Ajker Patrika

ট্রাম্পের দিকে চেয়ে নেতানিয়াহু

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ফিলিস্তিনের আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের ডোম অব দ্য রকের রেপ্লিকা নিয়ে বিক্ষোভ ইরানিদের। গতকাল রাজধানী তেহরানে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের অনেকের হাতে ছিল ইরানের জাতীয় পতাকা। ছবি: এএফপি
ফিলিস্তিনের আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের ডোম অব দ্য রকের রেপ্লিকা নিয়ে বিক্ষোভ ইরানিদের। গতকাল রাজধানী তেহরানে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের অনেকের হাতে ছিল ইরানের জাতীয় পতাকা। ছবি: এএফপি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে হামলা চালানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ‘দুই সপ্তাহের’ বিরতি ঘোষণার পর ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে। সংঘাত থামাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি আরেক মধ্যস্থতাকারী মিসরের সঙ্গেও আলোচনা শুরু করেছে ইরান। অন্যদিকে গত বৃহস্পতিবার রাতের পর গতকাল শুক্রবারও ইসরায়েলে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে তারা। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র যাতে দ্রুত অভিযান শুরু করে, সে চেষ্টা চালাচ্ছে হামলায় বেকায়দায় পড়া ইসরায়েল।

ইরানে হামলা চালাতে বেশ কয়েকদিন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ লক্ষ্য ভূমধ্যসাগরে রণতরিও সরিয়ে নিচ্ছে মার্কিন বাহিনী। এ ছাড়া ইরানে হামলার পরিকল্পনাও অনুমোদন দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে চূড়ান্ত অনুমোদন দেননি। এ পরিস্থিতিতে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছিল, যেকোনো সময় ইরানে অভিযান শুরু করতে পারে মার্কিন বাহিনী। তবে বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাতে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট জানান, যুক্তরাষ্ট্র ইরানে অভিযান চালাবে কি না, সে বিষয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত থামাতে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশই কূটনৈতিক তৎপরতার কথা বলছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবর, ট্রাম্প আশা করছেন, ইরান শিগগিরই কূটনৈতিকভাবে এ সংকটের সমাধান করবে। বিবৃতিতে ট্রাম্প বলেন, ‘ইরানের সঙ্গে আলোচনার একটি উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে, তা আদৌ হবে কি না, এখনো নিশ্চিত নয়; এ প্রেক্ষাপটে আমি আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেব, সেখানে (ইরানে) যাওয়া (অভিযান চালানো) উচিত হবে কি না।’

জোরদার ইরানের হামলা

১২ জুন রাতে ইরানে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। প্রথমদিকে হামলায় বিপর্যস্ত হয় ইরান। ইসরায়েলি হামলায় ইরানের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার, বিজ্ঞানীসহ বেসামরিক মানুষেরা নিহত হন। এই সংঘাতের এক সপ্তাহ এসে সেই চিত্র খানিকটা বদলে গেছে। পাল্টা হামলায় এখন ইসরায়েলও বেশ ক্ষতির মুখে পড়ছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফও স্বীকার করেছে, ইরানের সব ক্ষেপণাস্ত্র তারা ঠেকিয়ে দিতে পারছে না। গত বুধবার রাতের হামলাকে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হিসেবে আখ্যা দিয়েছে তারা।

এ পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার রাতে ব্যাপক হামলা চালায় ইরান। ইসরায়েলের তেল আবিব, হাইফাসহ বিভিন্ন শহর লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান। বিবিসির খবরে বলা হয়, তবে সবচেয়ে বেশি হামলা চালানো হয় তেল আবিবে। এ ছাড়া ইসরায়েলের বিরশেভা প্রযুক্তি পার্ক, মাইক্রোসফট কার্যালয় এবং ইসরায়েলি সামরিক শাখার কাছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে। ইরানি হামলার পর বিরশেভার কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রেলস্টেশনটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া গাভ-ইয়াম নেগেভ অ্যাডভান্সড টেকনোলজিস পার্কে মাইক্রোসফট অফিসের দৃশ্যমান ক্ষতি হয়েছে। এই প্রযুক্তি পার্কে রোবোটিকস এবং ডেটা সায়েন্সসহ প্রচুর গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম রয়েছে।

এদিকে গতকাল শুক্রবার আবারও হামলা শুরু করেছে ইরান। ইসরায়েলের চ্যানেল ১২-এর খবরে বলা হয়েছে, ইরান থেকে ইসরায়েলের আকাশসীমায় ৩৯টি ক্ষেপণাস্ত্র প্রবেশ করেছে। আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, এর মধ্যে চারটি এলাকায় আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো।

তেহরানে ইসরায়েলের হামলা

বৃহস্পতিবার রাতে তেহরানে ব্যাপক হামলা চালায় ইসরায়েলে। আইডিএফ জানিয়েছে, ৬০টি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে তেহরান সরকারি ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। এসব হামলায় তেহরানের একটি হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া তেহরানে ইরানি আরেক পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে আইডিএফ। বিবিসি ইসরায়েলের এক সপ্তাহের হামলা বিশ্লেষণ করেছে। এতে বলা হয়েছে, তেহরানে ১০০টির বেশি হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এ ছাড়া ইরানের বিভিন্ন পরমাণু স্থাপনায় ততধিকবার হামলা চালিয়েছে তারা। সূক্ষ্মভাবে এসব হামলা চালানো হয়েছে। এসব হামলায় ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে সেগুলো একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়নি।

ইরানে প্রতিবাদ

ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার প্রতিবাদে তেহরান, শিরাজ, তাবরিজ, ইস্ফাহানসহ বিভিন্ন শহরে গতকাল নজিরবিহীন গণবিক্ষোভ দেখা গেছে। আল জাজিরা জানিয়েছে, এসব বিক্ষোভে দেশজুড়ে লাখো সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে নিজেদের ক্ষোভ ও সংহতি প্রকাশ করেছেন। বিক্ষোভে ইরানের উচ্চপর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাকে অংশ নিতে দেখা গেছে। দেশটির প্রধান বিচারপতি গোলাম-হোসেইন মোহসেনি-এজেই, আইআরজিসির সাবেক প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জাফারি, কয়েক মন্ত্রী এবং উপ-স্পিকার এই মার্চে উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছে ইরানের জামারান নিউজ।

কূটনীতি, তবে অবস্থানে অনড় ইরান

ইসরায়েলে হামলার পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতাও জোরদার করেছে ইরান। গতকাল একই সঙ্গে বিভিন্ন কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগ শুরু করেছে তারা। এর অংশ হিসেবে মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বদর আবদেলাত্তির সঙ্গে আলোচনা করেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি। পরে বদর আবদেলাত্তি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সঙ্গে কথা বলেন। ইরান সংকট সমাধানে এগিয়ে এসেছে তুরস্কও। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান গতকাল এ নিয়ে জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎসের সঙ্গে কথা বলেছেন।

এদিকে আলোচনার জন্য গতকাল জেনেভায় গেছেন আরাঘচি। সেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হতে পারে গতকাল ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ আগেই ধারণা দেন। তিনি দাবি করেন, সমঝোতার জন্য ইরানকে অবশ্যই আগ্রহ দেখাতে হবে। এই আলোচনার জন্য ফ্রান্স ও ইইউর দেশগুলো বেশ কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করবে। এর মধ্যে রয়েছে, ইরানের পরমাণু স্থাপনায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কাজ একেবারে বন্ধ করা। এ ছাড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বন্ধের প্রস্তাব থাকবে। সেই সঙ্গে ইরানের সমর্থনপুষ্ট সশস্ত্র সংগঠন যেমন হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতিদের অর্থায়নসহ সাহায্য বন্ধের প্রস্তাবও দেওয়ার কথা গতকাল। বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মূলত যুক্তরাষ্ট্র যেসব প্রস্তাব দিতে চায় ইরানকে, সে প্রস্তাবগুলোই ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে উপস্থাপন করবে ইইউ।

এদিকে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করলেও নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। আরাঘচি গতকালও বলেছেন, ইসরায়েল পুরোপুরি হামলা বন্ধ না করা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কোনো আলোচনা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি কোনো আলোচনা হবে না। ইসরায়েলে ইরান যাতে হামলা থামিয়ে আলোচনা শুরু করে, সে বিষয়ে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকবার তাদের কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে বলেও জানিয়েছেন আব্বাস আরাঘচি।

‘আলোচনায় আগ্রহী ইরান’

জেনেভায় বৈঠক শেষে ফ্রান্স ও জার্মানি বলেছে, ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি ও অন্যান্য ইস্যুতে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও তারা আলোচনায় প্রস্তুত।

শুক্রবার জেনেভায় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইরান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চ প্রতিনিধির মধ্যে বৈঠক হয়। বৈঠকের পর জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোহান ওয়াডেফুল বলেন, ‘আলোচনায় ভালো ফলাফল হলো। আমরা এমন একটি অনুভূতি নিয়ে বৈঠক কক্ষ ত্যাগ করছি যে, ইরান গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুতে আলোচনা চালিয়ে যেতে মৌলিকভাবে প্রস্তুত।’

ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ-নোয়েল ব্যারো বলেন, ‘আমরা আশা করি ইরান আলোচনায়, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও, উন্মুক্ত মনোভাব দেখাবে, যেন সংলাপের মাধ্যমে সংকটের একটি সমাধানে পৌঁছানো যায়।’

হামলায় যুক্তরাষ্ট্রকে চায় ইসরায়েল

ট্রাম্প হামলার পরিকল্পনা অনুমোদনের আগে থেকেই পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছিল, ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে। কারণ তাদের ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী অস্ত্র ফুরিয়ে আসছে। এ ছাড়া আইডিএফের পাশাপাশি মার্কিন বাহিনীও যাতে দ্রুত হামলা শুরু করে সেটাও চাইছিল ইসরায়েল। তবে ট্রাম্প সিদ্ধান্ত নিতে দুই সপ্তাহ সময় নেওয়ায় খানিকটা হতাশা সৃষ্টি হয়েছে ইসরায়েলের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে।

ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজের কলাম লেখক ও বিশ্লেষক গিডিওন লেভির মতে, ট্রাম্প সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে পারেন—এ ইঙ্গিতে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গভীর হতাশায় পড়ছেন। কারণ নেতানিয়াহু চান, ট্রাম্প যেন যত দ্রুত সম্ভব এই যুদ্ধে যুক্ত হন। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, যদি ট্রাম্প সত্যিই দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে চান এবং এটা কোনো ছলচাতুরী না হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধে জড়ানোর সম্ভাবনা ক্রমেই কমে যাচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আইআরজিসির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন খামেনি

পরবর্তী লক্ষ্য কোন দেশ, জানাল ইসরায়েল

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নতুন ফ্রন্ট গড়তে ইরানের কাছে অর্থ চাইলেন জেনারেল ডাল্লা

ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে হত্যার ইসরায়েলি ষড়যন্ত্র ভেস্তে দিল তেহরানের গোয়েন্দারা

হামলার মুখে নাগরিকদের নিরাপদ রাখে ইসরায়েলের ‘মামাদ’ কৌশল

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত