Ajker Patrika

সবাই আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, আত্মহত্যার আগে রিয়াজের শ্বশুর

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
সবাই আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে, আত্মহত্যার আগে রিয়াজের শ্বশুর

চিত্রনায়ক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ সিদ্দিকের শ্বশুর মোহাম্মদ আবু মহসিন খান ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেছেন। আজ বুধবার আনুমানিক রাত ৮টা ৪০ মিনিটের দিকে তিনি তাঁর লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন।

১ ঘণ্টা ১৩ মিনিট ৬ সেকেন্ডের লাইভে তিনি ১৬ মিনিট ১৫ সেকেন্ড কথা বলেন। এরপর নিজের মাথায় বন্দুক তাক করে গুলি করেন আবু মহসিন।

লাইভে যা বললেন আবু মহসিন খান
‘আমি মহসিন, ঢাকায় থাকি। আমার বয়স ৫৮ বছর। কোন এক সময় আমি খুব ভালো ব্যবসায়ী ছিলাম। বর্তমানে আমি ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত, তাই আমার কোন ব্যবসা বা কোন কিছুই নেই। আসলে আমার লাইভে আসার উদ্দেশ্য হলো, আমার যে অভিজ্ঞতা সেটা মানুষের সঙ্গে শেয়ার করলে হয়তো সবাই জানতে পারবে। সবাই সাবধানতা অবলম্বন করবে। গত ৩০ তারিখ আমার খালা মারা যান। মানুষের কেমন বাস্তবতা। সবই আছে, তাঁর একটি ছেলে আমেরিকায় থাকে। মা মারা গেল অথচ ছেলেটা আসলো না। এটা আমাকে অনেক দুঃখ দিয়েছে, কষ্ট পেয়েছি।’ 

আরেক খালা মারা যাওয়ার প্রসঙ্গে আবু মহসিন বলেন, ‘আজকে আমার আরেকজন খালা মারা গেছে। তারও একটা ছেলে আমেরিকায় ছিল। তাঁর তিন ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। তিনজনই বর্তমানে বাংলাদেশে আছে। তাঁরা তাঁর দাফন কাফনের কাজ সম্পন্ন করছে। সেদিক দিয়ে বলবো এই খালা অনেকটা লাকি। আমার একটা মাত্র ছেলে। সে অষ্ট্রেলিয়াতে থাকে। আমার বাসায় আমি সম্পূর্ণ একা থাকি। আমার খালা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার ভেতরে ভয় করছে। আমি যদি আমার বাসায় মরে পড়েও থাকি আমার মনে হয় না যে এক সপ্তাহে কেউ জানতে পারবে আমি মারা গেছি। ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী আমরা যাদেরকে নিয়েই যা কিছু করি আমরা সবকিছুই ফ্যামিলির জন্য করি। আপনি যদি ১০০ টাকা আয় করেন তার মধ্যে আপনার ২০ শতাংশও আপনি আপনার নিজের জন্য ব্যয় করেন না। যদি ২০ শতাংশও নিজের জন্য ব্যয় করেন এবং ৮০ শতাংশ পরিবারের পেছনে খরচ হয়। গত করোনা শুরুর আগ থেকে আমি বাংলাদেশে আছি।’

ঢাকার বাসায় একা থাকেন জানিয়ে মহসিন বলেন, ‘একা থাকা যে কি কষ্ট যারা একা থাকে তাঁরাই একমাত্র বলতে পারে বা বুঝে। আমার আসলে এখন আর পৃথিবীর প্রতি, মানুষের প্রতি...।’

বিভিন্ন মানুষকে টাকা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন জানিয়ে মহসিন বলেন, ‘যাদের জন্য আমি করছি প্রত্যেকটা মানুষের কাছ থেকে আমি প্রতারিত হয়েছি। আমার এক বন্ধু ছিল, নাম হলো কামরুজ্জামান বাবু। যাকে আমি না খেয়ে, তাঁকে খাইয়েছি। সে আমার প্রায় ২৩ থেকে ২৫ লক্ষ টাকার মতো মেরে দিছে। এভাবে আমি বিভিন্ন মানুষের কাছে প্রায় ৫ কোটি ২০ লক্ষ টাকার মতো পাই। শেষ যে লোকটাকে আমি বিশ্বাস করছিলাম তাঁর নাম হলো নোবেল সাহেব। আমি মিনারেল ওয়াটারের একটা কোম্পানি খোলার চেষ্টা করছিলাম। তাঁকে আমি মেশিন কেনার দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তাঁকে টাকা দিই, তাঁকে ৭ লক্ষ ১০ হাজার টাকা এডভান্স করি তাঁর সঙ্গে চুক্তি মোতাবেক। কিন্তু সে আমাকে আড়াই বছর পরে মেশিন নিয়ে ঝগড়াঝাটি করার পর প্রথমে ৭০ হাজার টাকা পরে আরও ৫০ হাজার টাকা ফেরত দেয়। এখন পর্যন্ত সে আমার টাকাগুলো দিচ্ছে না।’

‘মানুষ কেন এত লোভী হয়? মানুষ কেন অন্যের টাকা ছলচাতুরি করে নিয়ে যায়? আমি তো এ পর্যন্ত কারও টাকা নেইনি। আমি তো পারলে মানুষের উপকার করছি না পারলে মানুষের আশপাশে যাই নাই। আসলে আরেকটা জিনিস দেখলাম যে, পৃথিবীতে আপনিই আপনার। ছেলে বলেন, মেয়ে বলেন, স্ত্রী বলেন কেউই আপনার না। কারণ আজকে আপনি যেভাবে হয়তো আপনার ফ্যামিলিকে মেইন্টেন করছেন। কাল যদি আপনি মেইন্টেন করতে না পারেন তখনই দেখা যাবে আপনার ওয়াইফের সঙ্গে আপনার দ্বন্দ্ব হবে। আপনার ছেলে বা মেয়ে আপনাকে পছন্দ করছে না। এগুলো কেন করে? ফ্যামিলির লোকজন কেন বুঝতে চায় না? আগে ওয়াইফের বুঝতে হবে।’

মহসিন বলেন, ‘যখন বিয়ে হয় ২৪, ২৫ বা ৩০ বছরের একটা ছেলে যে পরিমাণ পরিশ্রম করতে পারে, উপার্জন করতে পারে পরবর্তীতে তো সে সেটা পারে না। তাঁর বয়স হয়। সে পরিশ্রম কম করতে পারে। উপার্জন কমে যায়। এগুলো সব মিলিয়ে আসলে অনেকদিন ধরেই আমি মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত। এখন জীবনে প্রতারিত হতে হতে তোমরা সবাই জানো...’

‘আমার বাবা পর্যন্ত আমার সম্পত্তিটা ঠিকমত বুঝায় দেয় নাই। টাকা পয়সা দেয় নাই। যতটুকু করেছি নিজের চেষ্টায় করেছি। আসলে নিজের উপর নিজের এতোটাই বিতৃষ্ণা হয়ে গেছে পৃথিবীতে এখন আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমি জানি আমি যদি এখন সুইসাড করি বা মরে পড়েও থাকি আমি যদি ফেসবুক লাইভে না যাই তাহলে কেউ জানবেও না। হয়তো অনেক দিন পর সেটা জানবে। যাইহোক অনেক কিছু বলার ছিল, ভেতরে অনেক কষ্ট। সবাই বলে সবার সাথে শেয়ার করো। তারপরেও যারা হয়তো দেখছেন অনেকেই আমার আত্মীয় আছেন। আপনাদের কারও সাথে কোন অন্যায় করে থাকি, ভুল করে থাকি ক্ষমা করে দেবেন।’ 

‘সন্তানদের বোঝা উচিত যে তাঁর বাবা যতক্ষণ পর্যন্ত এফোর্ড করতে পারে...প্রকৃত বাবারা চেষ্টা করে সন্তানদের সেভাবে মানুষ করার জন্য। বাবারা না খেয়েও সন্তাদের খাওয়ানোর চেষ্টা করে। পরিবারকে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পরিবার অনেক সময় অনেক কিছু বুঝতে চায় না। কেন বুঝতে চায় না, কেন বুঝে না এগুলো আসলে...নিজেকে আর মানায় নিতে পারলাম না।’ 

মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে নিজেকে দাফনের কথা জানিয়ে মহসিন বলেন, ‘যারা দেখছেন এটাই আপনাদের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। সবার সাথে। সবাই ভাল থাকবেন। হ্যাঁ আমি যেটা দিয়ে সুইসাইড করার চিন্তা করছি এটা বেআইনী কোন কিছু দিয়ে না। এটা হলো আমার পিস্তলের লাইসেন্স এবং এক বছরের রিনিউ করা আছে। আমি এই মূহুর্তে এখন চলে যাবো। আত্মীয়স্বজন যারা আছো তাঁরা চেষ্টা করো আমাকে, যেহেতু বাবাও জায়গাটা দেয়নাই তাই পারিবারিক কবরস্থানে আমাকে দাফন করো না। আমাকে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে যে একটা কবরস্থান হইছে আমাকে ওইখানে দাফন করে দিও। এটা আমার জন্য ভাল হবে।’ 

মাথায় বন্দুক তাক করে কালেমা পড়তে পড়তে মহসিন বলেন, ‘প্রত্যেকটা লোক আমার সঙ্গে প্রতারণা করছে। প্রত্যেকটা লোক। আমার বাবা, মা। আমার ভাইয়েরা। প্রত্যেকটা লোক, সবাই। সবাই ভাল থাকো। বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম...। ইয়া আল্লাহ ইয়া রাসুলুল্লাহ আমাকে কেন এত কষ্ট দিলা। তুমি আমাকে কেন এত কষ্ট দিলা আল্লাহ। পৃথিবীটা খুব সুন্দর, সবাই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু পৃথিবী ছেড়ে কেউ যেতে চায় না। তারপরও চলে যেতে হয়। হয়তো আমি দুইদিন পরে যেতাম, দুইদিন আগে যাচ্ছি। সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিও প্লিজ। আর তিনা আর নিশানকে বলবো তোমরা একটা ভাই একটা বোন। তোমরা মিলেমিশে চলো। একে অন্যের খোজখবর নিও। আর বাবা হিসেবে আমাকে ক্ষমা করে দিও। ভাল থেকো।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত