Ajker Patrika

শেখ হাসিনা যাঁকে ঢাকায় ‘হত্যা করলেন’, তিনি ময়মনসিংহে জীবিত!

ইলিয়াস আহমেদ, ময়মনসিংহ  
আপডেট : ০১ জুন ২০২৫, ১৬: ৪৩
সোলাইমান হোসেন সেলিম (দাঁড়ি টুপিওয়ালা) ও শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীত
সোলাইমান হোসেন সেলিম (দাঁড়ি টুপিওয়ালা) ও শেখ হাসিনা। ছবি: সংগৃহীত

মামলায় ‘নিহত’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার পর কোনো মানুষ যখন নিজের পায়ে থানায় হাজির হয়ে বলেন, ‘আমি মরিনি, বেঁচে আছি’—তখন তা শুধু ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং দেশের বিচারব্যবস্থা ও তদন্তপ্রক্রিয়ার বড় ব্যর্থতা তুলে ধরে। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার ব্যবসায়ী মো. সোলাইমান হোসেন সেলিমকে জীবিত থাকা অবস্থায় ‘হত্যাকাণ্ডের শিকার’ বানিয়ে মামলা ঠুকে দিয়েছেন তাঁরই সহোদর বড় ভাই গোলাম মোস্তফা ওরফে মস্তু।

আর এই মামলার আসামির তালিকায় শীর্ষ স্থান দখল করেছেন জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। মামলায় তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ মোট ৪১ জনের নাম যুক্ত করে অজ্ঞাতনামা আরও ১৫০-২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

ঘটনার পেছনে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে সংঘাত এবং তা থেকে উদ্ভূত ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু তার চেয়ে বড় বিষয়, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে পদ্ধতিগত দুর্বলতা প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে।

এক ভাইয়ের ফাঁদে আরেক ভাই!

২০২৪ সালের ৩০ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় দাখিল করা ওই মামলায় বলা হয়, রাজধানীর কাজলা এলাকায় ৩ আগস্ট সেলিমকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অথচ সেলিম তখন দিব্যি জীবিত ছিলেন এবং ময়মনসিংহের ধামর বেলতলি বাজারে নিজের মুদিদোকান সামলাচ্ছিলেন। ভাইয়ের করা মামলায় তাঁকে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ’ দেখানো হয়।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এই মামলার নেপথ্য কারণ পারিবারিক জমিসংক্রান্ত দীর্ঘদিনের বিরোধ। প্রায় ২০ বছর আগে তাঁদের বাবা আব্দুল হাকিম মারা গেলে জমি নিয়ে বিরোধ বাধে চার ভাইয়ের মধ্যে। সেলিমের কোনো ছেলেসন্তান না থাকায়, তাঁর সহায়-সম্পত্তির ওপর চোখ পড়ে অপর তিন ভাইয়ের। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং ভয়ংকর চরিত্র হলো মস্তু, যিনি স্থানীয়ভাবে ‘ডাকাত’ হিসেবে পরিচিত।

জীবিত থেকেও ‘মরি নাই’ প্রমাণে বেগ

এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সেলিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাকে মামলায় তাঁরা মৃত দেখিয়েছে, সুযোগ পেলেই মেরে aফেলত। বিষয়টি বুঝতে পেরে একটু সতর্ক হয়েছি। কিন্তু পুলিশ কেন কীভাবে একটি ভুয়া মামলা নিল?’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি হয়রানির শিকার হচ্ছি। পাঁচবার যাত্রাবাড়ী থানা এবং ডিবি অফিসে গিয়েছি। আমি যে মরি নাই, এটা প্রমাণ করতেই বেগ পোহাতে হচ্ছে।’

সেলিমের স্ত্রী হাজেরা খাতুন বলছেন, সেলিমকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এই নাটক সাজিয়েছে তারই তিন ভাই। এর আগেও তারা সেলিমের ওপর হামলা চালিয়েছে। তখন এলাকাবাসীর সহায়তায় প্রাণে বাঁচে।

এই ঘটনায় সেলিম ২০২২ সালে হেলাল উদ্দিন, আবুল হোসেনসহ বেশ কয়েকজনকে আসামি করে একটি মামলাও করেছিলেন।

ধামর বেলতলি বাজারে আড়াই শতক জমি কিনে দোকান ও বসতবাড়ি গড়ে সেখানে বসবাস করছেন সেলিম। তাঁর অভিযোগ, বড় ভাই মস্তু ১৫ বছর ধরে এলাকায় অনুপস্থিত থেকেও অপর দুই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর সম্পত্তি দখলের অপচেষ্টা করছেন।

পুলিশ কীভাবে এই ভুয়া মামলা নিল

যেখানে একজন জীবিত মানুষকে ‘মৃত’ দেখিয়ে হত্যা মামলা হয়, সেখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—পুলিশের ভূমিকা কী ছিল? কেন তারা যাচাই না করেই মামলা নিল?

এই প্রশ্নের জবাবে ফুলবাড়িয়া থানার ওসি মোহাম্মদ রুকনুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মস্তু একজন স্বীকৃত ডাকাত। তার নামে দুটি হত্যা, একটি চাঁদাবাজি ও একটি মারামারির মামলা আছে। প্রায় ১৫ বছর ধরে সে এলাকায় আসে না। সম্ভবত সম্পত্তি দখল ও সরকারের কাছে সহানুভূতি আদায়ের জন্যই এমন ভুয়া মামলা করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যাত্রাবাড়ী থানা-পুলিশকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিয়েছি। এখন তারা বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।’

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওয়ারী জোনের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আমিনুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বাদী গোলাম মোস্তফা পলাতক, তার মোবাইল বন্ধ, কোথায় আছে, সেটাও জানা যাচ্ছে না। আদালতের নির্দেশে ভাইদের মুখোমুখি করে ডিএনএ পরীক্ষাও করা হবে।’

তবে এই ধরনের ভিত্তিহীন মামলা কীভাবে নেওয়া হলো, সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি তিনি। এসআই আমিনুল বলেন, ‘এই মামলার তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তা আমি। এখন পর্যন্ত একজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত তদন্ত শেষ করতে।’

পরিবারের অন্যদের দায় এড়ানো যাচ্ছে না

বাদী মস্তুর অন্য দুই ভাই—হেলাল উদ্দিন ও আবুল হোসেন—মামলায় সাক্ষী হিসেবে থাকলেও তাঁরা এর সঙ্গে দূরত্ব প্রকাশ করছেন। হেলালের মেয়ে ঝুমি আক্তার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শুনেছি মামলার কথা। তবে বাবাকে কেন সাক্ষী করা হলো, তা জানি না। মস্তু কাকা যদি কিছু করে থাকে, তাহলে সেটা তার কাজ।

তবে এই পরিবারে দীর্ঘদিনের বিরোধের সাক্ষী স্থানীয় রুহুল আমিন বলছেন, ‘সেলিম নিরীহ মানুষ, দোকান করে খায়। ছেলেসন্তান না থাকায় ভাইয়েরা জমি আগেভাগেই পেতে চায়। কিন্তু একজন জীবিত মানুষকে ‘মৃত’ দেখিয়ে মামলা করা—এটা তো চরম পর্যায়ের ষড়যন্ত্র। যারা করেছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘের সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, মামলা নথিভুক্ত করার আগে পুলিশের আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। কারণ, এতে মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে। অনেকে বিষয়টিকে হাস্যকর হিসেবে নিয়েছে। আমরা চাই, ভুয়া মামলায় যেন কেউ হয়রানির শিকার না হয়।’

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মবের নামে নাশকতার সুযোগ নেই এখন, সারজিসকে বললেন সেনা কর্মকর্তা

আজহারুলের আপিলে তাজুলের প্রসিকিউশন টিম, স্বার্থের সংঘাত দেখছেন ডেভিড বার্গম্যানও

ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় শুধু একটি দল—প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের যে ব্যাখ্যা দিল প্রেস উইং

কক্সবাজারে ‘মিলিটারি অপারেশনস জোন’ নিয়ে নর্থইস্ট নিউজের সংবাদের প্রতিবাদ জানাল সেনাবাহিনী

মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়েছিলেন বলেই কি জামিন পেলেন না অধ্যাপক আনোয়ারা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত