Ajker Patrika

‘হিজড়া’ নয়

আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩: ৩৮
‘হিজড়া’ নয়

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন হঠাৎ সকালবেলা এক বন্ধুর খুদেবার্তায় ফোনটা কেঁপে উঠল। একটি গণমাধ্যমের অনলাইন ভার্সনের ছবি, অর্থাৎ স্ক্রিনশট ভেসে উঠেছে ফেসবুক মেসেঞ্জারের ইনবক্সে। সহজেই বোঝা গেল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটার তথ্যসংক্রান্ত ছবি এটা। সেখানে মোট নারী ও পুরুষ ভোটারের সঙ্গে ‘হিজড়া’ ভোটারের সংখ্যাটাও উল্লেখ আছে। খুব ভালো কথা, মানুষ হিসেবে তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিরা ভোট দিতে পারবেন।

তবে আমার বন্ধু ছবিটা পাঠিয়েছে অন্য কারণে। ‘হিজড়া’ শব্দটায় তাঁর আপত্তি প্রকাশ করে লিখেছে, ‘এখানে এভাবে “হিজড়া” না লিখে “তৃতীয় লিঙ্গ” লিখতে পারত। লেখাটা খুব অশোভনীয় লাগছে।’

হ্যাঁ, অশোভন লাগাটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে, সবখানেই ‘হিজড়া’ শব্দটা একরকম গালি হিসেবে বিবেচিত হয়। বলা যায়, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের উপহাস করে ‘হিজড়া’ ডাকা হয়। আমাদের মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে হিজড়া শব্দটি নেতিবাচক।

যা হোক, বন্ধুকে জানালাম, ভোটার তালিকায় ‘হিজড়া’ লেখা আছে বিধায় ওই গণমাধ্যম তথ্য অবিকৃত রেখেছে।

পরদিন আজকের পত্রিকার খবরে প্রকাশ হলো, চারজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ‘হিজড়া’ হিসেবে নিবন্ধিত হয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দিতে পেরেছেন। তবে ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে তাঁদের। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে অন্য ভোটারদের কটূক্তি সহ্য করেও দমে যাননি। নিজ পরিচয়ে তাঁরা ভোট দিয়েছেন। অন্য আরও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ভোট দিয়েছেন এই নির্বাচনে। তবে নিজ পরিচয়ে নয়, নারী ভোটার হিসেবে।

বুঝতে পারছেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নিজেকে কতটা অনিরাপদ মনে করলে কিংবা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেললে নারী ভোটার হিসেবে ভোট দিয়েছেন? এর জন্য কি এই সমাজ দায়ী নয়?

আচ্ছা যদি এমন হতো, একজন তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে জন্মগ্রহণের পর পরিবার থেকেই তাঁকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা, স্কুল-কলেজে পাঠানো, পেশা বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া, আর দশটা সন্তানের মতোই বাবা-মায়ের ভালোবাসা পেয়ে বেড়ে ওঠার; তাহলে কিন্তু জায়গায় জায়গায় ‘হিজড়া’ বলে তাঁদের কেউ কটাক্ষ করত না। তাঁদের আত্মবিশ্বাস হারাত না। পথে পথে পথচারীদের ‘ভয়’ দেখিয়ে জীবিকা অর্জন করতে হতো না। করতে হতো না কারও বিয়ের আসরে গিয়ে নাচ-গান কিংবা নবজাতক শিশুকে কেড়ে নেওয়ার হুমকি দিয়ে ‘টু-পাইস’ কামিয়ে নিতে।

ইদানীং তৃতীয় লিঙ্গের অনেক মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের নজরুল ইসলাম ঋতু। সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করে, সমাজের কটু কথাকে থোড়াই পাত্তা দিয়েছেন ঋতুর মতো মানুষেরা। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না একটা সভ্য সমাজে। মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার কথা ছিল। স্বাভাবিক নিয়মে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জীবনযাপন করার কথা ছিল। অথচ তাঁদের আমরা ‘হিজড়া’ বলে উপহাস করি।

অনেক দেরিতে হলেও সময় বদলাচ্ছে। রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারছেন, ভোট দিতে পারছেন। এ জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। তবে নথিপত্রে যেন ‘হিজড়া’ শব্দটির পরিবর্তে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ ব্যবহার করা হয়, এ আশাও থাকবে।

আর হ্যাঁ, শুধু নারী-পুরুষ মিলে সমাজ হয় না, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও এই সমাজের বাসিন্দা। এ কথাটাই সবার মস্তিষ্কে গেঁথে যাওয়া ভালো, গালি হিসেবে ‘হিজড়া’ কথাটা নয়।

একটা ছোট ঘটনা দিয়ে শেষ করি। শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। রিকশা পাচ্ছি না গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। এমন সময় আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন এক তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি। তাঁকে কোনো রিকশাচালকই যাত্রী হিসেবে নিতে চাইলেন না। অগত্যা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিটি তাঁর ‘হিজড়া’ চরিত্র ধারণ করে জোর খাটিয়ে এক রিকশায় উঠলেন। চেয়ে রইলাম তাঁর চকচকে চোখের দিকে, যতক্ষণ তাঁকে দেখা গেল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত