ থাকলেও এটি দিন দিন আগের চেয়ে উন্নতির দিকে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বাহিনীকে আরও কার্যকর করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে পুরো কাঠামো পুনর্গঠনের প্রয়োজন আছে। সেটি হলে পরিস্থিতির আরও দৃশ্যমান উন্নতি হবে।
আজকের পত্রিকা: আপনি ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ছিলেন। সেবারের অভিজ্ঞতা ও এবারের অভিজ্ঞতার মধ্যে কী পার্থক্য দেখছেন?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে অর্থনীতি কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর তিন মাস বন্ধ ছিল, যা সংকটের গভীরতা বোঝায়। সে সময় আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্রুত সচল করা এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন নিশ্চিত করা। সরকার সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে সমন্বিতভাবে কাজ করেছিল এবং আমি স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেয়েছিলাম। আমাদের মূল মনোযোগ ছিল স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং জনগণের আস্থা অর্জন করা, যা কিছুটা হলেও সফলভাবে সম্ভব হয়েছিল।
কিন্তু এবারের বাস্তবতা ভিন্ন এবং অনেক বেশি জটিল। সংকট শুধু অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই, প্রশাসন, আর্থিক খাতসহ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার প্রায় সব স্তরেই অনিয়ম ও অদক্ষতা প্রবল হয়ে উঠেছে। নীতি ও শৃঙ্খলার অভাব স্পষ্ট, ফলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও জটিলতা দেখা দিচ্ছে। এর পাশাপাশি সব মহল থেকেই নানা দাবিদাওয়া আসছে, যার সব কিছু মানাও অসম্ভব, কিছু আবার উপেক্ষাও করা যাচ্ছে না। ফলে কেবল অর্থনীতিকে চাঙা করাই যথেষ্ট নয়, বরং সামগ্রিক প্রশাসনিক ও নীতিগত কাঠামোর গভীর সংস্কারও অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এখনকার চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি বহুমাত্রিক, তাই কৌশলগতভাবে আরও সুগভীর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া সামনে এগোনো কঠিন হবে।
আজকের পত্রিকা: সরকার কি দাবিদাওয়া মেটানোর চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: অবশ্যই। অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য টেকসই পরিবর্তনের ভিত গড়া। স্বল্প মেয়াদে যৌক্তিক কিছু দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া হলেও তা শুধু তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য। তবে সবকিছু মেনে নিলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। সরকার এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চায় না, যা ভবিষ্যতের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই মূল অগ্রাধিকার হচ্ছে কাঠামোগত সংস্কার, যা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনবে।
আজকের পত্রিকা: সরকার কি একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে পারবে?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: এটি আমাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। তবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন মানে শুধু ভোটগ্রহণের দিনটি নয়; বরং সামগ্রিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবেশ এমন হতে হবে, যেখানে আস্থার সঙ্গে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে। আমরা সেই পরিবেশ তৈরির কাজ করছি, তবে রাজনৈতিক দলগুলোকেও গঠনমূলক ভূমিকা নিতে হবে। এককভাবে সরকারের পক্ষে সবকিছু সম্ভব নয়, তাই এই দায়িত্ব সবার।
আজকের পত্রিকা: সরকারের সামগ্রিক সাফল্য আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: সরকার প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছে; যেখানে প্রশাসন, অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা সংকটের মধ্যে ছিল। আমরা অর্থনীতিকে ভারসাম্যহীন অবস্থা থেকে বের করে এনেছি, আর্থিক খাতকে স্থিতিশীল করেছি এবং প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের চেষ্টা করছি। সবকিছু রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়, তবে সঠিক পথে এগোচ্ছি। অর্থনীতির সূচকগুলো এখন স্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাঠামোগত পরিবর্তন চালু হয়েছে। এসবই সরকারের সফলতার প্রমাণ।
সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ে ধারণ করা জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র একটি পর্বে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সাক্ষাৎকারে তাঁর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত অংশ আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫সংস্কারের জন্য অনেকগুলো কমিশন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। আজ বুধবার প্রতিবেদন দিচ্ছে তারা। কমিশনের কাজ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন...
১৫ জানুয়ারি ২০২৫প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, সংস্কার ও বছরের শেষ নাগাদ বা আগামী বছরের প্রথমার্ধে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ার কোনো ঘাটতি নেই। গত ২৯ ডিসেম্বর (২০২৪) ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেন তিনি। ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় বাং
০৭ জানুয়ারি ২০২৫নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আন্তসীমান্ত জ্বালানি বাণিজ্য সবার জন্যই লাভজনক হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেছেন, দেশগুলোর মধ্যে জ্বালানি বিনিময় আরও গতিশীল হলেই বাজার পরিপক্ব হবে। তখন সবার জন্যই লাভজনক...
০২ জানুয়ারি ২০২৫