Ajker Patrika

বাংলাদেশে পুশ ইনের পর যেভাবে ভারতে ফিরলেন খাইরুল

ডয়চে ভেলে  
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভারতের আসাম রাজ্যে চলছে বিদেশি ধরপাকড় অভিযান। ২৩ মে রাজ্যের পুলিশ মরিগাঁও, বরপেটা, ধুবরি এলাকা থেকে ১৪ জন সন্দেহভাজন বাংলাদেশিকে আটক করে। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় গোয়ালপাড়ার মাটিয়ায় ভারতের সবচেয়ে বড় ডিটেনশন ক্যাম্প বা বিদেশি আটক শিবিরে। তিন দিন পর রাতের অন্ধকারে ১৪ জনকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশে। সেখানে আরও তিন দিন কাটিয়ে রাতের অন্ধকারে তাঁরা আসামে ফেরেন। ডয়চে ভেলের কাছে এমনটিই দাবি করেছেন সদ্য নিজের বাড়িতে ফেরা মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম।

আসামের মরিগাঁও জেলার এই সাবেক শিক্ষক বাড়ি ফেরার পর কিছু দিন কথা বলতে চাননি। অবশেষে ঘটনার কথা তিনি জানালেন ডয়চে ভেলেকে। খাইরুল বলেন, ‘মনে হচ্ছে পুনর্জন্ম পেয়েছি। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে রেখে গেছিলাম। একসময় মনে হয়েছিল আর তাদের দেখতে পাব না।’

২৩ মে মরিগাঁও জেলার একদল পুলিশ তাঁকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় মিকিরভেটা থানায়। সেখানে তাঁর নথি নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর পুলিশের গাড়িতে বসিয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় জেলার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। সেখানে কিছু কর্মকর্তা তাঁর নাগরিকত্ব, মামলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশ্ন করেন এবং রাতে পুলিশের গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় গোয়ালপাড়া জেলায়।

খাইরুলের দাবি, বিকেল চারটে নাগাদ পুলিশের গাড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়। একজন কর্মকর্তা বলেন, আপাতত মাটিয়া ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে হবে। হাত বেঁধে কড়া পাহারায় সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। খাইরুল আরেও বলেন, ‘ভোর চারটে নাগাদ সেখানে গিয়ে পৌঁছাই আমরা। আমার সঙ্গে মরিগাঁও জেলার আরও আটজন মানুষ ছিলেন। তাঁরা সবাই পুরুষ। যেখানে আমাদের রাখা হয়েছিল, আমার মতো আরও ৩১ জন ছিলেন। আমরা সবাই নাকি বিদেশি, পুলিশের মুখে এমনটাই শুনেছিলাম। আমি আগেও দুই বছর ডিটেনশন ক্যাম্পে থেকেছি, তবে সেটা অন্য জায়গায়।’

এনআরসির নামে বাঙালিবিদ্বেষ?

২৬ মে বিকেলে খাইরুলসহ ১৪ জনকে গাড়িতে উঠতে বলে পুলিশ এবং তখন খাইরুলের সন্দেহ হয়, তাঁদের সঙ্গে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। খাইরুল ডয়চে ভেলেকে বলেন, তখন গাড়িতে উঠতে চাননি তিনি এবং এ কারণে তাঁকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমার হাত বেঁধে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। একেবারে পশুর মতো ব্যবহার করা হয়েছিল তখন। একসময় বুঝতে পেরেছিলাম, আর বাধা দিলে হয়তো মেরেই ফেলবে। তাই শেষমেশ হাল ছেড়ে দিই এবং তাদের কথামতোই গাড়িতে উঠি।’

তারপর গোয়ালপাড়ার মাটিয়া থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দূরে মানকাচর জেলার ঠাকুরানবাড়ি এলাকায় তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় বলে দাবি খাইরুলের। ২৬ মে বিকেল চারটে নাগাদ তাঁদের নিয়ে রওনা দেয় পুলিশ। রাত ৯টা নাগাদ সেখানে গিয়ে পৌঁছান তাঁরা। সেখানে তাঁদের বসিয়ে রাখা হয় এবং রাত তিনটে নাগাদ বিএসএফের কিছু গাড়ি আসে। ১৪ জনকে একে একে গাড়িতে তুলে দেওয়া হয় এবং ভোর চারটে নাগাদ সীমান্তের গেট খুলে তাঁদের ওপারে চলে যেতে বলে বিএসএফ।

খাইরুলের কথায়, ‘একটা ভয়ের পরিবেশ ছিল সেখানে। আমরা মাত্র ১৪ জন আর বিএসএফের বন্দুকধারী জওয়ান অনেক বেশি। সেখানে প্রতিবাদ করলে হয়তো প্রাণে বাঁচব না, এটা ভেবে চুপ থাকি। ওরা আমাদের যেভাবে সীমান্ত পেরিয়ে যেতে বলে, আমরা যেতে থাকি। অনেকটা ভেতর চলে যাওয়ার পর তারা গেট বন্ধ করে দেয়। তবে আমরা এক অজানার উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকি। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ছুটে আসে বাংলাদেশের সুরক্ষা বাহিনীর জওয়ানরা। প্রথমে তারা আমাদের ওপর রেগে যায় এবং চিৎকার করে। আমরা তাদের কাছে হাতজোড় করি, তাদের জানাই আমরা জোর করে ঢুকে আসিনি। আমাদের এদিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।’

বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিবি) এক কর্মকর্তা এগিয়ে এসে তাঁদের কথা শোনেন এবং আপাতত তাঁদের আন্তর্জাতিক সীমান্তের জিরো লাইন বা নোম্যানস ল্যান্ডে অপেক্ষা করতে বলেন। সকালে আরও কিছু কর্মকর্তা আসেন এবং প্রত্যেকেই তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। খাইরুল জানান, বাংলাদেশের বরাইবারি এলাকার মানুষ তাঁদের বিস্কুটসহ অন্যান্য খাবার দিতে থাকেন। যে এলাকায় তাঁদের অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল, সেটা ধানখেতের মতো এবং সেখানে বৃষ্টির জমা জল ছিল। তাঁরা বিকেল ৫টা পর্যন্ত সেখানেই বসে থাকেন।

দুপুরে বিজিবির এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এসে তাঁদের জানান, তাঁরা বারবার বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন এবং চিঠিও পাঠিয়েছেন, তবে বিএসএফ তাদের চিঠি গ্রহণ করছে না। খাইরুল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘বিজিবির ওই কর্মকর্তা আমাদের বলেন, আমরা বাংলায় প্রশ্ন করব, আপনারা অসমীয়ায় উত্তর দেবেন। হয়তো এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে চাইছিলেন, আমরা আসামের মানুষ।’

ওই দিন সন্ধ্যায় প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বিজিবির একটি ছাউনিতে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়। বিজিবি তাঁদের জন্য খাবারের ব্যবস্থাও করে। ডাল, ভাত আর পনির তরকারি নিয়ে এসে এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, তাঁদের কাছে এটুকুই আছে। খাইরুল বলেন, ‘তাঁরা বারবার বলছিলেন, আমরা যেন কিছু মনে না করি, তাঁদের কাছে আপাতত এটুকুই খাবার আছে। এই সময়ও কেউ এমন কথা বলছে দেখে মনে কিছুটা শান্তি পাই আমরা।’

এরপর রাত ১টা নাগাদ বিজিবির কর্মকর্তারা ফের সেখানে যান এবং খাইরুলসহ সবাইকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়। গাড়িতে প্রায় তিন ঘণ্টা যাওয়ার পর জামালপুর নামের একটি জায়গায় পৌঁছান খাইরুলেরা। সেখানে একটি ঘরে আগে থেকে ১৪ জনের জন্য আলাদা আলাদা বিছানা সাজানো ছিল। পুরুষ ও নারীদের আলাদা দিকে রাখা হয়। তাঁদের খাবার দেওয়া হয় এবং ফের এক কর্মকর্তা তাঁদের ডেকে পাঠান। তাঁদের গোটা বিষয় শুনে সেই কর্মকর্তা চলে যান।

পুরোটা দিন ওই ক্যাম্পে থাকার পর সন্ধ্যায় আবার একটি গাড়িতে বসতে বলা হয়। খাইরুল বলেন, ‘বিজিবির ব্যবহার ভালো ছিল, তবে আমাদের মনে তো ভয় ছিলই। অবৈধ বিদেশি হিসেবে আরেকটা দেশে এসেছি, অন্তত জেল তো খাটতে হবে, এটা ধরেই নিয়েছিলাম। কিন্তু ওই দিন সন্ধ্যায় গাড়িতে বসিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে, যেখান দিয়ে আমাদের দুদিন আগে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। গভীর রাতে বিজিবি আমাদের তুলে দেয় বিএসএফের হাতে। এরপর বিএসএফ আমাদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ সবাইকে আলাদা আলাদা গাড়িতে বসিয়ে সেখান থেকে নিয়ে আসে। অন্যদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জানি না, আমাকে পাঠানো হয় মরিগাঁও জেলার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। সেখানে কেউ বিশেষ কিছু বলেননি। শুধু কয়েক ঘণ্টা পর আমাকে বলা হয় বাড়ি চলে যেতে।’

খাইরুল সরাসরি বাড়ি ফেরেননি। তিন দিন ঘুরে বেড়িয়েছেন আত্মীয়দের বাড়ি। তাঁর দাবি, তখনো মনে ভয় ছিল, বাড়ি ফিরলেই হয়তো পুলিশ তুলে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘যখন আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, বারবার পুলিশকে জিজ্ঞেস করেছি আমার অপরাধ কী? তারা কেউ কিছু বলেনি। আমাকে প্রচণ্ড মারধর করার পর হাতজোড় করে বলেছিলাম, একটু মানবিকতা দেখাতে। তাঁদের মধ্যে একজন বলেছিলেন, আমি চুপ থাকলেই আমার মঙ্গল। তাই দেশে ফেরার পর প্রথমে চুপ ছিলাম। আমরা দুর্বল, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, আমার চাকরি গেছে, এবার এই যন্ত্রণা ভোগ করে ফিরেছি। শুধু দুই সন্তান আর স্ত্রীর জন্য এখনো বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা হারাইনি। না হলে এই অপমান সহ্য করা সহজ নয়।’

সুপ্রিম কোর্টে খাইরুলের মামলা চলছে। তাঁর আইনজীবী অভিজিৎ রায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘যেভাবে খাইরুলকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা বেআইনি। আমরা সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়টি উল্লেখ করব। খাইরুল যে ভারতীয়, তার একাধিক নথি আমাদের হাতে আছে।’ খাইরুল ও তাঁর আইনজীবীর বক্তব্য, ১৯৫৬ সালে মরিগাঁও জেলায় একটি চালকল চালু করেছিলেন খাইরুলের বাবা। তখন অবিভক্ত আসামের রাজধানী ছিল শিলং। শিলংয়ের এক সরকারি কার্যালয় তাঁর বাবার চালকল খোলার অনুমতি দিয়েছিল এবং তাঁদের কাছে সেই কাগজ আছে বলেও দাবি করেন খাইরুল ও তাঁর আইনজীবী। খাইরুল আরেও বলেন, তাঁর ঠাকুরদাদা একসময় বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৯২৭ সালে একটি বন্দুক রাখার লাইসেন্স পেয়েছিলেন তিনি ভারত সরকারের কাছ থেকে। এ ছাড়া ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে নানা নথিও তাঁদের কাছে আছে। এইসব নথিই সুপ্রিম কোর্টে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।

আসামে দীর্ঘদিন ধরে এনআরসি ও নাগরিকত্ব নিয়ে আন্দোলন করছেন কমল চক্রবর্তী। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, যেভাবে নতুন করে ধরপাকড় শুরু হয়েছে, তা আইনসম্মত নয়। আর রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়া কোনো সভ্য দেশে হতে পারে না।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা অবশ্য বলেছেন, ‘বিদেশি তাড়ানোর বিষয়ে ১৯৫০ সালের একটি আইন এখনো বাতিল হয়নি। এবার থেকে ওই আইনের মাধ্যমে সন্দেহভাজন বাংলাদেশিদের সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়া হবে।’ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, ১৯৫০ সালের ওই আইনে বলা হয়েছে, সন্দেহভাজন বিদেশিদের সীমান্তের বাইরে পাঠানোর নির্দেশ জারি করার অধিকার জেলা শাসকের আছে। তাই এবার থেকে সে রকম কেউ ধরা পড়লে আর ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে যেতে হবে না। আসাম বিধানসভায় গত সোমবার বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

দুই ঘণ্টা আগে একই বিমানে ভ্রমণের দাবি এক ব্যক্তির, জানালেন ভয়াবহ তথ্য

ইরানে ইসলামি শাসনের অবসান হতে পারে—মার্কিন কর্মকর্তাদের আশঙ্কা

নির্বাচন নিয়ে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে যে কথা হলো

গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালী বন্ধ করল ইরান, তেলের বাজারে উত্তেজনা

আ.লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ৭ জন আহত, গ্রেপ্তার ১

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত