Ajker Patrika

বাসার কাছেই ময়লার স্তূপে ৭ দিন পড়ে ছিল শিশুর বস্তাবন্দী লাশ

সোহেল মারমা, চট্টগ্রাম
বাসার কাছেই ময়লার স্তূপে ৭ দিন পড়ে ছিল শিশুর বস্তাবন্দী লাশ

চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী এলাকায় সাত দিন আগে নিখোঁজ হওয়া এক শিশুর (১১) বিবস্ত্র মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় তাকে। ওই শিশুর বাসার কাছেই এসব ঘটনা ঘটলেও জানত না কেউ। এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারের পর এই হত্যাকাণ্ডের রহস্যের জানতে পারে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

আজ বুধবার ভোরে নগরীর পাহাড়তলী থানা এলাকার একটি পুকুরের পাড় থেকে বস্তাবন্দী অবস্থায় ওই শিশুর গলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

শিশু হত্যার গ্রেপ্তার প্রধান অভিযুক্তের নাম রুবেল। তিনি ওই এলাকায় ভ্যান গাড়িতে করে সবজি বিক্রি করতেন। তিনি দুই সন্তানের জনক।

এর আগে ২১ মার্চ (মঙ্গলবার) বিকেলে বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয় ওই শিশু। ওই দিন পাহাড়তলী থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়।

শিশুর মরদেহ উদ্ধারের পর বুধবার পিবিআই চট্টমেট্রো কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা। এ সময় তিনি ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেন।

যেভাবে অপহরণের পর ধর্ষণ চেষ্টা ও পরে হত্যা
নিখোঁজের পর গত ২৩ মার্চ ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত শুরু করে পিবিআই। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ, ভুক্তভোগী শিশুটির পরিবারের তথ্য সবকিছু বিশ্লেষণ করে রুবেলকে শনাক্ত করা হয়। কয়েক দফা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের পর সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) তিনি শিশুটিকে অপহরণের পর হত্যার বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেন পিবিআইয়ের কাছে। পরে তাঁর দেখানো মতো পুকুর পাড় থেকে বস্তাবন্দী অবস্থায় শিশুর অর্ধগলিত বিবস্ত্র মরদেহ উদ্ধার করে।

একই দিন সকালে পাহাড়তলী থানাধীন পোর্ট কানেকটিং রোডের একটি সিএনজি স্টেশনের সামনে নালা থেকে নিহত শিশুটির পরিধান করা স্যান্ডেল, কালো পায়জামা ও হিজাব উদ্ধার করা হয়।

পিবিআই সুপার জানান, তিন মাস আগে একটি বিড়াল ছানা ধরতে গিয়ে ওই শিশুকে রিকশার সঙ্গে ধাক্কা লাগার সময় আসামি রুবেল তাঁকে সাহায্য করেন। পরে মেয়েটির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। এ সময় মেয়েটি রুবেলের কাছে একটি বিড়াল ছানা আবদার করে। রুবেলও তাঁর বোনের বাসা থেকে বিড়াল এনে দেবে বলে ওই শিশুকে জানান।

অপহরণের একদিন আগে ২০ মার্চ আবারও রুবেলের সঙ্গে ওই শিশুর দেখা হয়। তখন সে বিড়াল ছানার আবদার করে। রুবেল তাকে বিকেলে আসতে বলে। তাঁর কথামতো বিকেলে রুবেলের দেখানো জায়গায় যায় ওই শিশু। কিন্তু ওই দিন রুবেল যাননি সেখানে।

পরের দিন ২১ মার্চ স্কুলে যাওয়ার সময় আবার তাঁদের দেখা হলে রুবেল আবারও বিকেলে আগের জায়গায় তাঁকে আসতে বলে। এ সময় মেয়েটিকে বোরকা পরে আসার কথা বলেন রুবেল। কথামতো মেয়েটি রুবেলের দেখানো জায়গায় যায়। পরে রুবেল একই এলাকার একটি ভবনের চতুর্থ তলার একটি বাসায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেন। এ সময় শিশুটি চিৎকার করলে তাকে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। পরে লাশটি ওই বাসায় রেখে রুবেল বেরিয়ে আসেন।

পরে এশার নামাজের সময় সুযোগ বুঝে ওই শিশুর লাশ বস্তাবন্দী করে তাঁর ভ্যানগাড়িতে করে নিয়ে ময়লা-আবর্জনায় ভরা ডোবায় ফেলে আসেন। আর একটি লাল ব্যাগে করে শিশুটির পরিহিত বোরকা ও স্যান্ডেল অন্য জায়গায় ফেলেন। এরপর প্রতিদিনই তিনি ওই দুই জায়গায় গিয়ে দেখে আসতেন। বস্তা যাতে দেখা না যায় এ জন্য উপড়ে খড় ছিটিয়ে রেখেছিলেন।

পুলিশ সুপার জানান, শিশুটি প্রতিদিন বিকেল ৪টায় স্থানীয় মাদ্রাসায় কোরআন শরিফ পড়তে যায়। সন্ধ্যা ৬টার আগেই বাসায় চলে আসে। ঘটনার দিন তাঁর পরিবারের লোকেরা জানত সে মাদ্রাসায় পড়তে গিয়েছে। ওই দিন শিশুটি বাসা থেকে বেরিয়ে অপহরণের ৪৫ মিনিটের মধ্যে সবকিছু ঘটেছিল। 

অভিযুক্ত আসামি নিজেই খোঁজেন নিখোঁজ শিশুকে
নির্ধারিত সময়ে বাসায় না ফেরায় শিশুটির দাদি রুবেলকে ফোন করে বিষয়টি জানান। রুবেলকে আগে থেকেই চিনতেন তিনি। আর তাঁরা জানত বিড়াল ছানার জন্য ওই শিশু বিভিন্ন সময় রুবেলের কাছে আবদার করেছিল। এ ছাড়া বিকেল মাদ্রাসায় যাওয়ার সময় স্থানীয় একটি সিসিটিভি ফুটেজে ওই শিশুর সঙ্গে রুবেলের কথা বলতে দেখার পর তাঁরা রুবেলের ওপর সন্দেহ করেন।

এ সময় রুবেল নিজের অপরাধ আড়াল করতে নিজেই ওই শিশুর বাসায় যান। সেখানে তিনি তাঁদের পরিবারের সঙ্গে ওই শিশুকে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজতে থাকেন।

পুলিশ সুপার বলেন, সিসিটিভি ফুটেজে রুবেলের সঙ্গে ওই শিশুর কথা বলতে দেখা গেলেও এরপর থেকে সে একা কোথায় চলে গিয়েছিল এটার কোনো ফুটেজ পাওয়া যায়নি। এই কারণে রুবেলকে সন্দেহ করা যাচ্ছিল না। রুবেল এমন একটি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল যে, যেখানে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই, সেখানে মেয়েটিকে আসতে বলেন।

ব্যস্ততম সড়কের পাশে সাত দিন ধরে পড়েছিল শিশুর নিথর মরদেহ
পুকুর পার থেকে নিহত শিশুর বাড়ি আনুমানিক ৪০০ গজ দূরে। বস্তাবন্দী অবস্থায় শিশুটির মরদেহ সাত দিন ধরে পড়ে থাকলেও স্থানীয়রা কেউ জানত না।

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, যে পুকুর পাড় থেকে শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করা হয় সেটা একটি ছোট সড়কের পাশে। সেখানে স্থানীয়রা ময়লা আবর্জনা ফেলে থাকে। সড়কের পাশে এমন ময়লা স্তূপ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এটার পাশ দিয়েই পথচারীদের চলাচল সব সময় রয়েছে।

স্থানীয় মাহফুজ নামে একজন বলেছেন, ‘ময়লা আবর্জনার স্তূপ হওয়ায় গন্ধ তো থাকবে। কে জানত এখানেই কোনো শিশুর লাশ থাকবে! সবাই এখানে এসে ময়লা ফেলে থাকে।’

শিশুটির বাসা থেকে আনুমানিক ৩০০ গজ দূরে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়
যে ভবনে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয় সেটি শিশুটির বাসা থেকে আনুমানিক ৩০০ গজ দূরে। পায়ে হেঁটে ওই ভবনটিতে যেতে এক থেকে দুই মিনিট লাগে। ওই বাসায় এক দম্পতি থাকেন। তাঁদের সঙ্গে রুবেলের দীর্ঘদিনের পরিচয় রয়েছে। বাসাটির ভাড়াটিয়া নাদিয়া দাবি করেন, ‘কয়েক দিনের জন্য আমরা ঢাকায় গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে বাসার চাবি রুবেলকে দিয়ে যায়। গত ২২ মার্চ আমরা ঢাকা থেকে বাসায় ফিরি।’

নাদিয়ার স্বামী বলেন, ‘রুবেল আমাদের বাসার বিভিন্ন কাজ কর্ম করত। আমি বাসার ভেতর কবুতর পালন করি। ঢাকায় যাওয়ার আগে রুবেলকে ৫০০ টাকা দিয়ে বাসায় থেকে কবুতর দেখাশোনা করে রাখার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু কে জানতে এই ধরনের ঘটনা ঘটাবে।’

ঘটনার দিন পিবিআইয়ের একটি দল ওই বাসায় গিয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ সময় পিবিআই বাসা তল্লাশি করে বিছানায় রক্তের কিছু আলামত পায়। 

নিখোঁজের দিনই রুবেলকে শনাক্ত করে থানায় জানালে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি
নিহত শিশুর ফুপু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ওকে (নিহত শিশু) না পেয়ে আমরা পাহাড়তলী থানায় যাই। সেখানে থানার এসআই মনির ও এসআই দুলাল আমাদেরকে বলেন, ‘‘দেখেন মেয়েটি প্রেমে পড়ে কার সঙ্গে ভেগে গেছে।’ ’ এ সময় তাঁরা আরও নানান খারাপ কথা বলেন। পরে মামলা না নিয়ে জিডি নেওয়া হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ যদি তখনই বিষয়টি গুরুত্ব দিত তাহলে এই ধরনের ঘটনা ঘটতো না।’ এ সময় তিনি রুবেলের পাশাপাশি অভিযুক্ত দুই পুলিশ সদস্যেরও শাস্তি দাবি করেন।

নিহত শিশুর বাবা বলেন, ‘ঘটনাস্থলে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে রুবেলকে শনাক্ত করার পর আমরা থানায় বিষয়টি জানাই। কিন্তু থানা-পুলিশ দায়সারা আচরণ করেছে। তাঁরা রুবেলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে পরে ছেড়ে দেয়। এভাবে কী কোনো তদন্ত হয়েছে? এখানে থানা-পুলিশের গাফিলতি রয়েছে।’ 

একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে শোকে পাথর মা
নিহতের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বাসাটির ভেতরে ও সামনে শত শত মানুষের ভিড়। বাসার ভেতর শিশুটির মায়ের কান্নায় আশপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন প্রতিবেশীরা। পরিবারের একমাত্র মেয়ের কথা বলতে বলতে একটু পর পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন তিনি। 

এদিকে বিকেলে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম জুয়েল দেবের আদালতে গ্রেপ্তার রুবেল ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দি শেষে পরে তাঁকে আদালত কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক ইখতিয়ার উদ্দিন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি টাকায় ব্যক্তিগত সড়ক কার্পেটিং বিচারপতি খিজির হায়াতের, প্রমাণ পেয়েছে দুদক

মামলার আসামিসহ বিএসইসির ২২ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের সিদ্ধান্ত

অভিনেতা সিদ্দিককে মারধর করে থানায় সোপর্দ, ছিঁড়ে ফেলা হয় পরনের পোশাক

ঐকমত্য কমিশনের সদস্যদের তেলের বরাদ্দ ২৫০ থেকে বেড়ে ৫০০ লিটার

বগুড়ায় ছাত্রদল নেতার ওপর হামলা, পাঁচ নেতা-কর্মীকে শোকজ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত