Ajker Patrika

সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ড বদলে দিয়েছিল স্লোভাকিয়াকে

আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০: ১৮
সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ড বদলে দিয়েছিল স্লোভাকিয়াকে

২০১৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টা ২১ মিনিট। জ্যান কুচিয়াক নামে এক অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও তাঁর বাগ্‌দত্তা মার্টিনা কুশনিরোভা তাঁদের গ্রামের বাড়িতে বসে কফি খাচ্ছিলেন। ঠিক সে সময়ই তাঁদের দরজায় নক হলো। খোলার পর দেখা গেল ৯ এমএমএন ল্যুগার পিস্তল হাতে এক লোক দাঁড়িয়ে। ঝড়ের বেগে কুচিয়াক ও কুশনিরোভাকে গুলি করা হলো। মাত্র ২৭ বছর বয়সে মারা যান ওই দুজন। 

সাংবাদিক দম্পতি জ্যান কুচিয়াক ও মার্টিনা কুশনিরোভা হত্যাকাণ্ড, এর বিচার, সেখানে দুর্নীতি, প্রভাবশালীদের এর সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং এই সব মিলিয়ে স্লোভাকিয়ায় হওয়া রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে দেশটির বদলে যাওয়া বলে মন্তব্য করা হয়েছে অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রোজেক্টের (ওসিসিআরপি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে। 

বিশ্বের নানা দেশে এমন সাংবাদিক হত্যা হলেও সেগুলো স্লোভাকিয়ার জনগণের মতো সহজে কাউকে জাগিয়ে তুলতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে সাময়িক বিক্ষোভ-আন্দোলন হলেও শেষ পর্যন্ত বিচার অধরাই থেকে যায়। 

না, স্লোভাকিয়ার ঘটনারও বিচার এখনো সম্পন্ন হয়নি পুরোপুরি। কিন্তু সেখানে তদন্তের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উচ্চমহলের অনেকের এই হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট থাকার সত্যটি বেরিয়ে এসেছে। সেখানেও ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত হয়েছে। কিন্তু সেখানে থেমে থাকেনি। এই তদন্ত নিয়ে পুনরায় তদন্ত হয়েছে। এমনকি দেশটির সরকারের পর্যন্ত পতন হয়েছে শুধু এই হত্যার বিচার নিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলনের জেরে। বিশ্বের বহু দেশে এমন সাংবাদিক হত্যা হলেও সেখানে কিন্তু এতটা সজাগ মানুষের দেখা মেলে না। স্লোভাকিয়ায় শেষ পর্যন্ত এই হত্যার বিচার সুসম্পন্ন হবে কি না, তার উত্তর পেতে আরও অপেক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু তারা অনেকটা এগিয়েছে সন্দেহ নেই। 

সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে স্লোভাকিয়ায় রীতিমতো একটা ওলট-পালট হয়েছে। এ নিয়ে ওসিসিআরপির প্রতিবেদনে বলা হয়, সাংবাদিক দম্পতির সেই হত্যাকাণ্ডের পরই বদলে যাওয়ার পথে যাত্রা শুরু করেছিল ইউরোপের দেশ স্লোভাকিয়া। দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচনে কাজ করা কুচিয়াকের মৃত্যুর পর দেশজুড়ে যে অভাবনীয় প্রতিবাদ হয়, সে রকম প্রতিবাদ সে দেশে সর্বশেষ হয়েছিল কমিউনিজমবিরোধী আন্দোলনের সময়। 

কুচিয়াক-কুশনিরোভা হত্যাকাণ্ডের পর দেশটির সরকারের পতন হয়। কিন্তু সেটা ছিল কেবল শুরু। হত্যার তদন্তে পাওয়া প্রমাণাদিতে একের পর এক মুখোশ খুলে যেতে থাকে দেশটির সরকারি-বেসরকারি একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার। কুচিয়াক-কুশনিরোভা হত্যা মামলায় মোট ১৩ জন বিচারকের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারে বাধা ও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় সাবেক তিন পুলিশ প্রধানকে। তাঁদের একজন কারাগারে আত্মহত্যা করেছেন, বাকি দুজন প্রহর গুনছেন বিচারের। এমনকি হত্যা মামলাটির প্রাথমিক পর্যায়ের এক তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে। তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তাঁরা ‘একটি সংগঠিত অপরাধী দলের’ নেতৃত্ব দিতেন। 

তবে এসব রাঘববোয়ালকে গ্রেপ্তারের মানে এই নয় যে, সব ঠিকঠাক। কারণ, এই হত্যা মামলায় জড়িতদের সংখ্যা এত বেশি যে, একটি ক্ষয়ে যাওয়া ব্যবস্থার সব অংশীদার এতে জড়িত। কুচিয়াক-কুশনিরোভা হত্যা মামলার প্রধান সন্দেহভাজনকে খুঁজে পেয়েছেন আদালত। এদের একজন দেশটির কুখ্যাত ব্যবসায়ী মারিয়ান কোচনার। হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড বলে ধারণা করা হলেও পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা যাচ্ছে না। গ্রেপ্তার হওয়া বাকি ব্যক্তিদেরও এখন পর্যন্ত বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি, সাজা দেওয়া তো দূরের কথা। 

এ কথা সত্য যে, কুচিয়াক-কুশনিরোভা হত্যাকাণ্ডের পর স্লোভাকিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সংস্কার এসেছে। কিন্তু নতুন নেতৃবৃন্দ জনগণের আশা পূরণ করতে পারেননি। সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত অনেকের অভিযোগ দেশটির পুরোনো কুৎসিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা আবারও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে অনেকেই। 

এ বিষয়ে দেশটির সমাজবিজ্ঞানী মিচাল ভাসেচকা ওসিসিআরপিকে বলেন, ‘কুচিয়াক ও কুশনিরোভার হত্যাকাণ্ড স্লোভাক সমাজে নতুন আশা এনেছিল। কিন্তু নয়া প্রধানমন্ত্রী ও কোভিড পরিস্থিতি এ আশাকে আবারও আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে। আমরা কখনোই এমনটা চাইনি।’ 

কুচিয়াক হত্যার মূলহোতা বলে বিবেচনা করা হয় স্লোভাক ব্যবসায়ী মারিয়ান কোচনারকে

হত্যাকাণ্ডের পর দেশটির সংস্কার আন্দোলনকারীরা কুচিয়াক-কুশনিরোভার পরিবারকে জনসমক্ষে আনতে চেষ্টা করেন। তাঁরা চেয়েছিলেন, কুচিয়াক-কুশনিরোভার পরিবার সবার সমানে এসে কথা বলুক, দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনে দেশের মানুষকে সাহস দিক। 

 

কুশনিরোভার বাবা বলেন, ‘আমি মিছিলে যেতামই না। কিন্তু আমি যখন বুঝলাম, এর মাধ্যমেই আমার মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে, তখনই আমি বিক্ষোভে গিয়েছি; আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমি এত কেঁদেছি যে, আমার জন্য লিখে রাখা কথাগুলোও পড়তে পারিনি। সে সময় আমার মন যা চেয়েছে, আমি তাই বলেছি।’ 

আন্দোলনে যোগ দেওয়ায় কুচিয়াক-কুশনিরোভার পরিবারকে অনেকেই সমর্থন জানিয়ে চিঠি দেন সে সময়। আবার বিদ্বেষের ডালাও খুলে বসেছিল অনেকে। কুশনিরোভার কবর তছনছ করে দিয়েছে একাধিকবার, সিআইএ এজেন্ট বলে অপবাদ দেওয়া হয়েছে কুচিয়াকের নামে। 

যেভাবে খুঁজে বের করা হলো খুনিদের
প্রথমদিকে কুচিয়াক-কুশনিরোভার পরিবারের কেউই বিশ্বাস করতেন না, তাঁদের সন্তান হত্যা মামলার বিচার হবে। এমনকি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তরুণ পুলিশ সদস্য পিটার জুহাসও বিশ্বাস করতে পারেননি। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতি তাঁকে স্বাধীনভাবে মামলার তদন্ত করতে দেয় এবং তিনি একপর্যায়ে সফল হন। 

জুহাসের মতে, ‘খুনের ধরন থেকে এটি স্পষ্ট যে, একজন পেশাদার খুনি কাজটি করেছে। আমরা ভেবেছিলাম, হত্যাকারী বিদেশি কোনো পেশাদার খুনি।’ কিন্তু ২০১৮ সালের বসন্তে, মামলার মাত্র মাস দু-এক পর জুহাসের মনে হতে থাকে তাঁরা অপরাধীকে পাকড়াও করার খুব কাছেই রয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘মুহূর্তটি স্পষ্ট মনে আছে আমার। সে বছরের মার্চ-এপ্রিলের দিকে আমি এক আইনজীবীকে বলেছিলাম, আমার মনে হচ্ছে, আমরা সঠিক পথে আছি। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই মামলার কিনারা করতে পারব।’ 

ওসিসিআরপির প্রতিবেদনে বলা হয়, জুহাসের ধারণা সঠিক ছিল। সে বছরের সেপ্টেম্বরে স্লোভাক পুলিশ দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আটজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে তিনজনের বিরুদ্ধে ‘হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও সংঘটিত করা’-এর অভিযোগ আনা হয়। মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করা তাঁদেরই একজন পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত জানিয়ে দেয়। ওই ব্যক্তি জিজ্ঞাসাবাদে তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী মারিয়ান কোচনারের নাম উল্লেখ করে। পরে কোচনারকেও হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। 

জ্যান কুচিয়াক ও তাঁর বাগদত্তা মার্টিনা কুশনিরোভার স্মরণে রাস্তায় নেমেছিল লাখো মানুষ

উল্লেখ্য, জ্যান কুচিয়াক মারিয়ান কোচনারের দুর্নীতি নিয়ে ব্যাপকভাবে লেখালেখি করেছিলেন। ফলে স্বভাবতই তাঁকে কোচনারের বিরাগভাজন হতে হয়। সে সময় কোচনারের পক্ষ থেকে কুচিয়াকের পরিবারকে হেনস্তা করার হুমকি দেওয়া হয় অজ্ঞাত ফোনকলে। এমনকি পরে কোচনারের বাড়িতে প্রাপ্ত একটি ইউএসবি ড্রাইভে কুচিয়াক-কুশনিরোভার ওপর নজরদারি করেছেন, কোচনার এমন প্রমাণ খুঁজে পায় পুলিশ। সে সময় পুলিশ কোচনারের ফোনে এমন কিছু বার্তা খুঁজে পায়, যা কোচনারকে কুচিয়াক-কুশনিরোভার খুনের সঙ্গে সম্পর্কিত করে। 

বিচারপর্ব
কুচিয়াক-কুশনিরোভার খুনের বিচার শুরু হয় ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে। হত্যাকাণ্ডের পুরো বিষয়টির মধ্যস্থতাকারী ও খুনি উভয়ই স্বীকারোক্তি দেন। তাঁদের সাজাও হয় যথাক্রমে ২৫ ও ১৫ বছর করে। সে সময় কোচনার, তাঁর আস্থাভাজন অ্যালেনা সুসোভা, খুনির গাড়িচালক টমাস সাবো নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। সে বছর সেপ্টেম্বরে জনাকীর্ণ এক আদালতে চূড়ান্ত রায় পড়া হয়। রায়ে বিচারক গাড়িচালক সাবোকে দোষী সাব্যস্ত করলেও প্রমাণের অভাবে কোচনার ও সুসোভাকে খালাস দেন। রায় পড়া শেষ হওয়ার আগেই ভুক্তভোগী দুই পরিবার কাঁদতে কাঁদতে আদালত ছেড়ে যায়। কিন্তু কোচনার ও সুসোভাকে খালাস দেওয়ায় দেশব্যাপী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। 

পরে মামলার কৌঁসুলিরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। পরের বছর; অর্থাৎ, ২০২১ সালে সুপ্রিম কোর্ট মামলার তদন্ত-প্রমাণ পুনর্মূল্যায়নের জন্য মামলাটি আবারও নিম্ন আদালতে ফেরত পাঠান। তবে এরই মধ্যে কোচনারকে নোট জালিয়াতিসহ আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলায় ১৯ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। 

উল্লেখ্য, আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলাটি কুচিয়াকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ফলেই সামনে এসেছিল। অন্যদিকে অ্যালেনা সুসোভাকে ২০১০ সালের এক হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে ২১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। 

ওসিসিআরপি জানায়, কুচিয়াক-মার্টিনা কুশনিরোভা হত্যাকাণ্ডের বিচার নতুন করে আবারও শুরু হবে চলতি বছরের মার্চ-এপ্রিলে। ধারণা করা হচ্ছে, এবার কোচনার ও সুসোভার বিরুদ্ধে আরও একাধিক অভিযোগ আনা হবে। এর মধ্যে, ২০১৮ সালে দুই প্রসিকিউটর ও এক আইনজীবীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগও রয়েছে। 

কুচিয়াক-কুশনিরোভা হত্যা মামলার কৌঁসুলি দলের প্রধান ও হত্যা ষড়যন্ত্রের শিকার ড্যানিয়েল লিপসিজ বলেন, ‘মামলার অভিযোগপত্র থেকে যা জানি, আমাকে খুন করার পরিকল্পনাটি প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। কিন্তু বেশি ঝুঁকি থাকায় তা স্থগিত করা হয়েছিল। তার পরপরই কুচিয়াকের হত্যার আদেশ দেওয়া হয়। যা কোচনারের জন্য অগ্রাধিকার ছিল।’ তিনি বলেন, ‘হত্যা মামলার সঙ্গে বাকি মামলাগুলো একত্র করা হলে সেগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং কোচনারকে বাকি জীবন কারাগারে কাটাতে হবে।’ 

মামলায় নতুন মোড় ও হিসাব
কোচনারের বাড়ি ও অফিসে তল্লাশির সময় পুলিশ তাঁর ল্যাপটপ, ইউএসবি ড্রাইভ, ব্যক্তিগত বন্দুক জব্দ করে। কিন্তু তাঁরা কোচনারের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি খুঁজে পায়নি। ফোন খুঁজে না পাওয়াকে কুচিয়াকের খুনের তদন্ত কর্মকর্তা জুহাস তাঁর মামলা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি দারুণ সুযোগ হারানো বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি কোচনারের আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলার তদন্তকারীর সাথে যোগাযোগ করে তাঁকে কোচনারের ফোন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, ফোনটি কোচনারের আইনজীবীর কাছে রয়েছে। আমরা অল্পের জন্য সুযোগ হাতছাড়া করেছি।’ 

তবে বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছিল। খুনের মামলার তদন্তকারীরা একটি নয়, কোচনারের দুটি ফোন পেয়েছিলেন। তাঁরা কোচনারের মোবাইলে ‘থ্রিমা’ নামে একটি ‘মেসেজ এনক্রিপশন’ অ্যাপ্লিকেশন দেখতে পান। এই অ্যাপ্লিকেশন কোচনার বহু বছর ধরেই ব্যবহার করতেন। সাধারণত স্পর্শকাতর বিষয়গুলো আলোচনার জন্য অ্যাপটি ব্যবহার করতেন তিনি। ওই অ্যাপ থেকে দেখা যায়, কোচনার এর মাধ্যমে দেশটির একাধিক বিচারক, কৌঁসুলি, ব্যবসায়ী, আইন প্রয়োগকারী বাহিনীসহ প্রচুর লোকজনের সঙ্গে স্পর্শকাতর বিষয়ে আলোচনা করতেন। তবে হত্যা মামলায় থ্রিমা অ্যাপের মাধ্যমে আদান-প্রদান করা বার্তাগুলো অন্তর্ভুক্ত না করতে কোচনারের লোকজনেরা তদন্ত কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়েছিল। 

তবে জুহাস হুমকিতে ভয় পাননি। তিনি থ্রিমা অ্যাপে আদান-প্রদান করা বার্তাগুলো মামলার এজহারে অন্তর্ভুক্ত করেন। ওই বার্তাগুলো থেকে দেশটির এক বিচারক ভ্লাদিমির স্কলেঙ্কার সঙ্গে কোচনারের সম্পর্ক আবিষ্কৃত হয়। কোচনারের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতির মামলাগুলোর মধ্যে একটি ছিল এই দুজনের কথোপকথনের ভিত্তিতেই করা। 

স্কলেঙ্কাকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ তাঁকে থ্রিমা অ্যাপে কোচনারের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন দেখানোর পর তিনি পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেন বলে জানায় ওসিসিআরপি। সংস্থাটি জানায়, স্কলেঙ্কা আদালতে ও পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে স্লোভাক বিচার বিভাগের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতির কথা বিস্তারিতভাবে জানান। এ সময় তিনি কোচনার ও তাঁর ‘লোকেরা’ অন্যান্য বিচারকদের ওপর ঘুষ প্রদানসহ কীভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল, তাও জানিয়েছিলেন। 

এর পর ২০২০ সালের মার্চে পুলিশ অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে অপারেশন ‘স্টর্ম’ ও ‘থান্ডারস্টর্ম’ শুরু করে। অভিযানে পুলিশ ১৬ জন বিচারকসহ আরও ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে চারজন অপরাধ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। বাকিদের বিচারও চলতি বছরেই করা হবে বলে আশা করছে দেশটির পুলিশ। 

জাল বিছানো হয়েছিল অনেকটাজুড়েই
কুচিয়াক ও কুশনিরোভার হত্যাকাণ্ডের পর দুর্নীতিগ্রস্ত বিচারকেরা একের পর এক ধরা পড়লেও স্লোভাকরা কেবল সেখানেই থেমে থাকেনি। তারা দেশটির পুলিশ বাহিনীকে পরিচ্ছন্ন করার আন্দোলনেও নেমেছিল। দেশটির তৎকালীন পুলিশ প্রধান টিবোর গাস্পারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হলে প্রথমদিকে তিনি সেগুলো বলপ্রয়োগের মাধ্যমে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। জনসাধারণের চাপের মুখে হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস পর পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। 

কুচিয়াকের হত্যাকাণ্ড পরিবর্তের হাওয়া এনে দিয়েছিল স্লোভাক সমাজেটিবোর গাম্পার প্রস্থানের পরপরই স্লোভাক পুলিশ তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত আরম্ভ করে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২০ সালের নভেম্বরে অপারেশন ‘পার্গেটরি’ ও ‘জুডাস’ শুরু করা হয়। ওই অভিযানে দুর্নীতি, অর্থপাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে একাধিক কর্মকর্তা, এমনকি পরপর দায়িত্বে থাকা তিন পুলিশ প্রধানকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এদের একজন বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগেই কারাগারে আত্মহত্যা করেন। কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা পরিচিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘তাকাকোভসি’-এর পক্ষ থেকেও নিয়মিত মাসোহারা পেতেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। 

তদন্তকারীরা বলছেন, ওই সব কর্মকর্তা নোরবার্ট বোডর নামে এক কুখ্যাত ব্যবসায়ী ও মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষকের কাছ থেকে কোচনারের হয়ে কাজ করে দেওয়ায় বিভিন্ন সময় টাকা নিতেন। এই নোবর্ট বোডর আবার কোচনারের সহযোগী হিসেবে পরিচিত। এসব কাজের মধ্যে কোচনারের পক্ষ থেকে কুচিয়াক ও কুশনিরোভা হত্যাকাণ্ডের তথ্যপ্রমাণ লোপাটেও অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

দেশটির নতুন পুলিশ প্রধান স্টেফান হামরান বলেন, ‘এই গোষ্ঠীকে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী অপরাধী চক্র হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে।’ শুদ্ধি অভিযানে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে তিনি জানান, তাঁর প্রথম পদক্ষেপ ছিল, কুচিয়াক ও কুশনিরোভার পরিবারকে ফোন করে পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা। তাঁর দ্বিতীয় পদক্ষেপ ছিল, সেই সব কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা, যাদের পুলিশ বাহিনীর ‘পুরোনো সিস্টেমের অংশ’ বলে মনে করতেন তিনি। সেসব জায়গায় তিনি যাদের বিশ্বাস করেন, তাঁদের দিয়ে পূরণ করেন। কিন্তু বিষয়টি তাঁর জন্য সহজ হয়নি। শুদ্ধি অভিযানে পুরোনো ব্যবস্থার অংশীজনেরা তাঁর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু দ্বন্দ্বের শেষ এখনো হয়নি। যে ১৪ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়, তাঁদের মধ্যে নয়জন অপরাধ স্বীকার করেছেন। বাকিরা এখনো লা জওয়াব। 

হামরান বলেছেন, ‘সরকারের পতন না হলে, আমি নিশ্চিত যে—আমরা পুলিশের সংস্কার আগাগোড়াই শেষ করতে পারব।’ 

পুলিশ কর্মকর্তারা যে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন, তা আইনি কৌঁসুলিদের সহায়তা ছাড়া কোনোভাবেই কার্যকর হতো না। তাই শুদ্ধি অভিযান পুলিশের গণ্ডি ছাড়িয়ে কৌঁসুলিদের গ্রেপ্তারেও বিস্তৃত হয়। ওই অভিযানে ডুসান কোভাসিক নামে এক শীর্ষস্থানীয় কৌঁসুলিও ধরা পড়েন। কোভাসিক দুর্নীতিসহ একাধিক বড় মাপের অপরাধের বিচারের দায়িত্বে ছিলেন এবং তাঁর কার্যক্রম স্বভাবতই অপরাধীদের আইনের ফাঁক গলে বের হয়ে যেতে সহায়তা করত। পরে তাঁকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগেও অভিযুক্ত করা হয়। 

পুলিশ যখন তাঁকে গ্রেপ্তার করে, তখন তাঁর বুক পকেটে নগদ ২০ হাজার ইউরো পাওয়া যায়। তবে বিচারের সময় মাফিয়া গোষ্ঠীর কাছ থেকে ৫০ হাজার ইউরো ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে তাঁকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। 

এরই মধ্যে কোভাসিকের পরিবর্তে ড্যানিয়েল লিপসিককে নিয়োগ দেওয়া হয় দেশটির প্রধান কৌঁসুলি হিসেবে। লিপসিক কুচিয়াক হত্যা মামলার কৌঁসুলি হিসেবেও কাজ করেছেন। লিপসিককে কোচনারের ব্যক্তিগত শত্রু হিসেবেও বিবেচনা করেন অনেকে। কোচনারের থ্রিমা অ্যাপের বার্তা থেকে দেখা গেছে, সেখানে লিপসিককে হত্যার হুমকি সংবলিত বার্তাও রয়েছে। 

পতন ও ফিরে আসা
বিগত ১২ বছর ধরে মতাদর্শগত দিক থেকে স্লোভাকিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল ছিল ‘এসএমইআর’, যাদের বিস্তার ছিল সারা দেশে। নানা কেলেঙ্কারি, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এসব অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধান চালানোর কারণেই কুচিয়াক ও কুশনিরোভাকে হত্যা করা হয়। 

কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডই শেষ পর্যন্ত ‘এসএমইআর’-এর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তাঁদের হত্যাকাণ্ডের পর দেশটির লাখো মানুষ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকোর পদত্যাগের দাবিতে রাস্তায় নামে। জনগণের ধারণা ছিল, কেবল প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তন হলেই সবকিছু বদলে যাবে। যা হোক, ২০১৮ সালের মার্চেই এসএমইআর নেতৃত্বাধীন সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্ট নির্বাচনসহ দেশটির রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও এসএমইআরের প্রার্থীরা হেরে যান। 

আরও পরে, ২০২০ সালে স্লোভাকিয়ায় ব্যবসায়ী ইগর মাতোভিচের নেতৃত্বে একটি জনবাদী বিরোধী দল স্লোভাকিয়ার ক্ষমতায় আসেন। সে সময় তিনি, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি’ ও ‘পুলিশকে তদন্ত করার স্বাধীনতা দেওয়ার’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা মাতোভিচ কিংবা তাঁর দলের ছিল না। ফলে কোভিড-১৯ মহামারি, ক্ষমতাসীন জোটের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনিয়ন্ত্রিত মন্তব্যের কারণে শিগগিরই তাঁর শাসনকে প্রভাবিত করেছিল। সমাজবিজ্ঞানী ভাশেকা বলেন, ‘তিনি (মাতোভিচ) একেবারেই রাজনীতি বোঝেন না।’ 

এদিকে রবার্ট ফিকো যখন রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন, তখন বলেছিলেন, তিনি ‘কোথাও যাচ্ছেন না।’ তাঁর বলার ধরনের মধ্যেই একটি অশুভ ভাব ছিল। সেই অশুভ ভাব যেন আবারও দেশটির আকাশে দেখা দেওয়া শুরু করেছে। একসময় কল্পনাতীতই মনে হতো যে, এসএমইআর আর কখনোই ফিরে আসতে পারবে না। কিন্তু সেটাই এখন অনেকটাই বাস্তব বলে মনে হচ্ছে। 

সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, একসময়ের জনধিকৃত এসএমইআর জনপ্রিয়তার তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। প্রথম স্থানে রয়েছে পিটার পেলিগ্রেনি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল হ্লাস পার্টি। 

স্লোভাক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিক ল্যাস্টিকের মতে, স্লোভাকিয়ার পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা এখনো ফিরে আসতে পারে। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ল্যাস্টিক বলেন, ‘আপনি যদি আমাকে দুই বছর আগের কথা জিজ্ঞাসা করেন, আমি বলব যে, এসএমইআর শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বর্তমানের কথা বলতে গেলে—আমি আসলে জানি না কী হয়েছে। তবে দলটির পুনরুত্থানের গল্পটি বেশ আকর্ষণীয়।’ 

ল্যাস্টিকের মত হচ্ছে, ‘সমস্যাটি কেবল রাজনৈতিক দল, বিচারক, কৌঁসুলি বা পুলিশ সদস্যদের একটি ছোট দলকে নিয়ে ছিল না। এই ব্যবস্থার শিকড় অনেক গভীরে। তবে শুরুতে পুরোনো ব্যবস্থা শেষ হয়ে গেছে বলে মনে হলেও পুরো গল্পটা আসলে অনেক বেশি জটিল।’ 

জ্যান কুচিয়াক ও মার্টিনা কুশনিরোভার হত্যার চার বছর পর, সেই পুরোনো ব্যবস্থাই হয়তো ফিরে আসার দ্বারপ্রান্তে, যা এমন হত্যার মূলে রয়েছে। জ্যানের কুচিয়াকের বাবা এসএমইআরের ফিরে আসাকে বাস্তবতা হিসেবেই দেখেন। তাঁর মতে, ‘এখানে সবকিছুই সম্ভব, এখানকার মানুষের স্মৃতিশক্তি কম। এত কিছু হয়ে যাওয়ার পরও এসএমইআর-এর রেটিং কীভাবে বাড়তে পারে? 

স্লোভাকিয়ায় পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৪ সালে। তবে বর্তমান ক্ষমতাসীন শাসকজোটের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকলে আরও আগেই নির্বাচন হতে পারে। আর সেখানে এসএমইআর ফিরে এলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। 

অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রোজেক্ট-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আবদুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়া আদেশে যা আছে

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

ইতিহাসের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে জ্যামাইকায়, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা

সন্ধ্যা থেকে বন্ধ থাকবে নির্বাচন ভবনের আশপাশের ব্যবসা কার্যক্রম

কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জরুরি অবতরণও করা যাবে না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পাইলটকে প্রলুব্ধ করে মাদুরোকে ধরার মার্কিন গুপ্ত অভিযান ফাঁস

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
বিমানের ভেতর ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। ছবি: দ্য ইনডিপেনডেন্ট
বিমানের ভেতর ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। ছবি: দ্য ইনডিপেনডেন্ট

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে ধরিয়ে দিতে তাঁর ব্যক্তিগত পাইলটকে প্রলুব্ধ করার এক রুদ্ধশ্বাস গুপ্ত অভিযানের খবর ফাঁস হয়েছে। এই অভিযানকে কোনো শীতল যুদ্ধের একটি থ্রিলার গল্পের সঙ্গে তুলনা করেছে যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ইনডিপেনডেন্ট। অভিযানটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মার্কিন ফেডারেল এজেন্ট এডউইন লোপেজ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ইনভেস্টিগেশনস (এইচএসআই) এর কর্মকর্তা ছিলেন।

ইনডিপেনডেন্টের প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেই মাসেই ডোমিনিকান রিপাবলিকের মার্কিন দূতাবাসে এক তথ্যদাতা হাজির হন। তিনি দাবি করেন, মাদুরোর ব্যবহৃত দুটি বিলাসবহুল জেট বিমান মেরামতের কাজ চলছে সান্তো ডোমিংগোর লা ইসাবেলা বিমানবন্দরে।

ওই দূতাবাসেই তখন কর্মরত ছিলেন ৫০ বছর বয়সী লোপেজ—একজন অভিজ্ঞ প্রাক্তন মার্কিন সেনা রেঞ্জার, যিনি বহু বছর ধরে মাদক ও অর্থ পাচার চক্র ধ্বংসে সুনাম কুড়িয়েছিলেন। আগন্তুকের দেওয়া তথ্য লোপেজের কৌতূহল জাগিয়েছিল। কারণ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ভেনেজুয়েলার এসব বিমানের যন্ত্রাংশ কেনা বা মেরামত করাই বেআইনি।

বিমান দুটি শনাক্ত করতে সময় লাগেনি। এর একটি ‘দাসো ফ্যালকন ২০০০ ইএক্স’ এবং অন্যটি ‘ফ্যালকন ৯০০ ইএক্স’। পরে জানা যায়, মাদুরো পাঁচজন পাইলটকে পাঠিয়েছেন বিমানগুলো ফেরত নিতে। এখানেই লোপেজের মাথায় আসে এক সাহসী চিন্তা। তিনি মাদুরোর প্রধান পাইলটকে রাজি করানোর কথা ভাবলেন, যাতে ওই পাইলট প্রেসিডেন্টকে বহন করার সময় কোনো বিমানকে এমন কোনো জায়গায় অবতরণ করান, যেখানে মার্কিন বাহিনী মাদুরোকে গ্রেপ্তার করতে পারে?

এই ভাবনা থেকেই শুরু হয় এক গুপ্তচর নাটক। ডোমিনিকান কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে লোপেজ ও তাঁর দল পাইলটদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। তাঁদের মূল টার্গেটে ছিলেন ভেনেজুয়েলার বিমানবাহিনীর কর্নেল ও মাদুরোর ব্যক্তিগত পাইলট—বিটনার ভিলেগাস। ভিলেগাস ছিলেন প্রেসিডেনশিয়াল অনার গার্ডের সদস্য, শান্ত স্বভাবের কিন্তু মাদুরোর আস্থাভাজন।

ভিলেগাসকে লোপেজ ডেকে নেন একান্ত সাক্ষাতে। কথোপকথনের একপর্যায়ে তিনি সরাসরি প্রস্তাব দেন—‘যদি আপনি গোপনে মাদুরোকে এমন কোথাও নিয়ে যান, যেখানে আমরা তাঁকে আটকাতে পারি, তাহলে আপনি হবেন ধনী ও জাতির নায়ক।’

ভিলেগাস অবশ্য এই প্রস্তাবের বিপরীতে কিছু বলেননি। তবে বিদায়ের আগে নিজের মোবাইল নম্বর দেন, যা লোপেজের মনে আশা জাগিয়েছিল।

এরপর ১৬ মাস ধরে লোপেজ গোপনে ভিলেগাসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তাঁরা এনক্রিপটেড অ্যাপে কথা বলেন, বার্তা পাঠান, এমনকি অবসরে যাওয়ার পরও লোপেজ তাঁর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু ওই পাইলটের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্র একে একে মাদুরোর দুটি বিমান জব্দ করে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমটি এবং ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয়টি বাজেয়াপ্ত হয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ডোমিনিকান রিপাবলিক সফরে গিয়ে প্রকাশ্যে বলেন, ‘এই বিমানে ভেনেজুয়েলার সামরিক গোপন তথ্যের ভান্ডার রয়েছে।’ এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় মাদুরোর সরকার এবং ‘নির্লজ্জ চুরির’ অভিযোগ করে।

লোপেজ তখনো থামেননি। তিনি ভিলেগাসকে রাজি করানোর চেষ্টা চালিয়ে যান। গত আগস্টে তিনি ওই পাইলটকে বার্তা পাঠান—‘তোমার উত্তর এখনো পাইনি।’ এই বার্তার সঙ্গে তিনি একটি সরকারি বিবৃতিও জুড়ে দেন, যেখানে মাদুরোকে ধরিয়ে দিলে ৫ কোটি ডলার পুরস্কারের ঘোষণা করা হয়। লোপেজ লেখেন, ‘এখনো সময় আছে নায়ক হওয়ার।’

কিন্তু কোনো সাড়া না পেয়ে গত মাসের (সেপ্টেম্বর) মাঝামাঝিতে তিনি তাঁর শেষ চেষ্টা করেন। সে সময় একদিন সংবাদে মাদুরোর বিমানকে আকাশে অদ্ভুত এক ঘুরপথে উড়তে দেখে লোপেজ ওই পাইলটকে বার্তা পাঠান—‘কোথায় যাচ্ছ?’ উত্তরে ভিলেগাস জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কে?’ লোপেজ পরিচয় দিলে পাইলট ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘আমরা ভেনেজুয়েলীয়রা বিশ্বাসঘাতক নই।’

তখন লোপেজ তাঁকে তাঁদের আগের সাক্ষাতের একটি ছবি পাঠান। ভিলেগাস বিস্মিত হয়ে লেখেন, ‘তুমি পাগল নাকি?’

লোপেজ জবাব দেন—‘হয়তো একটু।’ এরপর তিনি শেষবারের মতো লেখেন—‘তোমার সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।’ ভিলেগাস অবশ্য এরপরই লোপেজের নম্বরটি ব্লক করে দেন।

পাইলটকে রাজি করাতে না পেরে মার্কিন এজেন্ট ও মাদুরো-বিরোধী গোষ্ঠী অন্য কৌশল নেয়। প্রেসিডেন্ট মাদুরোকেই বিভ্রান্ত করতে চান তাঁরা। এ ক্ষেত্রে ভিলেগাসের জন্মদিনে সাবেক মার্কিন নিরাপত্তা কর্মকর্তা মার্শাল বিলিংসলি টুইটারে ব্যঙ্গাত্মক শুভেচ্ছা জানান এবং ভিলেগাসের দুটি ছবি পোস্ট করেন। এর মধ্যে একটি ছবিতে দেখা যায়—লোপেজের সঙ্গে ভিলেগাসের পুরোনো সাক্ষাতের মুহূর্ত।

এই টুইট বার্তাটি দ্রুত ভাইরাল হয়ে পড়ে। ভেনেজুয়েলায় গুজব ছড়ায়—পাইলটকে নাকি জেরা করা হচ্ছে কিংবা আটক করা হয়েছে। এই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই ভেনেজুয়েলার টেলিভিশনে হাজির হন ভিলেগাস। তাঁর পাশে ছিলেন তখন দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী দিয়োসদাদো কাবেলো। কাবেলো হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমাদের সৈনিকেরা বিক্রি হয় না।’ পাইলট ভিলেগাস চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন, মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করে মাদুরোর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

লোপেজের দুঃসাহসী এই পরিকল্পনা রয়ে গেছে ইতিহাসের আড়ালে এক অসম্পূর্ণ অধ্যায় হিসেবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়া আদেশে যা আছে

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

ইতিহাসের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে জ্যামাইকায়, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা

সন্ধ্যা থেকে বন্ধ থাকবে নির্বাচন ভবনের আশপাশের ব্যবসা কার্যক্রম

কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জরুরি অবতরণও করা যাবে না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইউক্রেনে সাধারণ মানুষের ওপর রাশিয়ার ড্রোন হামলা যুদ্ধাপরাধ: জাতিসংঘ প্রতিবেদন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
ছবি: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার ড্রোন হামলাগুলোকে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘের স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন ‘ইন্ডিপেনডেন্ট ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব ইনকোয়ারি অন ইউক্রেন’। সম্প্রতি প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রুশ সেনারা পরিকল্পিতভাবে বেসামরিক মানুষ ও তাদের অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালিয়েছে।

মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক গার্ডিয়ান জানিয়েছে, জাতিসংঘের সংস্থাটি খেরসন, মাইকোলাইভ ও দিনিপ্রোপেত্রোভস্ক অঞ্চলে হামলার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করেছে। এই এলাকাগুলো সম্মুখ সমরের কাছাকাছি হওয়ায় গত এক বছরে সেখানে ড্রোন হামলার তীব্রতা বেড়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—রুশ ড্রোনগুলো ধারাবাহিকভাবে ঘরবাড়ি, মানবিক সহায়তা বিতরণ কেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। একই স্থানে একাধিকবার হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

রাশিয়া বিভিন্ন ধরনের কম দামি ও ছোট আকারের, ক্যামেরা ও গাইডেন্স সিস্টেমযুক্ত ড্রোন ব্যবহার করেছে। এগুলোর কিছু আঘাতের সময় বিস্ফোরিত হয়, আবার কিছু ওপর থেকে বিস্ফোরক ফেলতে পারে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, এই ধরনের হামলায় গত এক বছরে অন্তত ২০০ বেসামরিক মানুষ নিহত এবং প্রায় ২ হাজার জন আহত হয়েছেন।

জাতিসংঘ কমিশন দাবি করেছে, এসব হামলা শুধু হত্যাকাণ্ড নয়, বরং ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক জনগণকে লক্ষ্যবস্তু করার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে। একই সঙ্গে বেসামরিকদের এলাকা ছাড়তে বাধ্য করার নীতির অংশ হিসেবেও এগুলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

প্রতিবেদনটিতে খেরসনের একাধিক বাসিন্দার বর্ণনা উদ্ধৃত করা হয়েছে। একজন বলেছেন, ‘আমি ড্রোনের শব্দ শুনেছিলাম। ভেবেছিলাম, এটি একটি বাসকে অনুসরণ করবে। কিন্তু যখন বাস চলে গেল, তখনো সেটা আকাশে ঘুরছিল। বুঝলাম, পালানোর কোনো পথ নেই।’ পরে ড্রোন থেকে ওই ব্যক্তির মুখে শার্পনেলের আঘাত লেগেছিল।

আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘এটা এক ধরনের লটারির মতো, আজ রাতটা বেঁচে থাকব কি না, কেউ জানে না।’

এদিকে রাশিয়া বরাবরই বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তবে গত চার বছরে ইউক্রেনজুড়ে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলায় অসংখ্য বেসামরিক এলাকা ধ্বংস হয়েছে। রুশ কর্তৃপক্ষ জাতিসংঘ কমিশনের তদন্তেও কোনো সহযোগিতা করেনি, এমনকি ৩৫টি লিখিত অনুরোধেরও জবাব দেয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়া আদেশে যা আছে

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

ইতিহাসের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে জ্যামাইকায়, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা

সন্ধ্যা থেকে বন্ধ থাকবে নির্বাচন ভবনের আশপাশের ব্যবসা কার্যক্রম

কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জরুরি অবতরণও করা যাবে না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জানা গেল ১৩ বছর আগে সিরিয়ায় নিখোঁজ সাংবাদিক অস্টিনের ভাগ্যে কী ঘটেছিল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ২১: ০৭
ছবি: সিএনএন
ছবি: সিএনএন

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের উপকণ্ঠে মাউন্ট কাসিউনের পাথুরে ঢালে লুকিয়ে আছে এক রহস্যময় সামরিক অঞ্চল। গত মাসে (সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআই-এর নেতৃত্বে একটি দল সেখানে পৌঁছেছিল মার্কিন সাংবাদিক অস্টিন টাইসের সন্ধানে। ২০১২ সালে সিরিয়ায় নিখোঁজ হয়ে বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিলেন অস্টিন। ১৩ বছর পরও তাঁর পরিবার আশায় আছে—তিনি হয়তো এখনো বেঁচে আছেন।

তবে এবার প্রথমবারের মতো সিরিয়ার সাবেক এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মুখ থেকে শোনা গেল নির্মম সত্যটি—অস্টিন নিশ্চিতভাবেই মারা গেছেন।

সোমবার (২৮ অক্টোবর) সিএনএন জানিয়েছে, এই স্বীকারোক্তি এসেছে বাসাম আল-হাসান নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে, যিনি সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা এবং ভয়ংকর ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্সেস’ (এনডিএফ) মিলিশিয়া সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। আল-হাসানই ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি ২০১২ সালের আগস্টে অস্টিন টাইসকে আটক করার পর তাঁর দেখাশোনা করতেন।

আসাদ সরকারের পতনের পর সত্য উদ্‌ঘাটন

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আসাদ সরকারের পতনের পর সিরিয়ার বিভিন্ন প্রাক্তন কর্মকর্তা একে একে আত্মপ্রকাশ করতে থাকেন। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন আল-হাসান। তিনি ইরান থেকে পালিয়ে লেবাননের বৈরুতে এসে আশ্রয় নেন। পরে এফবিআই তদন্তকারীরা সেখানেই হাজির হন এবং তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন।

এরপর গত মাসে (সেপ্টেম্বর) বৈরুতে আল-হাসানের ফ্ল্যাটে পৌঁছে যায় সিএনএন-এর একটি দলও। গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যায়, আল-হাসান বলছেন, ‘অস্টিন অবশ্যই মৃত। আমি নিজেই আসাদের আদেশে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করিয়েছিলাম।’

তিনি দাবি করেন, ২০১৩ সালে স্বয়ং বাশার আল-আসাদই তাঁকে নির্দেশ দেন অস্টিনকে হত্যা করতে। তবে তিনি নাকি আপত্তি জানিয়েছিলেন, কিন্তু আসাদ ছিলেন অনড়।

অবিশ্বাস ও সন্দেহ

সিএনএনকে আল-হাসান যে তথ্য দিয়েছেন সেগুলো পরে আরও যাচাই করা হয়েছে এবং এফবিআইয়ের পলিগ্রাফ টেস্টে তিনি ব্যর্থ হন। অর্থাৎ তাঁর কথার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তবু তাঁর এই বক্তব্যই এখন পর্যন্ত অস্টিন টাইসের মৃত্যুর সবচেয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত।

অনেকে মনে করেন, সত্যটি এখনো জটিল এক জালের ভেতরে লুকিয়ে আছে—যেমনভাবে আসাদের শাসন দীর্ঘ এক দশক ধরে নিজের জনগণকে হত্যা ও নিখোঁজ করেছে।

অস্টিনের খোঁজে সিএনএন অন্তত সাতটি দেশে গিয়ে সিরিয়ার সাবেক কিছু কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এঁদের মধ্যে আছেন প্রত্যক্ষদর্শী ও তদন্তকারীও। তাঁরা জানিয়েছেন, অস্টিনের দেহাবশেষ এখনো পাওয়া না গেলেও ২০১৩ সালের দিকেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।

বাসাম আল-হাসান, যার কাছে বন্দী ছিলেন অস্টিন। ছবি: সিএনএন
বাসাম আল-হাসান, যার কাছে বন্দী ছিলেন অস্টিন। ছবি: সিএনএন

কে ছিলেন অস্টিন টাইস

অস্টিন টাইস ছিলেন মার্কিন মেরিন বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এবং সাংবাদিক। ২০১২ সালে তিনি সিরিয়ায় যান গৃহযুদ্ধের সত্যতা তুলে ধরতে। তিনি দামেস্কের উপকণ্ঠ দারায়া থেকে তাঁর শেষ প্রতিবেদন পাঠান। এরপরই তাঁর সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

সেই সময় দারায়ায় প্রবল যুদ্ধ চলছিল। বিদ্রোহীদের সঙ্গে থেকে তিনি আসাদ সরকারের দমননীতি তুলে ধরছিলেন। ওয়াশিংটন পোস্টসহ একাধিক পত্রিকায় তাঁর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

নাটকীয় বন্দিত্ব ও ভিডিও

সিরিয়ার গোয়েন্দা কর্মকর্তা সাফওয়ান বাহলুল জানিয়েছেন, তিনিই অস্টিনকে তিনবার জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। সাফওয়ান বলেন, ‘অস্টিন শান্ত ছিলেন, সাহসী ছিলেন। কখনো কখনে আমরা সংগীত নিয়েও কথা বলেছি।’

পরবর্তীতে আল-হাসানের নির্দেশে অস্টিনকে ‘তাহৌনে’ নামের এক সামরিক ক্যাম্পে বন্দী রাখা হয়। এখানেই ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি ভিডিও ধারণ করা হয়। সেই ভিডিওতে অস্টিনকে দেখা যায় আরব পোশাক পরা লোকদের মাঝে, যারা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করছে। ভিডিওটি ইচ্ছাকৃতভাবে তৈরি করা হয় যেন মনে হয়, তাঁকে ইসলামপন্থীরা অপহরণ করেছে—আসাদ বাহিনী নয়। তবে মার্কিন বিশ্লেষকেরা দ্রুতই বুঝে ফেলেছিলেন, এটি আসলে সিরীয় সরকারেরই সাজানো নাটক।

অস্টিনকে বিদ্রোহী ইসলামপন্থীরা বন্দী করেছে প্রমাণ করতে তাঁর চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি ভিডিও তৈরি করেছিল আসাদের বাহিনী। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া
অস্টিনকে বিদ্রোহী ইসলামপন্থীরা বন্দী করেছে প্রমাণ করতে তাঁর চোখ বাঁধা অবস্থায় একটি ভিডিও তৈরি করেছিল আসাদের বাহিনী। ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

পালানোর চেষ্টাও করেছিলেন অস্টিন

তদন্তে জানা যায়, একসময় অস্টিন সাবান ও তোয়ালে ব্যবহার করে জানালা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। তিনি কিছু দূর পালাতেও সক্ষম হন, কিন্তু পরের দিন দামেস্কের মাজ্জে এলাকায় আবার ধরা পড়ে যান। এরপর তাঁকে আবারও আল-হাসানের অফিসে নেওয়া হয় এবং সেখানেই চিরদিনের জন্য তাঁর সব খোঁজ মিলিয়ে যায়।

পরিবারের অটল বিশ্বাস

সিরীয় কর্মকর্তাদের অনেকেই অস্টিনের মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করলেও তাঁর মা ডেবরা টাইস এখনো বিশ্বাস করেন ছেলে বেঁচে আছেন। তিনি বলেন, ‘অস্টিন টাইস জীবিত। আমরা তাঁর মুক্তির অপেক্ষায় আছি।’

আসাদের পতনের পর ডেবরা টাইস নিজেই দামেস্কে গিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সঙ্গে দেখা করেছেন। ডেবরা বহু বছর ধরে মার্কিন সরকারকে ছেলের খোঁজে তৎপর থাকার আহ্বান জানিয়ে আসছেন।

আল-হাসান—এক অন্ধকার চরিত্র

আল-হাসান আসাদের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। তিনি ২০১১ সালেই যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েন এবং ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রও তাঁকে নিষিদ্ধ করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারে জড়িত ছিলেন এবং সরকারবিরোধীদের ওপর হত্যাযজ্ঞে নেতৃত্ব দেন।

২০২৩ সালে ফ্রান্স তাঁর ও আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

শেষ কথায় অনুতাপ

বৈরুতে সিএনএনের দল চলে আসার আগে দরজার কাছে এসে আল-হাসান থেমে যান। চোখ লালচে হয়ে ওঠে তাঁর। তিনি বলেন, ‘এটা মনে পড়লেই কষ্ট হয়। এমনটা ঘটুক, চাইনি আমি। অস্টিনের মায়ের কাছে আমি ক্ষমা চাই।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়া আদেশে যা আছে

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

ইতিহাসের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে জ্যামাইকায়, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা

সন্ধ্যা থেকে বন্ধ থাকবে নির্বাচন ভবনের আশপাশের ব্যবসা কার্যক্রম

কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জরুরি অবতরণও করা যাবে না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে হত্যায় অভিযুক্তের স্বীকারোক্তি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
২০২২ সালে পশ্চিম জাপানের নারা শহরে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ছবি: বিবিসি
২০২২ সালে পশ্চিম জাপানের নারা শহরে দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ছবি: বিবিসি

জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত তেতসুয়া ইয়ামাগামি আদালতে দোষ স্বীকার করেছেন। টোকিওতে সোমবার (২৮ অক্টোবর) বিচার শুরুর প্রথম দিনেই আদালতকে তিনি বলেন, ‘সবকিছু সত্যি।’

২০২২ সালে পশ্চিম জাপানের নারা শহরে একটি নির্বাচনী প্রচারসভায় ঘরে তৈরি বন্দুক দিয়ে শিনজো আবেকে গুলি করেন ৪৫ বছর বয়সী ইয়ামাগামি। গুলিবিদ্ধ হয়ে ওই দিনই হাসপাতালে মারা যান জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। তাঁর মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল।

‘আবেনোমিকস’ নামে পরিচিত অর্থনৈতিক নীতির প্রণেতা এবং কট্টর পররাষ্ট্রনীতির জন্য খ্যাত শিনজো আবেকে হত্যার পর রাজনৈতিকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ঘটনাটির পর প্রকাশ্যে আসে শাসক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ও ইউনিফিকেশন চার্চের (যা ‘মুনিজ’ নামেও পরিচিত) ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

ইয়ামাগামি তদন্তকারীদের জানান, তিনি আবেকে গুলি করেছিলেন কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, আবে ওই ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়েছেন, যার কারণে তাঁর মা ও পরিবার আর্থিকভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। ইয়ামাগামির অভিযোগ, ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রমাণ হিসেবে তাঁর মা ওই চার্চে প্রায় ১০ কোটি ইয়েন (প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার) দান করেছিলেন।

এই অভিযোগের পর চার্চের কর্মকাণ্ড নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিষ্ঠিত এবং গণবিবাহের জন্য পরিচিত এই সংগঠনটির বিরুদ্ধে তদন্তের একপর্যায়ে জাপানের চার মন্ত্রী পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে চলতি বছরের মার্চে টোকিও আদালত ইউনিফিকেশন চার্চকে বিলুপ্তির আদেশ দেন, তাদের করমুক্তির সুবিধা বাতিল করেন এবং সম্পত্তি বিক্রির নির্দেশ দেন।

জাপান টাইমসের বরাতে সোমবার (২৮ অক্টোবর) বিবিসি জানিয়েছে, এত কিছুর পরও ইয়ামাগামির মা তাঁর বিশ্বাস থেকে সরে আসেননি। তিনি স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড আমার বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করেছে।’

ইয়ামাগামির বিচার আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তিনি অস্ত্র আইন ভঙ্গের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর আইনজীবীর দাবি, অভিযুক্তের তৈরি বন্দুকটি জাপানের প্রচলিত অস্ত্র সংজ্ঞার আওতায় পড়ে না।

জাপানে অস্ত্র সহিংসতার ঘটনা খুবই কম। শিনজো আবে হত্যার পর থেকে দেশটিতে ঘরে তৈরি বন্দুকের ওপর আরও কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের খসড়া আদেশে যা আছে

বিএনপি নেতার ব্যানার টানানো নিয়ে গোলাগুলি, যুবদল কর্মী নিহত

ইতিহাসের ‘সবচেয়ে শক্তিশালী’ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাচ্ছে জ্যামাইকায়, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা

সন্ধ্যা থেকে বন্ধ থাকবে নির্বাচন ভবনের আশপাশের ব্যবসা কার্যক্রম

কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জরুরি অবতরণও করা যাবে না

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত