ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো এবং বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়ন বিষয়ে বেসরকারি উদ্যোগে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের ‘শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিনিয়োগের বর্তমান অবস্থা, সংস্কারসহ নানা বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিভুরঞ্জন সরকার ও মাসুদ রানার সঙ্গে।
বিভুরঞ্জন সরকার
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বর্তমান সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন আমরা কয়েকটি বড় সমস্যা চিহ্নিত করেছিলাম। যেমন বিগত সরকার উন্নয়নের যে বয়ান তৈরি করেছিল, সেখানে অনেক ধরনের সমস্যা ছিল। সেই অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল। তথ্য-উপাত্তের মধ্যে নানা ধরনের অসংগতি ছিল, একই সঙ্গে মেগা প্রকল্প নিয়ে অতি মূল্যায়ন ও প্রচার ছিল। বিগত সরকারের পক্ষ থেকে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে চাঙা করতে না পারার একটা ব্যাপার ছিল। একই সঙ্গে কর আদায় করতে না পারা, মানবসম্পদ উন্নয়নে যথেষ্ট বরাদ্দ না দেওয়া। এ ছাড়া আরও অনেক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা ছিল।
আমরা তো প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশক্রমে শ্বেতপত্র করলাম। এটা দিয়ে উত্তরাধিকারের ভিত্তিভূমিটা পরিষ্কার হলো। এরপর এই সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ দাঁড়াল—অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার মধ্যে নিয়ে আসা। দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি ক্রমে বাড়ছিল, টাকার দাম দুর্বল হচ্ছিল এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাচ্ছিল। বৈদেশিক মুদ্রা যথেষ্ট না থাকার কারণে ঋণ পরিশোধ করা যাচ্ছিল না। আমদানির জন্য এলসি খোলা যাচ্ছিল না। তার প্রভাব জ্বালানিসহ অন্যান্য সেক্টরেও পড়েছিল। সেই জায়গায় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা একটা বড় ব্যাপার ছিল। সে ক্ষেত্রে সরকার ৮-৯ মাসে কিছুটা অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছে। এখন টাকার মূল্যমানে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো থাকা এবং রপ্তানি চালু থাকার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।
তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে কাঠামোগত কিছু সংস্কার করা না গেলে অর্থনীতিকে যেভাবে সচল, দক্ষ ও প্রতিযোগিতার মধ্যে দেখতে চাই, সেভাবে এটি করা সম্ভব না। ব্যাংকিং খাত ও আর্থিক খাতের অন্যান্য দিক, যেমন কর আহরণ ও অর্থায়ন এবং দক্ষভাবে সরকারিভাবে উন্নয়ন নীতি পরিচালনা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে জ্বালানি খাত এবং অতি মূল্যায়িত সরকারি প্রকল্পগুলোতে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে এবং এগুলোকে যৌক্তিকভাবে তৈরি করা যায়—এগুলো একটা সংস্কারের ব্যাপার ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাচার হওয়া অর্থ কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এবং সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুনভাবে নেতৃত্ব কীভাবে তৈরি করা যায়। সরকার কিছু বিষয়ে অগ্রগতি করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ও দক্ষভাবে তা প্রতিভাত হয়নি।
এই মুহূর্তে অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে টেকসই করা এবং বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির হারকে বেগবান করা দরকার। বিদেশি বিনিয়োগ তথা ব্যক্তি খাতে মোট বিনিয়োগ আগামী বছর বাজেটে গুরুত্ব পাবে আশা করি। এর ভেতর দিয়ে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যবিমোচনকে গভীর করতে বাজেটকে ভূমিকা রাখতে হবে।
বিদেশি বিনিয়োগ তেমন আসছে না। এর মূল কারণ কী?
বিনিয়োগের পতনের বিষয়টি নতুন না। বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যক্তি বিনিয়োগ ও জাতীয় আয় আনুমানিক ২৩ শতাংশে আটকে ছিল। তাই বিনিয়োগের স্থবিরতার বিষয়টি হলো দেড় দশকের আলোচনার বিষয়। বিষয়টি হলো, আমরা বিনিয়োগের ধারাটিকে কীভাবে ঊর্ধ্বমুখী করতে পারি? সমস্যাটা হলো, আমাদের মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। ফলে আইএমএফসহ অন্য ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, অর্থনীতির সংকোচনের মধ্যে পড়লে, সেখানে অর্থের প্রবাহ কমাতে পারলে মূল্যস্ফীতি কমে যায়। এটা কমানোর একটা জায়গা হলো, ব্যক্তি খাতে ঋণ দেওয়া কমানো। অর্থাৎ, সুদের হার এমন করতে হবে যে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করলে লাভ করতে পারবে না। এখানে সেটাই হয়েছে। সুদের হার এমন জায়গায় গেছে, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা টাকা ধার করে লাভজনক থাকতে পারছেন না।
এখন যদি মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমে আসে এবং টাকার মূল্যমান যদি স্থিতিশীল থাকে, তাহলে আশা করা যায়, সুদের হার কমবে এবং বিনিয়োগের হার বাড়বে। কিন্তু বিনিয়োগ পরিস্থিতি আরও উন্নতি করার জন্য প্রাসঙ্গিক আইনি এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকে যথেষ্ট দক্ষ করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে সেবা প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণমান বৃদ্ধি করার, তবে অগ্রগতি খুব সামান্য (আইনশৃঙ্খলাসহ)। কিন্তু যে ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক পরিস্থিতির মধ্যে থাকে, তাতে কিছুটা চাপ কমানো যায়।
একদিকে হলো গ্রহণযোগ্য সুদে অর্থ পাওয়ার ব্যাপার, অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাওয়ার একটা বড় সমস্যা আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জ্বালানি সংকটটা একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। এলএনজি নিয়ে এসে সেটা কীভাবে পূরণ করা যায়, এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী দিনে সেটা কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, সেটা আমরা বুঝতে চাই। বিশ্ববাজারে এখন গ্যাসের দাম কমছে, তাই দ্রুততার সঙ্গে এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আমদানি করে জ্বালানি সমস্যা সমাধান করা হোক। দেশের ভেতরও গ্যাস অনুসন্ধান অব্যাহত রাখতে হবে।
আর একটা বিষয় হচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ। ন্যূনতম মজুরি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নিয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এবং মজুরির বাইরে তাঁদের ন্যায্য যে পাওনাগুলো আছে, যেমন সামাজিক সুরক্ষা, তা তাঁদের দিতে হবে। এসব হলো আধুনিক শিল্প সম্পর্কের অনুষঙ্গ। শুধু দেশের মধ্যে না, বিদেশে পণ্য রপ্তানি করার জন্য এসব মানবিক ব্যাপারগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু এগুলো নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে।
বর্তমান সরকারের কোনো মধ্যমেয়াদি কাঠামো নেই। ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা মধ্যমেয়াদি ভাবনা নিয়ে ওয়াকিবহাল না। এ সরকার যদি আগামী এক বছর পর না থাকে এবং নতুন সরকার যদি আসে তাহলে এখনকার নিয়মনীতির ধারাবাহিকতা থাকবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। এটাও একধরনের অসুবিধার সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একে ঘনীভূত করতে পারে।
আবার বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি না হওয়ার কারণে অর্থনীতির রোডম্যাপেও অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে ব্যক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।
আপনি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের পক্ষে কথা বলে আসছেন। এখন কোন সংস্কার সবচেয়ে জরুরি?
বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সংস্কার-সম্পর্কিত কমিটি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে তৈরি করা হয়েছে, সেটার সংখ্যা ১৫-এর মতো। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশনের হাতে আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য সরকার
কোনো কমিশন গঠন করেনি। শ্বেতপত্র কমিটিতে আমরা অতীতের অবস্থার ব্যবচ্ছেদ করেছি মাত্র। আর একটা টাস্কফোর্স করা হয়েছিল, সেটা কিছু কিছু পরিস্থিতি নিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে বড় কাজ হচ্ছে। জ্বালানি খাত নিয়েও একটা বড় ধরনের কাজ হচ্ছে। অর্থনীতির কাজের পরিপূরক হিসেবে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ব্যাপার আছে। যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্থানীয় সরকারের বিষয়। এর বাইরে অন্যান্য উপরিকাঠামোর পরিবর্তন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, সেসব প্রাসঙ্গিক নয়। অর্থনীতির ভিত ঠিক রাখার জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো ঠিক আছে কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সেই জায়গায় আমি বড় ধরনের পরিবর্তন প্রত্যাশা করি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সামনে জাতীয় বাজেট পেশ হবে। জাতীয় বাজেটের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আমার প্রত্যাশা ছিল—যথাযথভাবে কর ব্যবস্থাপনা করা হবে। আমাদের দেশ পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যক্ষ কর যাঁরা
দেন, তাঁদের আরও করের বোঝা চাপানো হয়। এ জন্য আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, এবার প্রত্যক্ষ করকে বিস্তৃত করার জন্য যাঁদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে, কিন্তু দেন না এবং তাঁরা টাকা কীভাবে নিয়ে যান। এঁদের চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। আবার রাজস্ব ব্যয় যেমন ভাতা, বেতন, ভর্তুকি ও সুদ দিতেই ৯০ শতাংশের বেশি ব্যয় হয়ে যায়। সেখান থেকে কোনো উদ্বৃত্ত উন্নয়ন ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় না। আমার প্রত্যাশা ছিল, রাজস্ব ব্যয় এমনভাবে দাঁড় করানো হবে, যেন উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য কোনো ঋণ গ্রহণ করতে না হয়।
বিগত সরকারের মেগা প্রকল্প নিয়ে এত সমালোচনার পর ঝেড়ে-মুছে ফেলে দেওয়া হলো কি না বা নতুন প্রকল্প কোন মাপকাঠিতে গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে স্বচ্ছতা ও পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। একইভাবে ঘাটতি বাজেট আমরা বিদেশের টাকার ওপর নির্ভরশীল হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে অথবা সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঘাটতি মিটিয়ে থাকি। ঘাটতি বাজেটের অর্থ জোগাড় করতে কী ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করা হবে, সেটা আমরা জানতে চেয়েছি। কিন্তু আমাদের জানা-বোঝার আকাঙ্ক্ষাটা অর্থনীতি-সম্পর্কিত হলেও, তার কোনো খবর আমরা এখন পর্যন্ত জানি না।
আবার অনেক লোকসানি সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন চিনি ও পাটকল আছে, এসবকে কীভাবে পরিবর্তনের মধ্যে আনা হবে—আমরা জানতে চেয়েছি। এরপর গার্মেন্টসের পরে যেসব শিল্প আছে, তা নিয়ে নাটকীয় কী পরিবর্তন করা হবে, এসব বোঝার ব্যাপার ছিল। আবার গ্রামীণ দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষার জন্য যেসব ভাতা চালু ছিল—তাদের নিয়ে কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে এবং সেগুলো সঠিকভাবে প্রাপ্ত লোকের কাছে পৌঁছাবে কি না, জবাবদিহি কীভাবে করা হবে। কিন্তু এসব নিয়ে কোনো ভাবনা চোখে পড়ছে না।
আমরা বারবার বলেছি, মানুষ যদি ঠিকভাবে খেতে-পরতে না পারে এবং স্বস্তিতে না থাকে, কর্মসংস্থান না হয়—এই ছাত্র-যুবকেরা যে আন্দোলন করল চাকরির জন্য কোটার বিরুদ্ধে, সেই শোভন কর্মসংস্থান যদি না হয়, তাহলে যতই সংবিধান সংস্কারের কথা বলা হোক, কোনো কিছুতেই স্বস্তি আসবে না।
বন্দর ব্যবস্থাপনা ও মানবিক করিডর নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আপনি কী বলবেন?
এই দুটি বিষয়ের একটিতেও আমার কোনো বিশেষ জ্ঞান নেই। তবে আমি সাধারণভাবে বুঝি, এইসব বিষয়ে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের স্বার্থকে দেখে, জাতীয় সক্ষমতা, নিরাপত্তা এবং পরিবর্তনশীল ভূকৌশল অবস্থানকে বিবেচনায় রেখে সম্পূর্ণভাবে জনগণের মতামত নিয়ে এসব করা উচিত। এ জন্য মুক্ত আলোচনা এবং জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে করা হলে সেটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই—তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
এটা তো পরিষ্কার সাড়ে ১৫ বছর ধরে যে সরকারটি ছিল, তাদের প্রতি ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। তাদের যদি সেই সমর্থন না থাকত, তাহলে তারা যেসব দুরাচার করেছে, সে মাত্রায় করতে পারত না। কিন্তু ভারত কোনো দায়দায়িত্ব নেয়নি। তারা যে বিবেচনা থেকে কাজটি করেছিল, সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং সেটা যে ব্যর্থ হয়েছে, সেটা তারা এখনো স্বীকার করে নিচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক সঠিক ও সুস্থ রাখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি নিজেই এর সাক্ষী। সেপ্টেম্বর মাসে প্রধান উপদেষ্টা যখন জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে গেলেন, তখন এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সভা হয়েছে। সেই সভা আমি দেখেছি। সেই সভা কিন্তু আমাদের আগ্রহের কারণে সম্ভব হয়েছিল, যাতে করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা জায়গামতো ফিরে আসে। এই সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ঢাকায় সফর করেছিলেন। এটাও একটা অগ্রগতি ছিল। সেই সময়ে আমরা চেয়েছি উচ্চপর্যায়ের একটা মিটিং হোক। আবার আমাদের আগ্রহের কারণেই বিমসটেক সম্মেলনের পাশেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ হয়েছিল। এই ঘটনাগুলোকে আমি দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে নির্মাণের ব্যাপার হিসেবে দেখি।
তারপরে প্রতাশ্যার পরে যে ঘটনাগুলো ঘটল এবং অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হলো, সেটা আমার চিন্তার মধ্যে ছিল না। আমরা স্থলপথে সুতা আনা বন্ধ করে দিলাম। তারা ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করে দিল আমাদের তৃতীয় দেশে যাওয়ার। কিছুদিন আগে আমরা জাহাজনির্মাণ চুক্তি বাতিল করলাম। এ ধরনের রেষারেষি দুই দেশের জন্যই ভালো হবে না। বাংলাদেশ ভারতকে যেমন সমুদ্রে ফেলে দিতে পারবে না, আমরাও ভারতকে হিমালয়ে পাঠিয়ে দিতে পারব না। সুতরাং দুই দেশের সম্পর্ককে সুস্থ রাজনীতি ও পারস্পরিক সম্মানের ওপর গড়ে তোলার ব্যাপার। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত যদি মনে করে এ সরকারের সঙ্গে কোনো কার্যক্রম করবে না, তাহলে সেটা বিবেচনাপ্রসূত হবে না।
আবার বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী যদি যেকোনো ঘটনাবলিকে ভারতের ওপর দায় দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চায়, সেটাও উপকারী হবে না। আমার কাছে মনে হয়, বিজ্ঞ, বিবেচনাপ্রসূত দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাধারা ও উভয়ের মৌল স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমাদের এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতির খেলায় পরিণত হচ্ছে। চীন, আমেরিকা, রাশিয়া ও ভারতের একেক দেশের একেক রকম স্বার্থ। আমরা কি আসলেই স্বার্থের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি। আপনি কী মনে করেন?
আমরা এখনো অন্যের স্বার্থের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি না। তবে কোন কোন দেশের এই ভূ-রাজনীতির খেলা নিয়ে আগ্রহ জন্মাচ্ছে, সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। দুটির একটিও আমাদের জন্য উপকারী হবে না। আমাদের খেলার ভিকটিম হওয়ার জন্য এবং প্লেয়ার হওয়ার জন্য উচ্চাশা করা ঠিক হবে না। জ্ঞানোচিত, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রেখে অগ্রসর হওয়া উচিত। এটা চটজলদির বিষয় না। এটাকে মধ্য মেয়াদে দেখা উচিত।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের কাছে দ্বিপক্ষীয় ঐকমত্যের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোনো একক পক্ষের বিষয় না। অন্য কাউকে ছোট বা বড় করার ব্যাপার না। এটার জন্য আমাদের জাতীয় স্বার্থের জায়গা থেকে দুই পক্ষের ঐকমত্য লাগবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক মানের মানুষ। আমরা কি তাঁর এই ৯ মাসের শাসনামলে ইউনূস ম্যাজিক দেখতে পেলাম?
তিনি ম্যাজিক দেখাতে পারবেন কি না, সেটা আমি জানি না। তবে তাঁকে তো ম্যাজিশিয়ান মনে করেই জাতি নিয়ে এসেছিল। ছোট বা বড় ম্যাজিক থাকে। অনেক সময় দর্শকেরা ম্যাজিকের কলকবজা ধরেও ফেলতে পারে। সেই অর্থে দেশে কিন্তু অনেক কিছু ঘটছে। অর্থনীতি একটা খাত থেকে বের হয়ে এসেছে। বাংলাদেশ একটা বড় ধরনের সিভিল আনরেস্ট থেকে বের হতে পেরেছে। বৈদেশিক সম্পর্কগুলোকে আমরা স্বাভাবিক করতে পেরেছি। সুতরাং এই ৯ মাসে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ও ব্যক্তিত্বে একটা নতুন উচ্চ রেখায় আমরা পৌঁছেছি। কিন্তু এটা তো বিবর্তনশীল একটা উত্তরণকালীন সময়।
যেকোনো দেশের ক্ষেত্রে একটা উত্তর এবং পূর্ব পর্ব থাকে। উত্তর ও পূর্ব কালের মাঝখানে একটা কালপর্ব থাকে। কালপর্বের মধ্যে ধ্বংস ও সৃষ্টিও থাকে। এ জন্য এটা একটা উত্তরণকালীন সময়ও বটে। এ সময়েই মানুষের মাঝে জমে থাকা সব ধরনের ক্লেদ, ঘৃণা, ব্যর্থতা ও হতাশা বেরিয়ে আসে। সবচেয়ে কলুষ মনের প্রকাশ ঘটে। এটা আমাদের নারী, বিপন্ন ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর প্রতি এবং সংখ্যালঘু জনগণের প্রতি আমরা আমাদের হিংসা ও বিদ্বেষ ধাবিত করি। আবার তাদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরাও সংঘবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। এ রকম একটা সময়ের ভেতরে আমরা এখন অবস্থান করছি। এ সময়ে আমাদের সবচেয়ে কলুষ জিনিসটা প্রকাশ পাচ্ছে, একই রকমভাবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে অখণ্ড মানবিকতার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। দুর্বলভাবে হলেও সেটা প্রকাশ্যে আসছে। এটার মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে চলছে।
ইউনূস ম্যাজিকের বাতাবরণ আমাদেরকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষায় আছি।
মব জাস্টিস নিয়ে কী বলবেন?
যে কালপর্ব চলছে, সেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠীর কলুষ দিকটি বের হয়ে আসে, সংঘবদ্ধভাবে তারা মানুষের ওপর অত্যাচার করার চেষ্টা করে। সেটিকে মব জাস্টিস বলা হচ্ছে। মব কীভাবে বিচারের মধ্যে পড়ে, সেটা আমার জানা নেই। দেখা যাচ্ছে, এই মবের মাধ্যমে সবচেয়ে বিপন্ন মানুষগুলোর ওপর আক্রমণ হচ্ছে। সে কারণে বর্তমান সরকারের মনোযোগের জায়গাটা শুরু হয়েছিল সংস্কার নিয়ে, তারপর সেই সংস্কার থেকে সরে গিয়ে কোনো কোনো দল নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু নাগরিক অধিকার, নাগরিক নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বেশি নিমজ্জিত থাকতে হচ্ছে এখন। স্বল্পসংখ্যক মানুষ যে সংঘবদ্ধভাবে পুরো সমাজকে বিপন্ন করে দিতে পারে এবং একটা রাষ্ট্রকে অসহায় করে দিতে পারে, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখান থেকে আমাদের বড় শিক্ষা নেওয়ার ব্যাপার আছে। কীভাবে নাগরিকেরা এটাকে প্রতিরোধ করবে, সেটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে। শ্রীলঙ্কায় আমাদের মতো অভ্যুত্থান হয়েছে।
কিন্তু আমরা কেন তাদের মতো করে ঘুরে দাঁড়াতে পারছি না?
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে পার্থক্যটা হলো, সেখানে আমাদের মতো গণ-অভ্যুত্থান হয়ে রাজনৈতিক সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু তাদের যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল, সেগুলো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি টেকসই এবং অনেক বেশি পেশাদার ছিল। সেগুলো অনেক বেশি অরাজনৈতিকভাবে কাজ করত। ১৫-২০ বছর বা আরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন বিচারব্যবস্থা, আইন সভা, নির্বাহী বিভাগ এবং নজরদারি করার জন্য কমিশনগুলো শ্রীলঙ্কায় অনেক বেশি পেশাদারত্ব ও অরাজনৈতিকভাবে কাজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে দুঃখজনকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে দলীয় প্রভাব তৈরি করে।
সে জন্য শ্রীলঙ্কা যত তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, বাংলাদেশ সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। শুধু শ্রীলঙ্কা কেন, নেপালে একটা মাওবাদী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে। কিন্তু কখনো শুনেছেন নেপালে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে কোনো দল বিতর্কে জড়িয়েছে। তাদের নির্বাচন কমিশন কিন্তু ঠিকভাবে কাজ করেছে। এসব দেশ থেকে কিন্তু বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।
আপনি কি এই সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখতে পান?
এই মুহূর্তে সরকারের ভেতরে শুধু (অর্থনীতির বিষয়ে বলতে চাই) সমন্বয়হীনতার চেয়েও বেশি দেখি সহযোগিতার অভাব। এটা হলো একটা অনির্বাচিত সরকার, সীমিত ম্যান্ডেটের সরকার এবং নির্দিষ্ট সময়ের সরকার। সরকারের সবার সঙ্গে সহযোগিতা নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু সেটা আমি এখনো দেখিনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেটা করলেও তাঁর সহযোগীরা সেটা করেন না। তাঁদের পক্ষপাতও আমি অনেক সময় দেখতে পাই। তাঁরা টিম হিসেবেও কাজ করেন না। তাঁরা আসলে নিজেরা নিজেদের মতো করে কাজ করেন। তাঁদের নিজেদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই এবং সে কারণে সংস্কারের পরম্পরাও দেখা যাচ্ছে না।
সবশেষ হলো স্বচ্ছতা। তাঁরা যেসব কাজ করেন, সেটাও ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। আমি অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে বলতে চাই, অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে উন্নতিটুকু হলো, সেটার ক্রেডিটও তাঁরা নিতে পারেন না কৌশলগত যোগাযোগের অভাবে। আমাদের অর্থনীতির বিষয়ে জানতে হলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব যদি অর্থনীতি নিয়ে ব্রিফ করেন, তখন জানতে পারি। মানে অর্থ উপদেষ্টা সেভাবে জানাতে পারেন না। এসব ঘটে সহযোগিতার অভাবের কারণে। সহযোগিতা, সমন্বয়হীনতা, স্বচ্ছতার অভাব দেখছি। একই সঙ্গে সদিচ্ছার অভাবও দেখছি।
এ সরকার সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
এই সরকার সম্পর্কে জনগণের যে প্রত্যাশা, সেটা যেন হতাশায় পরিণত না হয়। আমরা সেই প্রত্যাশার প্রতি অনুগত থাকতে চাই।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল একটা কাঠামোগত সংস্কারের জন্য। সেই কাঠামোগত সংস্কারের সুযোগটা এই দুর্যোগের মধ্যে এসেছিল। সেই সুযোগটা তারা যেন নষ্ট না করে। এখন পর্যন্ত সেই জায়গায় কোনো অগ্রগতি দেখছি না। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে বলব, একটা সঠিক নির্বাচনই হলো এই সংকট থেকে উত্তরণের চাবিকাঠি। তাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক সঠিক নির্বাচন (আসন ভাগাভাগির নির্বাচন না)—এ রকম একটা নির্বাচন দেখার জন্য দেশবাসী অপেক্ষায় আছে।
সবকিছু মিলিয়ে কী মনে করেন, সেই ধরনের একটি নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
বাংলার মানুষ সব সময় আমাদের চমকিত করেছে। আশা করি, এবারও করবে। আমি ভরসা রাখি মানুষের ওপরে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাদেরও ধন্যবাদ।
দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
বর্তমান সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন আমরা কয়েকটি বড় সমস্যা চিহ্নিত করেছিলাম। যেমন বিগত সরকার উন্নয়নের যে বয়ান তৈরি করেছিল, সেখানে অনেক ধরনের সমস্যা ছিল। সেই অর্থনৈতিক উত্তরাধিকার নিয়ে বর্তমান সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল। তথ্য-উপাত্তের মধ্যে নানা ধরনের অসংগতি ছিল, একই সঙ্গে মেগা প্রকল্প নিয়ে অতি মূল্যায়ন ও প্রচার ছিল। বিগত সরকারের পক্ষ থেকে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকে চাঙা করতে না পারার একটা ব্যাপার ছিল। একই সঙ্গে কর আদায় করতে না পারা, মানবসম্পদ উন্নয়নে যথেষ্ট বরাদ্দ না দেওয়া। এ ছাড়া আরও অনেক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা ছিল।
আমরা তো প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশক্রমে শ্বেতপত্র করলাম। এটা দিয়ে উত্তরাধিকারের ভিত্তিভূমিটা পরিষ্কার হলো। এরপর এই সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ দাঁড়াল—অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার মধ্যে নিয়ে আসা। দ্রব্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি ক্রমে বাড়ছিল, টাকার দাম দুর্বল হচ্ছিল এবং বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাচ্ছিল। বৈদেশিক মুদ্রা যথেষ্ট না থাকার কারণে ঋণ পরিশোধ করা যাচ্ছিল না। আমদানির জন্য এলসি খোলা যাচ্ছিল না। তার প্রভাব জ্বালানিসহ অন্যান্য সেক্টরেও পড়েছিল। সেই জায়গায় অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা একটা বড় ব্যাপার ছিল। সে ক্ষেত্রে সরকার ৮-৯ মাসে কিছুটা অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছে। এখন টাকার মূল্যমানে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো থাকা এবং রপ্তানি চালু থাকার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।
তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে কাঠামোগত কিছু সংস্কার করা না গেলে অর্থনীতিকে যেভাবে সচল, দক্ষ ও প্রতিযোগিতার মধ্যে দেখতে চাই, সেভাবে এটি করা সম্ভব না। ব্যাংকিং খাত ও আর্থিক খাতের অন্যান্য দিক, যেমন কর আহরণ ও অর্থায়ন এবং দক্ষভাবে সরকারিভাবে উন্নয়ন নীতি পরিচালনা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে জ্বালানি খাত এবং অতি মূল্যায়িত সরকারি প্রকল্পগুলোতে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে এবং এগুলোকে যৌক্তিকভাবে তৈরি করা যায়—এগুলো একটা সংস্কারের ব্যাপার ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পাচার হওয়া অর্থ কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় এবং সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুনভাবে নেতৃত্ব কীভাবে তৈরি করা যায়। সরকার কিছু বিষয়ে অগ্রগতি করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ও দক্ষভাবে তা প্রতিভাত হয়নি।
এই মুহূর্তে অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে টেকসই করা এবং বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির হারকে বেগবান করা দরকার। বিদেশি বিনিয়োগ তথা ব্যক্তি খাতে মোট বিনিয়োগ আগামী বছর বাজেটে গুরুত্ব পাবে আশা করি। এর ভেতর দিয়ে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যবিমোচনকে গভীর করতে বাজেটকে ভূমিকা রাখতে হবে।
বিদেশি বিনিয়োগ তেমন আসছে না। এর মূল কারণ কী?
বিনিয়োগের পতনের বিষয়টি নতুন না। বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যক্তি বিনিয়োগ ও জাতীয় আয় আনুমানিক ২৩ শতাংশে আটকে ছিল। তাই বিনিয়োগের স্থবিরতার বিষয়টি হলো দেড় দশকের আলোচনার বিষয়। বিষয়টি হলো, আমরা বিনিয়োগের ধারাটিকে কীভাবে ঊর্ধ্বমুখী করতে পারি? সমস্যাটা হলো, আমাদের মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল। ফলে আইএমএফসহ অন্য ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন, অর্থনীতির সংকোচনের মধ্যে পড়লে, সেখানে অর্থের প্রবাহ কমাতে পারলে মূল্যস্ফীতি কমে যায়। এটা কমানোর একটা জায়গা হলো, ব্যক্তি খাতে ঋণ দেওয়া কমানো। অর্থাৎ, সুদের হার এমন করতে হবে যে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করলে লাভ করতে পারবে না। এখানে সেটাই হয়েছে। সুদের হার এমন জায়গায় গেছে, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা টাকা ধার করে লাভজনক থাকতে পারছেন না।
এখন যদি মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমে আসে এবং টাকার মূল্যমান যদি স্থিতিশীল থাকে, তাহলে আশা করা যায়, সুদের হার কমবে এবং বিনিয়োগের হার বাড়বে। কিন্তু বিনিয়োগ পরিস্থিতি আরও উন্নতি করার জন্য প্রাসঙ্গিক আইনি এবং নিয়ন্ত্রণ কাঠামোকে যথেষ্ট দক্ষ করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে সেবা প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণমান বৃদ্ধি করার, তবে অগ্রগতি খুব সামান্য (আইনশৃঙ্খলাসহ)। কিন্তু যে ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক পরিস্থিতির মধ্যে থাকে, তাতে কিছুটা চাপ কমানো যায়।
একদিকে হলো গ্রহণযোগ্য সুদে অর্থ পাওয়ার ব্যাপার, অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাওয়ার একটা বড় সমস্যা আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জ্বালানি সংকটটা একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। এলএনজি নিয়ে এসে সেটা কীভাবে পূরণ করা যায়, এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী দিনে সেটা কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, সেটা আমরা বুঝতে চাই। বিশ্ববাজারে এখন গ্যাসের দাম কমছে, তাই দ্রুততার সঙ্গে এবং দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে এলএনজি আমদানি করে জ্বালানি সমস্যা সমাধান করা হোক। দেশের ভেতরও গ্যাস অনুসন্ধান অব্যাহত রাখতে হবে।
আর একটা বিষয় হচ্ছে শ্রমিক অসন্তোষ। ন্যূনতম মজুরি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ নিয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়া, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এবং মজুরির বাইরে তাঁদের ন্যায্য যে পাওনাগুলো আছে, যেমন সামাজিক সুরক্ষা, তা তাঁদের দিতে হবে। এসব হলো আধুনিক শিল্প সম্পর্কের অনুষঙ্গ। শুধু দেশের মধ্যে না, বিদেশে পণ্য রপ্তানি করার জন্য এসব মানবিক ব্যাপারগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু এগুলো নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে।
বর্তমান সরকারের কোনো মধ্যমেয়াদি কাঠামো নেই। ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তারা মধ্যমেয়াদি ভাবনা নিয়ে ওয়াকিবহাল না। এ সরকার যদি আগামী এক বছর পর না থাকে এবং নতুন সরকার যদি আসে তাহলে এখনকার নিয়মনীতির ধারাবাহিকতা থাকবে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে। এটাও একধরনের অসুবিধার সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একে ঘনীভূত করতে পারে।
আবার বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি না হওয়ার কারণে অর্থনীতির রোডম্যাপেও অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে ব্যক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে।
আপনি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের পক্ষে কথা বলে আসছেন। এখন কোন সংস্কার সবচেয়ে জরুরি?
বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সংস্কার-সম্পর্কিত কমিটি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার জায়গা থেকে তৈরি করা হয়েছে, সেটার সংখ্যা ১৫-এর মতো। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশনের হাতে আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তনের জন্য সরকার
কোনো কমিশন গঠন করেনি। শ্বেতপত্র কমিটিতে আমরা অতীতের অবস্থার ব্যবচ্ছেদ করেছি মাত্র। আর একটা টাস্কফোর্স করা হয়েছিল, সেটা কিছু কিছু পরিস্থিতি নিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে বড় কাজ হচ্ছে। জ্বালানি খাত নিয়েও একটা বড় ধরনের কাজ হচ্ছে। অর্থনীতির কাজের পরিপূরক হিসেবে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ব্যাপার আছে। যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন ও স্থানীয় সরকারের বিষয়। এর বাইরে অন্যান্য উপরিকাঠামোর পরিবর্তন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি মনে করি, সেসব প্রাসঙ্গিক নয়। অর্থনীতির ভিত ঠিক রাখার জন্য যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা রয়েছে, সেগুলো ঠিক আছে কি না, তা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সেই জায়গায় আমি বড় ধরনের পরিবর্তন প্রত্যাশা করি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সামনে জাতীয় বাজেট পেশ হবে। জাতীয় বাজেটের সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে আমার প্রত্যাশা ছিল—যথাযথভাবে কর ব্যবস্থাপনা করা হবে। আমাদের দেশ পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যক্ষ কর যাঁরা
দেন, তাঁদের আরও করের বোঝা চাপানো হয়। এ জন্য আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, এবার প্রত্যক্ষ করকে বিস্তৃত করার জন্য যাঁদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে, কিন্তু দেন না এবং তাঁরা টাকা কীভাবে নিয়ে যান। এঁদের চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। আবার রাজস্ব ব্যয় যেমন ভাতা, বেতন, ভর্তুকি ও সুদ দিতেই ৯০ শতাংশের বেশি ব্যয় হয়ে যায়। সেখান থেকে কোনো উদ্বৃত্ত উন্নয়ন ব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় না। আমার প্রত্যাশা ছিল, রাজস্ব ব্যয় এমনভাবে দাঁড় করানো হবে, যেন উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য কোনো ঋণ গ্রহণ করতে না হয়।
বিগত সরকারের মেগা প্রকল্প নিয়ে এত সমালোচনার পর ঝেড়ে-মুছে ফেলে দেওয়া হলো কি না বা নতুন প্রকল্প কোন মাপকাঠিতে গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে স্বচ্ছতা ও পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। একইভাবে ঘাটতি বাজেট আমরা বিদেশের টাকার ওপর নির্ভরশীল হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে অথবা সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঘাটতি মিটিয়ে থাকি। ঘাটতি বাজেটের অর্থ জোগাড় করতে কী ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করা হবে, সেটা আমরা জানতে চেয়েছি। কিন্তু আমাদের জানা-বোঝার আকাঙ্ক্ষাটা অর্থনীতি-সম্পর্কিত হলেও, তার কোনো খবর আমরা এখন পর্যন্ত জানি না।
আবার অনেক লোকসানি সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন চিনি ও পাটকল আছে, এসবকে কীভাবে পরিবর্তনের মধ্যে আনা হবে—আমরা জানতে চেয়েছি। এরপর গার্মেন্টসের পরে যেসব শিল্প আছে, তা নিয়ে নাটকীয় কী পরিবর্তন করা হবে, এসব বোঝার ব্যাপার ছিল। আবার গ্রামীণ দরিদ্র মানুষকে সুরক্ষার জন্য যেসব ভাতা চালু ছিল—তাদের নিয়ে কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে এবং সেগুলো সঠিকভাবে প্রাপ্ত লোকের কাছে পৌঁছাবে কি না, জবাবদিহি কীভাবে করা হবে। কিন্তু এসব নিয়ে কোনো ভাবনা চোখে পড়ছে না।
আমরা বারবার বলেছি, মানুষ যদি ঠিকভাবে খেতে-পরতে না পারে এবং স্বস্তিতে না থাকে, কর্মসংস্থান না হয়—এই ছাত্র-যুবকেরা যে আন্দোলন করল চাকরির জন্য কোটার বিরুদ্ধে, সেই শোভন কর্মসংস্থান যদি না হয়, তাহলে যতই সংবিধান সংস্কারের কথা বলা হোক, কোনো কিছুতেই স্বস্তি আসবে না।
বন্দর ব্যবস্থাপনা ও মানবিক করিডর নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আপনি কী বলবেন?
এই দুটি বিষয়ের একটিতেও আমার কোনো বিশেষ জ্ঞান নেই। তবে আমি সাধারণভাবে বুঝি, এইসব বিষয়ে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের স্বার্থকে দেখে, জাতীয় সক্ষমতা, নিরাপত্তা এবং পরিবর্তনশীল ভূকৌশল অবস্থানকে বিবেচনায় রেখে সম্পূর্ণভাবে জনগণের মতামত নিয়ে এসব করা উচিত। এ জন্য মুক্ত আলোচনা এবং জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে করা হলে সেটাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক নেই—তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
এটা তো পরিষ্কার সাড়ে ১৫ বছর ধরে যে সরকারটি ছিল, তাদের প্রতি ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। তাদের যদি সেই সমর্থন না থাকত, তাহলে তারা যেসব দুরাচার করেছে, সে মাত্রায় করতে পারত না। কিন্তু ভারত কোনো দায়দায়িত্ব নেয়নি। তারা যে বিবেচনা থেকে কাজটি করেছিল, সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে এবং সেটা যে ব্যর্থ হয়েছে, সেটা তারা এখনো স্বীকার করে নিচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দুই দেশের সম্পর্ক সঠিক ও সুস্থ রাখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি নিজেই এর সাক্ষী। সেপ্টেম্বর মাসে প্রধান উপদেষ্টা যখন জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে গেলেন, তখন এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সভা হয়েছে। সেই সভা আমি দেখেছি। সেই সভা কিন্তু আমাদের আগ্রহের কারণে সম্ভব হয়েছিল, যাতে করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা জায়গামতো ফিরে আসে। এই সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ঢাকায় সফর করেছিলেন। এটাও একটা অগ্রগতি ছিল। সেই সময়ে আমরা চেয়েছি উচ্চপর্যায়ের একটা মিটিং হোক। আবার আমাদের আগ্রহের কারণেই বিমসটেক সম্মেলনের পাশেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ হয়েছিল। এই ঘটনাগুলোকে আমি দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে নির্মাণের ব্যাপার হিসেবে দেখি।
তারপরে প্রতাশ্যার পরে যে ঘটনাগুলো ঘটল এবং অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি শুরু হলো, সেটা আমার চিন্তার মধ্যে ছিল না। আমরা স্থলপথে সুতা আনা বন্ধ করে দিলাম। তারা ট্রান্সশিপমেন্ট বন্ধ করে দিল আমাদের তৃতীয় দেশে যাওয়ার। কিছুদিন আগে আমরা জাহাজনির্মাণ চুক্তি বাতিল করলাম। এ ধরনের রেষারেষি দুই দেশের জন্যই ভালো হবে না। বাংলাদেশ ভারতকে যেমন সমুদ্রে ফেলে দিতে পারবে না, আমরাও ভারতকে হিমালয়ে পাঠিয়ে দিতে পারব না। সুতরাং দুই দেশের সম্পর্ককে সুস্থ রাজনীতি ও পারস্পরিক সম্মানের ওপর গড়ে তোলার ব্যাপার। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত যদি মনে করে এ সরকারের সঙ্গে কোনো কার্যক্রম করবে না, তাহলে সেটা বিবেচনাপ্রসূত হবে না।
আবার বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী যদি যেকোনো ঘটনাবলিকে ভারতের ওপর দায় দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চায়, সেটাও উপকারী হবে না। আমার কাছে মনে হয়, বিজ্ঞ, বিবেচনাপ্রসূত দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাধারা ও উভয়ের মৌল স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ আমাদের এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে।
বাংলাদেশ ভূ-রাজনীতির খেলায় পরিণত হচ্ছে। চীন, আমেরিকা, রাশিয়া ও ভারতের একেক দেশের একেক রকম স্বার্থ। আমরা কি আসলেই স্বার্থের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি। আপনি কী মনে করেন?
আমরা এখনো অন্যের স্বার্থের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছি না। তবে কোন কোন দেশের এই ভূ-রাজনীতির খেলা নিয়ে আগ্রহ জন্মাচ্ছে, সেটা বিবেচনায় রাখতে হবে। দুটির একটিও আমাদের জন্য উপকারী হবে না। আমাদের খেলার ভিকটিম হওয়ার জন্য এবং প্লেয়ার হওয়ার জন্য উচ্চাশা করা ঠিক হবে না। জ্ঞানোচিত, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের সম্ভাবনাকে বিবেচনায় রেখে অগ্রসর হওয়া উচিত। এটা চটজলদির বিষয় না। এটাকে মধ্য মেয়াদে দেখা উচিত।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের কাছে দ্বিপক্ষীয় ঐকমত্যের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। এটা কোনো একক পক্ষের বিষয় না। অন্য কাউকে ছোট বা বড় করার ব্যাপার না। এটার জন্য আমাদের জাতীয় স্বার্থের জায়গা থেকে দুই পক্ষের ঐকমত্য লাগবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক মানের মানুষ। আমরা কি তাঁর এই ৯ মাসের শাসনামলে ইউনূস ম্যাজিক দেখতে পেলাম?
তিনি ম্যাজিক দেখাতে পারবেন কি না, সেটা আমি জানি না। তবে তাঁকে তো ম্যাজিশিয়ান মনে করেই জাতি নিয়ে এসেছিল। ছোট বা বড় ম্যাজিক থাকে। অনেক সময় দর্শকেরা ম্যাজিকের কলকবজা ধরেও ফেলতে পারে। সেই অর্থে দেশে কিন্তু অনেক কিছু ঘটছে। অর্থনীতি একটা খাত থেকে বের হয়ে এসেছে। বাংলাদেশ একটা বড় ধরনের সিভিল আনরেস্ট থেকে বের হতে পেরেছে। বৈদেশিক সম্পর্কগুলোকে আমরা স্বাভাবিক করতে পেরেছি। সুতরাং এই ৯ মাসে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ও ব্যক্তিত্বে একটা নতুন উচ্চ রেখায় আমরা পৌঁছেছি। কিন্তু এটা তো বিবর্তনশীল একটা উত্তরণকালীন সময়।
যেকোনো দেশের ক্ষেত্রে একটা উত্তর এবং পূর্ব পর্ব থাকে। উত্তর ও পূর্ব কালের মাঝখানে একটা কালপর্ব থাকে। কালপর্বের মধ্যে ধ্বংস ও সৃষ্টিও থাকে। এ জন্য এটা একটা উত্তরণকালীন সময়ও বটে। এ সময়েই মানুষের মাঝে জমে থাকা সব ধরনের ক্লেদ, ঘৃণা, ব্যর্থতা ও হতাশা বেরিয়ে আসে। সবচেয়ে কলুষ মনের প্রকাশ ঘটে। এটা আমাদের নারী, বিপন্ন ও দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠীর প্রতি এবং সংখ্যালঘু জনগণের প্রতি আমরা আমাদের হিংসা ও বিদ্বেষ ধাবিত করি। আবার তাদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরাও সংঘবদ্ধভাবে দাঁড়ায়। এ রকম একটা সময়ের ভেতরে আমরা এখন অবস্থান করছি। এ সময়ে আমাদের সবচেয়ে কলুষ জিনিসটা প্রকাশ পাচ্ছে, একই রকমভাবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে অখণ্ড মানবিকতার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। দুর্বলভাবে হলেও সেটা প্রকাশ্যে আসছে। এটার মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে চলছে।
ইউনূস ম্যাজিকের বাতাবরণ আমাদেরকে সঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষায় আছি।
মব জাস্টিস নিয়ে কী বলবেন?
যে কালপর্ব চলছে, সেখানে ব্যক্তি, গোষ্ঠীর কলুষ দিকটি বের হয়ে আসে, সংঘবদ্ধভাবে তারা মানুষের ওপর অত্যাচার করার চেষ্টা করে। সেটিকে মব জাস্টিস বলা হচ্ছে। মব কীভাবে বিচারের মধ্যে পড়ে, সেটা আমার জানা নেই। দেখা যাচ্ছে, এই মবের মাধ্যমে সবচেয়ে বিপন্ন মানুষগুলোর ওপর আক্রমণ হচ্ছে। সে কারণে বর্তমান সরকারের মনোযোগের জায়গাটা শুরু হয়েছিল সংস্কার নিয়ে, তারপর সেই সংস্কার থেকে সরে গিয়ে কোনো কোনো দল নির্বাচনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু নাগরিক অধিকার, নাগরিক নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বেশি নিমজ্জিত থাকতে হচ্ছে এখন। স্বল্পসংখ্যক মানুষ যে সংঘবদ্ধভাবে পুরো সমাজকে বিপন্ন করে দিতে পারে এবং একটা রাষ্ট্রকে অসহায় করে দিতে পারে, সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এখান থেকে আমাদের বড় শিক্ষা নেওয়ার ব্যাপার আছে। কীভাবে নাগরিকেরা এটাকে প্রতিরোধ করবে, সেটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে। শ্রীলঙ্কায় আমাদের মতো অভ্যুত্থান হয়েছে।
কিন্তু আমরা কেন তাদের মতো করে ঘুরে দাঁড়াতে পারছি না?
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে পার্থক্যটা হলো, সেখানে আমাদের মতো গণ-অভ্যুত্থান হয়ে রাজনৈতিক সরকারের পতন হয়েছে। কিন্তু তাদের যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল, সেগুলো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি টেকসই এবং অনেক বেশি পেশাদার ছিল। সেগুলো অনেক বেশি অরাজনৈতিকভাবে কাজ করত। ১৫-২০ বছর বা আরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন বিচারব্যবস্থা, আইন সভা, নির্বাহী বিভাগ এবং নজরদারি করার জন্য কমিশনগুলো শ্রীলঙ্কায় অনেক বেশি পেশাদারত্ব ও অরাজনৈতিকভাবে কাজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে দুঃখজনকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে দলীয় প্রভাব তৈরি করে।
সে জন্য শ্রীলঙ্কা যত তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে, বাংলাদেশ সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। শুধু শ্রীলঙ্কা কেন, নেপালে একটা মাওবাদী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন ঘটেছে। কিন্তু কখনো শুনেছেন নেপালে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে কোনো দল বিতর্কে জড়িয়েছে। তাদের নির্বাচন কমিশন কিন্তু ঠিকভাবে কাজ করেছে। এসব দেশ থেকে কিন্তু বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে।
আপনি কি এই সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখতে পান?
এই মুহূর্তে সরকারের ভেতরে শুধু (অর্থনীতির বিষয়ে বলতে চাই) সমন্বয়হীনতার চেয়েও বেশি দেখি সহযোগিতার অভাব। এটা হলো একটা অনির্বাচিত সরকার, সীমিত ম্যান্ডেটের সরকার এবং নির্দিষ্ট সময়ের সরকার। সরকারের সবার সঙ্গে সহযোগিতা নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু সেটা আমি এখনো দেখিনি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেটা করলেও তাঁর সহযোগীরা সেটা করেন না। তাঁদের পক্ষপাতও আমি অনেক সময় দেখতে পাই। তাঁরা টিম হিসেবেও কাজ করেন না। তাঁরা আসলে নিজেরা নিজেদের মতো করে কাজ করেন। তাঁদের নিজেদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই এবং সে কারণে সংস্কারের পরম্পরাও দেখা যাচ্ছে না।
সবশেষ হলো স্বচ্ছতা। তাঁরা যেসব কাজ করেন, সেটাও ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। আমি অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে বলতে চাই, অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে উন্নতিটুকু হলো, সেটার ক্রেডিটও তাঁরা নিতে পারেন না কৌশলগত যোগাযোগের অভাবে। আমাদের অর্থনীতির বিষয়ে জানতে হলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব যদি অর্থনীতি নিয়ে ব্রিফ করেন, তখন জানতে পারি। মানে অর্থ উপদেষ্টা সেভাবে জানাতে পারেন না। এসব ঘটে সহযোগিতার অভাবের কারণে। সহযোগিতা, সমন্বয়হীনতা, স্বচ্ছতার অভাব দেখছি। একই সঙ্গে সদিচ্ছার অভাবও দেখছি।
এ সরকার সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
এই সরকার সম্পর্কে জনগণের যে প্রত্যাশা, সেটা যেন হতাশায় পরিণত না হয়। আমরা সেই প্রত্যাশার প্রতি অনুগত থাকতে চাই।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল একটা কাঠামোগত সংস্কারের জন্য। সেই কাঠামোগত সংস্কারের সুযোগটা এই দুর্যোগের মধ্যে এসেছিল। সেই সুযোগটা তারা যেন নষ্ট না করে। এখন পর্যন্ত সেই জায়গায় কোনো অগ্রগতি দেখছি না। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে বলব, একটা সঠিক নির্বাচনই হলো এই সংকট থেকে উত্তরণের চাবিকাঠি। তাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক সঠিক নির্বাচন (আসন ভাগাভাগির নির্বাচন না)—এ রকম একটা নির্বাচন দেখার জন্য দেশবাসী অপেক্ষায় আছে।
সবকিছু মিলিয়ে কী মনে করেন, সেই ধরনের একটি নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
বাংলার মানুষ সব সময় আমাদের চমকিত করেছে। আশা করি, এবারও করবে। আমি ভরসা রাখি মানুষের ওপরে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আপনাদেরও ধন্যবাদ।
২০২৪ সালে সংঘটিত ‘মনসুন রেভল্যুশন’-এর পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে নেতৃত্বশূন্যতা ও প্রশাসনিক অচলাবস্থা। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ আহমেদ মুশফিক মোবারক তুলে ধরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণ, আইনশৃঙ্খলা সংকট, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও আন্তর্জাতিক কর্মসংস্থানের উদ্যোগসহ নানা...
১৬ দিন আগেবদরুদ্দীন উমর লেখক, গবেষক ও বামপন্থী রাজনীতিক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিপিই ডিগ্রি পান। দেশে ফিরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে
১৭ দিন আগেএক বছরেরও কম সময়ে অনলাইন ফুড ডেলিভারি সার্ভিসে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে ফুডিবিডি ডট কম। প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজারের বেশি অর্ডার ডেলিভারি করছে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের সঙ্গে কাজ করছে সাত হাজারের বেশি রেস্তোরাঁ। ফুডির উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, পরিকল্পনা, অনলাইন ফুড ডেলিভারি সার্ভিস খাতের বর্তমান অবস্থাসহ নানা বিষয়ে আজক
০৬ মে ২০২৫অধ্যাপক এম এম আকাশ—বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের এক সুপরিচিত নাম। তিনি শুধু অর্থনীতিবিদ হিসেবেই নন, একজন প্রগতিশীল চিন্তক ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) অন্যতম নেতৃত্বদানকারী হিসেবেও পরিচিত। আজকের অস্থির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যখন একদিকে গণতন্ত্র সংকুচিত হচ্ছে আর অন্যদিকে বৈষম্য বাড়ছে...
০৪ মে ২০২৫