Ajker Patrika

ছোট হয়ে আসছে কাস্পিয়ান সাগর, প্রাকৃতিক সংকট নাকি রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা

অনলাইন ডেস্ক
আপডেট : ২৯ জুন ২০২৫, ১১: ৩৪
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

পরিবেশবিদ আদিলবেক কোজিবাকভ কাজাখস্তানের আকতাউ শহরের বাসিন্দা। তাঁর শৈশবে তাঁদের ফ্রিজে সব সময় ক্যাভিয়ার ভর্তি বয়াম থাকত। প্রতিদিন সকালের নাস্তায় মাখন পাউরুটির সঙ্গে ক্যাভিয়ার খাওয়া ছিল তাঁর জন্য বাধ্যতামূলক। কারণ, তাঁর মা বিশ্বাস করতেন ক্যাভিয়ার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

ছোটবেলায় আদিলবেকের ক্যাভিয়ার খুব একটা পছন্দ ছিল না। কিন্তু এখন সে কথা মনে করে তিনি বেশ নস্টালজিক হয়ে পড়েন। কারণ, এখন তাঁর শহরে আর অর্গানিক ক্যাভিয়ার পাওয়া যায় না।

ক্যাভিয়ার অত্যন্ত ব্যয়বহুল খাবার। এটি মূলত স্টারজিওন নামের একটি মাছের ডিম। এটি কাঁচা খাওয়া হয়। স্বাদ নোনতা। ৩০ গ্রাম ক্যাভিয়ারের দাম ২০০ ডলার বা তারও বেশি।

অতিরিক্ত মাছ শিকার এবং প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংকুচিত হওয়ার কারণে স্টারজিওন মাছ এখন বিলুপ্তির মুখে। আর শিগগিরই হয়তো সাগরটাও হারিয়ে যেতে পারে।

‘নেচার’ সাময়িকীতে এপ্রিল মাসে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, শতাব্দীর শেষ নাগাদ কাস্পিয়ান সাগরের পানির স্তর ১৮ মিটার পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে এবং এর পৃষ্ঠের ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত হারিয়ে যেতে পারে। গবেষণা অনুযায়ী, পানির স্তর ৫ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত কমে গেলেও এর আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র বিপর্যস্ত হবে—যেমন, কাস্পিয়ান সিল ও স্টারজিওনের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাবে।

কাস্পিয়ান সাগর। ছবি: সংগৃহীত
কাস্পিয়ান সাগর। ছবি: সংগৃহীত

কাজাখস্তানের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি নাগরিক পরামর্শদাতা কমিটির সদস্য কোজিবাকভ বলেন, ‘এই সাগর শুকিয়ে যাচ্ছে, তা জানার জন্য আমাদের গবেষণা করতে হয় না। খালি চোখেই দেখা যায়, সাগরের পানি কমছে।’

রাশিয়া, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, ইরান ও আজারবাইজান—এই পাঁচ দেশের মাঝখানে অবস্থিত কাস্পিয়ান সাগর বিশ্বের বৃহত্তম স্থলবেষ্টিত জলাশয়। এটি মধ্য এশিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার সবচেয়ে দ্রুতগামী পথ, যেটি রাশিয়াকে এড়িয়ে চীন ও ইউরোপকে যুক্ত করে। পাশাপাশি এটি একই সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ তেল ও গ্যাসের উৎসও।

তবে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, কাস্পিয়ান সাগরের পরিণতিও হতে পারে এর নিকটবর্তী আরাল সাগরের মতো। কাজাখস্তান ও উজবেকিস্তানের মাঝে অবস্থিত আরাল। ১৯৬০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তুলা চাষের জন্য এর সঙ্গে যুক্ত নদীগুলোর পানি ব্যাপক হারে ব্যবহার শুরু করলে সাগরটি শুকিয়ে যেতে শুরু করে। বর্তমানে সাগরটির মূল আয়তনের মাত্র ১০ শতাংশ টিকে আছে। এই সাগরের পতনে স্থানীয় পরিবেশব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আরাল সাগরের কিংবা কাস্পিয়ান সাগর শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে কেবল জলবায়ু পরিবর্তনই একমাত্র কারণ নয়।

কাস্পিয়ান সাগরের পানির প্রধান উৎসই হলো রাশিয়ার ভলগা নদী। এটি ইউরোপের বৃহত্তম ও দীর্ঘতম নদী। কাস্পিয়ান সাগরের পানির ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশই আসে ভলগা নদী থেকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়ার পানি ব্যবস্থাপনা এই সাগরের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। আল-জাজিরাকে আদিলবেক কোজিবাকভ বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে রাশিয়া ভলগা নদীতে অনেক বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করেছে এবং কৃষি ও শিল্পের কাজে এর পানি ব্যবহার করেছে। ফলে, এখন কাস্পিয়ান সাগরে আগের তুলনায় অনেক কম পানি প্রবাহিত হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘একশ বছর আগে স্টারজিওন মাছ বহু দশক পর্যন্ত বেঁচে থাকত, কেউ এদের ধরত না। এর বিশাল আকারে বেড়ে উঠত, যার প্রমাণ আমরা পুরোনো ছবিতে দেখি। তবে, বর্তমানে এত পরিমাণ মাছ ধরা হচ্ছে যে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে একেবারে তলানিতে। এ ছাড়া, তেল কোম্পানিগুলোর দূষণ মাছগুলোর আবাসস্থলও ধ্বংস করে দিয়েছে।’

কাজাখস্তানের তিনটি বড় তেলক্ষেত্র, যেগুলো সোভিয়েত আমলে আবিষ্কৃত হয়েছিল, বর্তমানে বিদেশি প্রতিষ্ঠান সেগুলো পরিচালনা করছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে, কাজাখস্তানের পরিবেশবিদ ও আইনজীবী ভাদিম নি ‘কাস্পিয়ান সাগর বাঁচাও’ ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে নিজ দেশের সরকারের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন। তাঁর অভিযোগ—তেল ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে করা রাষ্ট্রীয় চুক্তিগুলো গোপন রাখা হয়েছে, যার ফলে এই চুক্তিগুলোর পরিবেশগত প্রভাব নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

কাস্পিয়ান সাগর। ছবি: সংগৃহীত
কাস্পিয়ান সাগর। ছবি: সংগৃহীত

১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কাজাখস্তান স্বাধীন হয়। যখন স্পষ্ট হয় যে দেশটির তেল ও গ্যাস রপ্তানি করা সম্ভব, তখন বিশ্বের বড় বড় জ্বালানি কোম্পানি ও তাদের আইনজীবীরা চুক্তি করতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। তারা এসব চুক্তিকে আন্তর্জাতিক গোপনীয়তা আইনের আওতায় নিয়ে যেতে কাজাখ সরকারকে রাজি করায়, যাতে চুক্তির বিস্তারিত তথ্য গোপন রাখা যায়। ফলে, চুক্তিতে কোনো বিরোধ দেখা দিলে তা কেবল আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের মাধ্যমেই নিষ্পত্তি করা সম্ভব।

ভাদিম বলেন, এটি অনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক আইন তো বটেই আরহুস কনভেনশনেরও পরিপন্থী। আরহুস কনভেনশন পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত রাখার কথা বলে। তিনি বলেন, ‘তেল কোম্পানিগুলো পরিবেশগত দায় এড়াতে চায়। তাই দায়িত্বশীলতার প্রমাণ দিতে প্রায়ই পরিবেশগত গবেষণা চালায়, কিন্তু যেহেতু এসব গবেষণায় তাদের নিজস্ব স্বার্থ জড়িত, তাই এর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যখন সবুজ জ্বালানি নিয়ে কথা বলছি, তখন কাস্পিয়ান অঞ্চলে হাইড্রোজেন জ্বালানিতে জার্মানির বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু এ জ্বালানি ইউরোপের জন্য সবুজ জ্বালানি হবে, আমাদের জন্য নয়। হাইড্রোজেন উৎপাদনে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগে, যেটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসবে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়ার বর্জ্য ও পানিদূষণের বোঝা আমাদেরই বইতে হবে।’

তবে, ভাদিমের মামলা গ্রহণ করেনি আদালত। আদালতের ভাষ্য—এই মামলার কোনো যথাযথ ভিত্তি নেই। ভাদিম জানিয়েছেন, তাঁর আপিল খারিজ হলে আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থার আওতায় মামলাটি চালিয়ে যাবেন তিনি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

চিৎকার শুনে ছুটে আসা স্থানীয়রা ধর্ষণের শিকার নারীকেই মারধর করে

বিমানবন্দরের প্রকল্পে ‘অসম’ চুক্তি, স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়েছেন ঢাকায় ইউএই রাষ্ট্রদূত

মন্ত্রীর আত্মীয়তাই ‘যোগ্যতা’

আদানিকে আরও ৩৮৪ মিলিয়ন ডলার দিল বাংলাদেশ, মোট পরিশোধ ১.৫ বিলিয়ন

অশ্লীল ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে স্কুলছাত্রীকে দুই বন্ধুর ধর্ষণ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত