Ajker Patrika

শরদিন্দুর স্টাইল

আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩: ৪০
শরদিন্দুর স্টাইল

উকিলবাবুর বাড়ির আলমারি ঠাসা বইপত্তর, নামকরা সব সাহিত্য পত্রিকায়। কম বয়সেই সেসব পড়তে শুরু করেছিলেন উকিলবাবুর ছেলে। প্রথম দিকে ইংরেজি বইটই পড়তেন। ওই বয়সে বাংলা চলতি উপন্যাস পড়া নিষেধ ছিল তাঁর। তবু লুকিয়েটুকিয়ে কিছু পড়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু ভালো লাগেনি। প্রথম মুগ্ধ হয়েছিলেন রমেশচন্দ্র দত্ত পড়ে। পনেরো বছর বয়সে তাঁর মন জুড়ে রইল বঙ্কিমচন্দ্র। স্কুলে পড়ার সময় প্রাইজের লোভে কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। ম্যাট্রিকের পর মামাবাড়ি বেড়াতে গেলে তাঁকে পেয়ে বসে গল্প লেখার ঝোঁক। সেই থেকে শুরু।

১৯৭০ সালের আজকের এই দিনে তিনি মারা যান। বলছি, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। হ্যাঁ, সেই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই বলছি, বাংলা সাহিত্যে যিনি একজন শখের গোয়েন্দার সৃষ্টি করেছিলেন—ব্যোমকেশ বক্সী। শরদিন্দুর অমর চরিত্র যে এই ব্যোমকেশ বক্সী, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর সে জন্যই তিনি কিংবদন্তি এবং আজও তাঁর ব্যাপারে আলোচনা করাটা অপ্রাসঙ্গিক নয়।

অনেকের হয়তো নজর এড়িয়ে গেছে যে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু ব্যোমকেশ সিরিজের গোয়েন্দা উপন্যাসই লেখেননি, অন্যান্য উপন্যাস আর গল্পও আছে, অভিনয় করেছেন থিয়েটারে, লিখেছেন চিত্রনাট্য। ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, টেনিস, বাস্কেটবল, ভলিবল—কোনো খেলা খেলতে বাদ রাখেননি। কিন্তু বাবা তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ডাকসাইটে উকিল চেয়েছিলেন ছেলেও আইনজীবী হোক। ওকালতি শুরু করলেও সাহিত্যের দিকে যে টান ছিল, তা দমাতে পারেননি শরদিন্দুবাবু। বাবাও বুঝতে পারলেন, এ ছেলেকে দিয়ে ওকালতি সম্ভব নয়। এরপর পুরোপুরি সাহিত্যের পথ ধরলেন শরদিন্দু।

১৯১৫ সালে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন। কলকাতার হোস্টেলে থাকাকালে বন্ধুত্ব হয় অজিত সেনের সঙ্গে। বন্ধু অজিতই শরদিন্দুকে সাহিত্যচর্চার জন্য ব্যাপক উৎসাহ দিতেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৮ সালে সামরিক প্রশিক্ষণ শিবিরে ভর্তি হন শরদিন্দু। অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। শিবির থেকে ফিরে বাবার পছন্দ করা কনেকে বিয়ে করলেন। এরপর বের করলেন কবিতার বই ‘যৌবন স্মৃতি’ (১৯১৯)। বাবার জন্য ওকালতি পড়া ও করা ধরলেও এ পেশায় নিজেকে বেখাপ্পাই প্রমাণ করলেন শরদিন্দু। ওকালতি জীবনে বসুমতী পত্রিকায় ছাপা হলো তাঁর প্রথম গল্প ‘উড়ো মেঘ’। এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলেন, সাহিত্যসাধক হবেন। হয়তো খুব বেশি রোজগার হবে না, কিন্তু তাতেও চলবে। কারণ, বাবার ব্যবসাটা ভালোই চলছিল।

ধীরে ধীরে লেখা ছাপা হয়। সাহিত্যিক-সম্পাদক বন্ধুদের মাঝে নাম হতে থাকে। এর মাঝে ১৯৩২ সালে প্রথম তিনি সৃষ্টি করেন সেই কালজয়ী চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সী। এবার তারিফ না করলেই নয়। তারিফটা অবশ্য করতে হয় লেখকের, ব্যোমকেশের নয়। তিনি ব্যোমকেশকে সময়ের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আর সবার মতোই ব্যোমকেশের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো রাখেননি। অন্যান্য গোয়েন্দা চরিত্রের মতো ব্যোমকেশকে অবিবাহিত রাখেননি। আর দশটা সাধারণ বাঙালি নাগরিকের মতোই ব্যোমকেশকে বিয়ে দিয়েছেন, বাবা বানিয়েছেন। তাকে বয়সে বেঁধে রাখেননি। উপার্জন অনুযায়ী ব্যোমকেশকে কখনোই গাড়ি দিতে চাননি লেখক। প্রফুল্লচন্দ্র গুপ্তের হাজার অনুরোধের পর তিনি ভেবেছিলেন একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি ব্যোমকেশের পরিবারের জন্য ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু যে গল্পটায় তিনি গাড়ির ব্যবস্থা করতেন, সেটা আর শেষ করতে পারেননি। তিনি বারবার বলেছিলেন, ব্যোমকেশের কোষ্ঠীতে গাড়ি নেই। তিনি ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাস করতেন বলেই কি এর প্রমাণ দিলেন কি না, কে জানে!

বাবার ব্যবসা যখন একটু পড়তির দিকে, তখন শরদিন্দুর টাকার প্রয়োজন, পরিবার বড়, দায়দায়িত্ব বেশি। ঠিক ওই সময়ে ভাগ্য খুলে গেল আরেক পথে। বম্বে টকিজের জন্য চিত্রনাট্য লেখার কাজ মিলে গেল। ভালোই হলো। ছাত্রজীবন থেকে সিনেমার প্রতি তাঁর দারুণ নেশা ছিল। ভাবতেন, এই শিল্পের অপূর্ব সম্ভাবনা রয়েছে। তাই সুযোগ হাতছাড়া করলেন না। লিখলেন ‘ভাবী’, ‘বচন’, ‘দুর্গা’, ‘কঙ্গন’, ‘নবজীবন’, ‘আজাদ’, ‘পুনর্মিলন’ সিনেমার গল্প। তিনি লিখতেন ইংরেজিতে। পরে হিন্দিতে অনুবাদ করে নেওয়া হতো। তিনি সিনেমায় সাহিত্যকেই টানতে চেয়েছিলেন হয়তো। কিন্তু বাণিজ্যিক ফরমাশ তাঁর মনঃপূত ছিল না। নিজের মতো করে গল্প বলা যায় না।

সাহিত্যেই ছিল তাঁর যত মনোযোগ। সিনেমা নিয়ে নালিশ করেননি; তবে বলেছিলেন, ‘নালিশ তাহাদের বিরুদ্ধে, যাহারা এই শিল্পকে নিছক অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ে পরিণত করিয়াছে। পরিতাপ এই যে ইহারা ভালো ব্যবসায়ীও নয়।’

তিনি একজন গুণী পরিচালকের অপেক্ষায় ছিলেন, যিনি চলচ্চিত্রশিল্পকে যথাযথ মর্যাদা দিতে পারবেন।

শরদিন্দুর ব্যোমকেশ নিয়েই কত কত সিনেমা-নাটক হয়েছে। তাঁর জীবদ্দশায় সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেছিলেন ‘চিড়িয়াখানা’। মহানায়ক উত্তমকুমারের মধ্যে দর্শক প্রথম দেখতে পান ব্যোমকেশকে। এরপর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আবীর চট্টোপাধ্যায়, যীশু সেনগুপ্ত, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়সহ অনেক সত্যান্বেষী ব্যোমকেশকে পর্দায় দেখা গেছে। একমাত্র হিন্দি সিনেমা ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’-তে ছিলেন প্রয়াত অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুত।

সুকুমার সেন লিখেছিলেন, শরদিন্দুবাবুর গল্পের গুণ বহিগুণিত করেছে তাঁর ভাষা; তাঁর স্টাইল নিজস্ব যা স্বচ্ছ, পরিমিত, অনায়াস সুন্দর। সেই ভাষার স্বাদ আমরা নিশ্চয়ই খুঁজে পাই ব্যোমকেশ কিংবা বরদা সিরিজে। তাঁকেও খুঁজে পাওয়া যায় ঠিক এইখানটাতেই, তাঁর স্টাইলে।

সৈয়দা সাদিয়া শাহরীন, সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত