Ajker Patrika

নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার আঘাত যেভাবে ভেঙে দিয়েছে মাতৃত্বের ধারণা

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ৪৬
পারমাণবিক হামলায় বেঁচে যাওয়া ১০১ বছরের নারী কিকুয়ো নাকামুরা।
পারমাণবিক হামলায় বেঁচে যাওয়া ১০১ বছরের নারী কিকুয়ো নাকামুরা।

কিকুয়ো নাকামুরা—১০১ বছর বয়সী এই নারী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক হামলায় বেঁচে যাওয়াদের একজন। কিন্তু বেঁচে গিয়ে যে জীবন তিনি কাটিয়েছেন, তা কোনো দিক থেকে সুখকর ছিল না। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের কাছে সেই গল্পই করেছেন তিনি।

২০০৩ সালে তাঁর বড় ছেলে হিরোশির পিঠে ফুসকুড়ির মতো কিছু উঠতে শুরু করে। দেখতে সাধারণ ঘামাচির মতো হলেও নাকামুরা ছেলেকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে বলেন। কারণ, পরে আফসোস করার চেয়ে আগেভাগে সতর্ক থাকাই ভালো। দেরি না করে ফুসকুড়ি চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে যান ৫৫ বছর বয়সী হিরোশি। নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায়, হিরোশি চতুর্থ স্তরের লিউকোমিয়ায় (রক্তের ক্যানসার) ভুগছেন। চিকিৎসকেরা বললেন, পারমাণবিক বোমা হামলার সময় নাকামুরার শরীরে যে তেজস্ক্রিয়তা প্রবেশ করেছিল, তা বুকের দুধের মাধ্যমে হিরোশির শরীরেও প্রবেশ করেছে। আর তা থেকে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে হিরোশি।

নিজের জন্য সন্তানের শরীরে মরণব্যাধি বাসা বেঁধেছে—একজন মায়ের জন্য এটি কতটা বেদনাদায়ক হতে পারে! কিকুয়ো নাকামুরা বলেন, ‘হিরোশির মৃত্যুর পর থেকে আমার মনে হতে শুরু করল, আমিই ওকে খুন করেছি। আমার মধ্যে প্রচণ্ড অপরাধবোধ কাজ করে। চিকিৎসক সেদিন যা বলেছিলেন, তা আমি আজও বিশ্বাস করি। ওই অপরাধবোধ এখনো আমাকে তাড়া করে।’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যাঁরা পারমাণবিক বিকিরণের সংস্পর্শে এসেছিলেন, বিস্ফোরণের পরপরই তাঁদের সন্তানকে স্তন্য পান করানো বন্ধ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পারমাণবিক বোমা থেকে বেঁচে যাওয়া প্রথম প্রজন্মের ‘হিবাকুশা’দের (বোমায় আক্রান্ত ব্যক্তি) শরীরে বিকিরণের প্রভাব বহু বছর পর তাঁদের সন্তানের মধ্যে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়—এমন দাবির পক্ষে এখনো স্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি।

সিএনএনকে নাকামুরা জানিয়েছেন, তিনি বিস্ফোরণের স্থান থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ২১ বছর। ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট সকালে তিনি বারান্দায় কাপড় মেলছিলেন। হঠাৎ বিকট আওয়াজ আর কম্পন অনুভব করেন তিনি। একটা বড় আলোর ঝলকানি দেখতে পান। প্রচণ্ড বাতাসে উড়িয়ে নেওয়ার দশা। এর পরপরই জ্ঞান হারান। যখন জ্ঞান ফেরে, দেখতে পান, তাঁর বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তবে তিনি ও তাঁর বাড়িতে থাকা কেউই শারীরিকভাবে কোনো আঘাত পাননি। জ্ঞান ফেরার পর যত দ্রুত সম্ভব আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যান তাঁরা।

নাকামুরা জানান, বিকিরণজনিত কোনো সমস্যা কখনো হয়নি তাঁর। ওই ঘটনার চার বছর পর তাঁর পেটে একটা টিউমার ধরা পড়ে। তবে চিকিৎসকেরা তাঁকে নিশ্চিত করেছিলেন যে এর সঙ্গে তেজস্ক্রিয়তার কোনো সম্পর্ক নেই। নাকামুরা জানান, বিস্ফোরণের ওই ঘটনায় তাঁর কোনো দোষ না থাকলেও তিনি সব সময় এ নিয়ে অপরাধবোধে ভোগেন। যেন এটা কোনো লজ্জার বিষয়। বিস্ফোরণের পরও বেঁচে যাওয়াটা যেন তাঁর জীবনের একটা কলঙ্ক। জানান, তিনি সব সময় আতঙ্কিত থাকতেন যে তাঁর এই কলঙ্ক নাতি-নাতনিদের জীবনকেও কলঙ্কিত করবে।

নাকামুরা বলেন, ‘আমি তো বিস্ফোরণের পর থেকে ব্যাপারটি নিয়ে খুব ভয় আর লজ্জায় ছিলাম। ছেলের মৃত্যু সেটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি নিশ্চিত, সবাই যদি জানত—আমি পারমাণবিক বোমা হামলায় বেঁচে গেছি আর তারপর আমার ছেলে ক্যানসারে মারা গেছে, তাহলে আমার নাতি-নাতনিদের বিয়ে হতো না। সবাই ভাবত, ওরাও বুঝি তেজস্ক্রিয়তা বয়ে বেড়াচ্ছে।’

অবশেষে ছেলের মৃত্যুর তিন বছর পর তিনি এটি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করার সাহস পেয়েছেন।

শুধু নাকামুরা নন, এমন অভিজ্ঞতার শিকার অনেকে। পারমাণবিক হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের অনেকে ছিলেন অল্পবয়সী নারী, যাঁরা বোমা হামলার সময় গর্ভবতী বা সন্তান ধারণের উপযুক্ত বয়সে ছিলেন। কিন্তু তাঁদের শরীর থেকে সন্তানের শরীরে তেজস্ক্রিয়তা প্রবেশ করতে পারে, এই ভয়ে একপ্রকার ধ্বংসই হয়ে গেছে তাঁদের জীবন। চিকিৎসক, পরিচিতজন, বন্ধুবান্ধব এমনকি পরিবারের লোকেরাও তাঁদের সন্তান জন্মদানে নিরুৎসাহিত করতেন। এমনকি অনেকের বিয়েও আটকে যায় এ কারণে।

পারিবারিক ফটো অ্যালবামে হিরোশির ছবি দেখাচ্ছেন নাকামুরা।
পারিবারিক ফটো অ্যালবামে হিরোশির ছবি দেখাচ্ছেন নাকামুরা।

বাংলাদেশের মতো জাপানেও একজন নারীর সামাজিক মূল্য কেমন হবে, তা নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে বিয়ে ও মাতৃত্বের মতো বিষয়গুলো। এমন একটি সমাজে তেজস্ক্রিয়তাসংক্রান্ত এই ধারণাগুলো নারীর জীবনকে বেশ জটিল ও বিষণ্ন করে তুলেছিল। প্রায়ই তাঁদের বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। তাই অনেকেই পোস্ট ট্রমাটিক ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন। যে কারণে ‘হিবাকুশা’ (পারমাণবিক হামলায় বেঁচে যাওয়া মানুষ) পরিচয় গোপন রাখতে হয়েছে তাঁদের।

তবে হিবাকুশাদের সন্তানেরা কি আসলেই তেজস্ক্রিয়তার ভুক্তভোগী হতে পারে? গবেষণা বলছে, হিরোশিমা ও নাগাসাকির পারমাণবিক বোমা হামলার বিকিরণ শুধু তাৎক্ষণিকভাবে নয়, বরং প্রজন্মগতভাবেও ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। যেসব নারী বিশেষত বিস্ফোরণের সময় যাঁরা গর্ভবতী ছিলেন, যাঁদের ভ্রূণের বয়স ছিল পঞ্চম সপ্তাহ থেকে ১৫তম সপ্তাহ পর্যন্ত—তাঁদের সন্তানদের বুদ্ধিবৃত্তিক অক্ষমতা, স্নায়বিক জটিলতা ও মাইক্রোসেফালি (অস্বাভাবিক ছোট মাথা ও মস্তিষ্কের বিকাশহীনতা) হওয়ার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। জাপান-যুক্তরাষ্ট্র যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত রেডিয়েশন ইফেক্টস রিসার্চ ফাউন্ডেশনের দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য।

শুধু সন্তানই নয়, নারী হিবাকুশাদের নিজেদেরও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি ছিল উল্লেখযোগ্য। ২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, পারমাণবিক বোমার বিকিরণ জীবনের বাকি সময়জুড়ে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা যায়, ৩০ বছর বয়সে প্রতি গ্রে (বিকিরণ শোষণের একক) মাত্রায় নারীদের ৭০ বছর বয়সে সলিড ক্যানসারের ঝুঁকি ৫৮ শতাংশ বাড়ে, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ৩৫ শতাংশ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত