Ajker Patrika

আমাজনের গহিনে অবৈধ খনিতে সোনার বিনিময়ে বিক্রি হয় যৌনতা

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২: ২৬
Thumbnail image
নাতালিয়া কাভালকান্ত জানান তিনি যৌনকর্ম থেকে উপার্জন করা অর্থ দিয়ে একটি বাড়ি বানিয়েছেন। ছবি: বিবিসি

দাইওনো লেইতো কখনো যৌনকর্মী হতে চাননি। কিন্তু ১৭ বছর বয়সে স্বামী হার্ট অ্যাটাকে যখন মারা গেলেন, তখন তাঁর শেষকৃত্য চালানোর খরচও ছিল না। ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলের পারা প্রদেশে অবস্থিত দাইওনোর শহর ইতাইতুবা দেশের অবৈধ সোনা খনিগুলোর কেন্দ্রবিন্দু। তাই একজন বন্ধু তাঁকে পরামর্শ দেন আমাজনের গভীরে খনি শ্রমিকদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের বিনিময়ে টাকা জোগাড় করতে।

‘খনিতে যাওয়া মানে একধরনের জুয়া খেলা।’ বলেন তিনি, ‘ওখানে নারীদের মারাত্মক অপমানিত হতে হয়। তাদের মুখে চড়-থাপ্পড় মারা হয় এবং গালমন্দ করা হয়।’

‘আমি আমার শোয়ার ঘরে ঘুমাচ্ছিলাম, আর একজন লোক জানালা দিয়ে লাফিয়ে এসে আমার মাথায় বন্দুক ধরল। আর যদি টাকা দেয়, তবে তারা নারীদের নিজের সম্পত্তি মনে করে।’

দাইওনো সফলভাবে শেষকৃত্যের জন্য টাকা জোগাড় করেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি প্রথম সন্তানের মা হন। গত ১৬ বছর ধরে ইতাইতুবার অনেক নারীর মতোই তিনি মাঝে মাঝে খনিতে গিয়ে রান্না, কাপড় ধোয়া, বারের কাজের পাশাপাশি করছেন যৌনকর্মীর কাজও।

এখন তিনি সাতজনের একটি পরিবার চালাচ্ছেন।

‘আমি বলব না এই শহরের সব নারী এটা করেন, কিন্তু অনেকেই কাজটি করেন। তাই এটা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আমরা এ নিয়ে খুব একটা চিন্তা করি না।’ বলেন নাতালিয়া কাভালকান্তে। তিনি ২৪ বছর বয়সে গভীর অরণ্যের একটি খনি এলাকায় যৌনকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। চার বছর পর একটি বারের মালিককে বিয়ে করে তিনি একটি পতিতালয়ের পরিচালক হয়ে ওঠেন। সম্প্রতি শহরে তাঁর ভাগনিদের দেখাশোনার জন্য তিনি এ কাজ ছেড়ে দেন।

আমাজনর জঙ্গলের আনুমানিক দুই লাখ ২০ হাজার হেক্টর এলাকা অবৈধ সোনার খনির দখলে আছে। ছবি: এএফপি
আমাজনর জঙ্গলের আনুমানিক দুই লাখ ২০ হাজার হেক্টর এলাকা অবৈধ সোনার খনির দখলে আছে। ছবি: এএফপি

এসব তথ্য জানা যায় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

চিরসবুজ বা বৃষ্টি অরণ্যের খনি গ্রামগুলোতে জীবন খুবই কঠিন। বেশির ভাগ গ্রামে শুধু একটি কাঁচা রাস্তা, কিছু সেলুন, বার এবং একটি গির্জা থাকে। কিন্তু খনিশ্রমিকেরা আরও দূরে, কাঠ আর ত্রিপলের তৈরি ঘরে বাস করে। তাদের চারপাশে থাকে সাপ এবং জাগুয়ার। জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে গোটা এলাকা নিমজ্জিত হয় অন্ধকারে। রান্নার কাজ করা নারীদের এই শিবিরগুলোতেই পুরুষদের সঙ্গে বসবাস করতে হয়।

যখন খনিশ্রমিকেরা সোনা খুঁজে পান এবং টাকা আসে, তখন তাঁরা গ্রামে আসেন বলে নাতালিয়া জানান। অনেক সময় তাঁদের যৌন সম্পর্ক করার আগে গোসল করানোর জন্য রাজি করাতে হয়।

ব্রাজিলিয়ান আইনে পতিতালয় চালানো অবৈধ, তবে নাতালিয়া দাবি করেন, তিনি কোনো কমিশন নেননি। শুধু বারের স্টাফ নিয়োগ করতেন এবং কক্ষ ভাড়া দিতেন।

তরুণী নারীরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন কাজের জন্য। তিনি মাঝে মাঝে তাঁদের ইতাইতুবা থেকে খনিতে ভ্রমণের জন্য টাকা ধার দিতেন। পাক্কা সাত ঘণ্টার যাত্রা এটি।

দাইওনো লেইতো ১২ বছর বয়স থেকে সোনার খনিতে কাজ করছেন। ছবি: বিবিসি
দাইওনো লেইতো ১২ বছর বয়স থেকে সোনার খনিতে কাজ করছেন। ছবি: বিবিসি

ব্রাজিল সরকার জানিয়েছে, অবৈধ খনিগুলোতে কাজ করেন ৮০ হাজার থেকে ৮ লাখ মানুষ।

যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, অন্য নারীদের এই কাজে যুক্ত করা নিয়ে তাঁর কোনো দ্বিধা আছে কি না, তিনি জবাব দিলেন, ‘কখনো কখনো আমি ভাবি, নিজেও এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছি, এবং আমি জানি এটি খুব ভালো কিছু নয়।’ কিন্তু তারপর আবার চিন্তা করি, ‘মেয়েটির একটি পরিবার আছে, কখনো কখনো একটি সন্তান লালন-পালন করতে হয়। যারা যায় তাদের অনেকেরই এক বা দুটি সন্তান থাকে। তাই আমরা এটা মেনে নিই।’

বিয়ে করার আগেই নাতালিয়া এভাবে অনেক টাকা উপার্জন করেছিলেন।

এখন তাঁর ইতাইতুবায় নিজের একটি বাড়ি, একটি মোটরসাইকেল এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সোনা আছে। এগুলো তিনি কখনো কখনো যৌনতার বিনিময়ে পেয়েছিলেন, একবারে দুই বা তিন গ্রাম করে। এখন তার লক্ষ্য পড়াশোনা করে একজন আইনজীবী বা স্থপতি হওয়া।

ইতাইতুবাকে অনেকেই ‘গোল্ড নাগেট সিটি’ নামে ডাকেন। এখানকার কিছু নারী এই কাজ থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে নিজেদের ব্যবসা দাঁড় করিয়েছেন বলে জানান তিনি।

তবে, একজন নারী হিসেবে সহিংস এবং আইনহীন খনি এলাকায় পা বাড়ানোটা নিঃসন্দেহে বড় ঝুঁকির ব্যাপার।

ব্রাজিল সরকার জানিয়েছে অবৈধ খনিগুলোতে কাজ করেন ৮০ হাজার থেকে আট লাখ মানুষ। ছবি: বিবিসি
ব্রাজিল সরকার জানিয়েছে অবৈধ খনিগুলোতে কাজ করেন ৮০ হাজার থেকে আট লাখ মানুষ। ছবি: বিবিসি

খনিগুলোর পরিবেশগত ক্ষতি সবার জানা থাকলেও, জাতিসংঘ জানিয়েছে সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন এবং মানব পাচারের মতো বিষয়গুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিবেদনভুক্ত হয় না।

মূল্যবান ধাতুর এক ব্যবসায়ী বিবিসিকে জানান, এই খনিগুলো থেকে আসা অবৈধ সোনা সাধারণত একটি লাইসেন্সধারী খনি সমবায়ের সোনা হিসেবে পুনরায় চিহ্নিত হয়, তারপর তা রপ্তানি করা হয় এবং গয়না, মোবাইল ফোনের অংশ বা অন্যান্য ইলেকট্রনিক পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

ব্রাজিলের সোনার তিনটি বৃহত্তম ক্রেতা হলো কানাডা, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্য। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউটো এসকোলহাসের মতে, ইউরোপে রপ্তানি হওয়া সোনার ৯০ শতাংশের বেশি এমন এলাকা থেকে আসে, যেখানে অবৈধ খনন কার্যক্রম ঘটে।

খনি এলাকার গ্রামগুলোতে নারীদের হত্যার ঘটনাও ঘটে। গত বছর ২৬ বছর বয়সী রায়েলে সান্তোসের মৃতদেহ কুইউ-কুইউ সোনার খনির কাছে তাঁর থাকার ঘরে পাওয়া যায়। ইতাইতুবা থেকে ১১ ঘণ্টার দূরত্ব খনিটির।

রায়েলে সান্তোসকে একটি খনি এলাকার একটি গ্রামে হত্যা করা হয়। ছবি: বিবিসি
রায়েলে সান্তোসকে একটি খনি এলাকার একটি গ্রামে হত্যা করা হয়। ছবি: বিবিসি

রায়েলের বড় বোন রাইলানে জানান, এক ব্যক্তি তাকে যৌনতার বিনিময়ে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর ওই ব্যক্তি তাঁকে খুঁজে বের করে পিটিয়ে হত্যা করেন।

রাইলানে বলেন, ‘আমি খনিতে জন্মেছি, খনিতে বড় হয়েছি, আর এখন আমি খনিতে থাকতে ভয় পাই।’

রায়েলের হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সন্দেহে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তবে এখনো তাঁর বিচার হয়নি। তিনি তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

ব্রাজিলের অবৈধ সোনার খনির দখল করে থাকা এলাকার পরিমাণ ২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে ২ লাখ ২০ হাজার হেক্টরে পৌঁছেছে, যা গ্রেটার লন্ডনের চেয়েও বড়। এই এলাকায় কতজন নারী কাজ করেন, এমনকি কতজন অবৈধ খনি শ্রমিক আছেন, তা কেউ জানে না। ব্রাজিল সরকার বলছে, শ্রমিকের সংখ্যা ৮০ হাজার থেকে ৮ লাখের মধ্যে হতে পারে।

আমাজনের জঙ্গলের অবৈধ খনিগুলোতে কাজ করেন ৮০ হাজার থেকে আট লাখ মানুষ। ছবি: এএফপি
আমাজনের জঙ্গলের অবৈধ খনিগুলোতে কাজ করেন ৮০ হাজার থেকে আট লাখ মানুষ। ছবি: এএফপি

প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দে সিলভার নেতৃত্বে সরকার অবৈধ খনি বন্ধ এবং তাঁদের উৎপাদিত সোনা কেনা বন্ধের পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে সোনার উচ্চমূল্য এখনো অনেক পুরুষকে ভাগ্য পরীক্ষা করতে প্ররোচিত করছে।

দাইওনো লেইতো খনি এলাকায় কাজ করা বন্ধ করতে চান, কারণ ঝুঁকি ও কঠোর পরিশ্রম তাঁর শরীরকে বিধ্বস্ত করে তুলেছে। তবে তিনি আশা করছেন, শেষবারের মতো সেখানে যাবেন। তাঁর লক্ষ্য হলো দুই বা তিন মাসে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করা, যাতে ফিরে এসে একটি স্ন্যাক বার খুলতে পারেন। যদিও তিনি জানেন, সফল না-ও হতে পারেন।

যখনই তিনি একা থাকেন, অরণ্যপথে হাঁটেন, তখন তার সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তা হয় বলে জানান।

‘সহ্যসীমা অতিক্রম করে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব।’ বলেন তিনি, ‘কারণ আমি মনে করি, একদিন আমার সন্তানেরা বলবে, তাদের মা খুব পরিশ্রম করেছেন। যা সহ্য করেছেন, তাদের জন্য করেছে এবং কখনো হাল ছাড়েননি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত