Ajker Patrika

অ্যাপ প্রতারণার নাটের গুরু ঢাকার মাহাদি

রিমন রহমান, রাজশাহী
অ্যাপ প্রতারণার নাটের গুরু ঢাকার মাহাদি

আগে নাম ছিল সজিব কুমার ভৌমিক। প্রতারণার সুবিধার্থে ২০১৮ সালে ধর্মান্তরিত হয়ে নাম ধারণ করেন মাহাদি ইসলাম। ধর্ম যা-ই হোক, আসল কাজ প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ অর্জন। ২০১৪ সাল থেকেই একের পর এক অ্যাপ খুলে অনলাইনে প্রতারণা চালিয়ে আসছেন তিনি। সর্বশেষ ‘ইউএস অ্যাগ্রিমেন্ট’ নামে অ্যাপের ফাঁদ ফেলে প্রায় ২ হাজার মানুষের কাছ থেকে ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার যে ঘটনা ঘটেছে, সেই প্রতারণার নাটের গুরুও এই মাহাদি।

ইউএস অ্যাগ্রিমেন্টের মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগে ১৭ জানুয়ারি রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় একটি মামলা হয়। মামলায় পাঁচজনকে আসামি করা হয়। তাঁদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ মামলায় অবশ্য মাহাদির নাম ছিল না। পরে ২৩ জানুয়ারি রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানায় আরেকটি মামলা হয়। এ মামলায় আগের পাঁচজন ছাড়াও মাহাদিকে আসামি করা হয়।

প্রথম মামলার বাদী মোস্তাক হোসেন জানান, টাকা ফেরত না পেলে মামলা করবেন জানালে চতুর মাহাদিই তাঁকে সব তথ্য দিয়ে সহযোগিতার কথা বলেন। এ জন্য তাঁকে আসামি না করার অনুরোধ করেন। পরে তাঁরা জেনেছেন, ওই মাহাদিই অ্যাপের পরিচালক। তাই আরেক ভুক্তভোগীর মামলায় তাঁকে আসামি করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাহাদির বাবার নাম মিন্টু কুমার ভৌমিক। বাড়ি নোয়াখালী সদর উপজেলার মাইজদী এলাকায়। এলাকায় কয়েকটি প্রতারণার মামলার আসামি হয়ে ২০১৭ সালের দিকে সপরিবারে চলে আসেন ঢাকায়। থাকতে শুরু করেন বনশ্রীর একটি বাসায়। ইউএস অ্যাগ্রিমেন্টের কেলেঙ্কারির পর তিনি এখন লোকচক্ষুর আড়ালে। তবে এখনো ‘প্রো উইন ইএক্স’ নামে মাহাদির একটি অ্যাপের কার্যক্রম চলছে। হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে টাকা।

ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সজিব কুমার ভৌমিক ওরফে মাহাদি নোয়াখালীতে ‘ট্রেড টুডে’ নামের একটি অ্যাপ চালাতেন। এই অ্যাপের মাধ্যমে নিজ এলাকার মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। এ নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা হয়। তখন মা, বাবা ও ভাইকে সঙ্গে নিয়েই ঢাকায় পালিয়ে আসেন সজিব। তাঁরা বনশ্রীর সি ব্লকে একটি ভাড়া করা বাসায় ওঠেন। প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়া প্রচুর টাকা হাতে থাকায় বনশ্রীর ডি ব্লকে ‘ডক্টর মেডিসিন ফার্মা’ নামের একটি ওষুধের দোকান কিনে নেন। কিন্তু ফার্মেসি চালানোর মতো অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল না। তাই চন্দন বসক নামের অভিজ্ঞ এক ব্যক্তিকে দোকানটি পরিচালনার দায়িত্ব দেন।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বনশ্রীর ডি ব্লকে ‘ডক্টর মেডিসিন ফার্মা’ নামের ওষুধের দোকানটিতে গিয়ে চন্দনের দেখা মেলে। কথা হলে চন্দন জানান, ২০২২ সালে ফার্মেসিটি দেন মাহাদি। গত বছর দুর্গাপূজার সময় ফার্মেসি ও এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন তিনি। ফার্মেসিটির মালিক এখন জসীম নামের আরেক ব্যক্তি।

চন্দন আরও জানান, পরিবারসহ বনশ্রী এলাকাতেই থাকতেন মাহাদি। মাঝে মাঝে ফার্মেসিটিতে এলেও এটি দেখভাল করতেন তাঁর ভাই রাজীব। গত দুই বছরে এই এলাকার পাঁচ-ছয়জনের কাছ থেকে প্রায় কোটি টাকা নিয়েছেন তিনি। আর এর মধ্যে লোকজন ও পুলিশি ঝামেলার কারণে চারটি বাসা পরিবর্তন করেছেন। তাঁর চলাফেরা ছিল ধনীদের মতো। এ সময় ফার্মেসি ভবনের মালিক হাজি আক্কাস ও প্রতিবেশী আজহারুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেও বিষয়গুলোর সত্যতা পাওয়া যায়।

অভিযোগ আছে, ‘ট্রেড টুডে’র পর মাহাদি ‘ফরেক্স মার্কেট ইউএস ডটকম’ নামে আরেকটি অ্যাপ খোলেন। এই অ্যাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন নোয়াখালীর এমদাদুল হক ও মুন্না নামের দুজন। এই অ্যাপের মাধ্যমে ময়মনসিংহ থেকে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেন মাহাদি।

সেখানে এজেন্ট ছিলেন মানিক মিয়া। এই অ্যাপের প্রতারণা বুঝতে পেরে ২০২২ সালে মাহাদির বিরুদ্ধে ময়মনসিংহে মামলা হয়। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে মাহাদি ও তাঁর পরিবার বনশ্রীর ভাড়া বাসা ও নিজেদের দোকান ফেলে পালিয়ে যান।

বিদেশি অ্যাপে বিনিয়োগের কথা বললেও মাহাদি তাঁর এজেন্টদের কাছ থেকে গ্রাহকের টাকা নিতেন নিজের, বাবার কিংবা ভাইয়ের ব্যাংক হিসাবে। ২০২১ সালের একটি ব্যাংক স্টেটমেন্টেই সজিব কুমার ভৌমিকের ব্যক্তিগত হিসাবে ৭১ লাখ ৩৭ হাজার ৫১৮ টাকা লেনদেনের চিত্র দেখা গেছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, নোয়াখালীতে এমএলএম অ্যাপ ট্রেড টুডের মাধ্যমে প্রতারণায় সজিব ওরফে মাহাদির প্রধান সহযোগী ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম নামের এক ব্যক্তি। নোয়াখালীতে সজিবের নামে যে মামলা হয়, তাতে জাহাঙ্গীরও আসামি। মামলা খেয়ে দুজনে একসঙ্গেই ঢাকায় পালিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী পলির সঙ্গে মাহাদির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৯ সালে বিষয়টি বুঝতে পেরে জাহাঙ্গীর তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দুবাই চলে যান। পরের বছর পলিকে বিয়ে করেন মাহাদি। এখন পলিকে নিয়েই আত্মগোপনে তিনি। জাহাঙ্গীর আলম এখনো দুবাইতেই আছেন।

সূত্র বলেছে, সর্বশেষ ঢাকার সিরাজ মিয়া আর চট্টগ্রামের মোস্তাকিম মিয়া নামের দুজনকে নিয়ে ইউএস অ্যাগ্রিমেন্টের প্রতারণার জাল বিছান মাহাদি। পরে সিরাজকে দূরে সরিয়ে দেন। এখন শুধু চট্টগ্রামের মোস্তাকিমকে নিয়ে চলছেন। প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়া বিপুল টাকায় তাঁরা আয়েশি জীবন কাটাচ্ছেন। নিজেরা বাঁচতে ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন অনেককেই।

অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে সজিব কুমার ভৌমিক ওরফে মাহাদি ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাঁর বাবা মিন্টু কুমার ভৌমিকের মোবাইল নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে সংযোগ পাওয়া গেছে ভাই রাজীব কুমার ভৌমিকের মোবাইলে। রাজীব বলেন, তিনি এসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। এখন বিপর্যস্ত অবস্থায় আছেন। এ সময় তিনি কাঁদতে শুরু করেন এবং ফোনটি কেটে দেন। পরে আবার ফোন করা হলে তিনি ধরেননি।

মাহাদির বিরুদ্ধে হওয়া মামলাটির তদন্ত করছেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শিহাব উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘মামলাটা এখনো তদন্ত শুরু করতে পারিনি। মামলার বাদীকে ডেকেছি কথা বলার জন্য। তাঁর কাছ থেকে বিষয়গুলো আরও ভালোভাবে শুনব। তারপর তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নেব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টাকে সাংবিধানিক আদেশ জারির প্রস্তাব আবেগতাড়িত, রাষ্ট্র আবেগের ওপর চলে না: সালাহউদ্দিন

বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা কিশোরগঞ্জের আইনজীবীর, ফেসবুকে ঝড়

আসামিদের কোনো অনুশোচনা নেই, উল্টো সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উসকে দিয়েছে: চিফ প্রসিকিউটর

‘বিএনপি করি, শেখ হাসিনার আদর্শে বিশ্বাসী’: সেই ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার

অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির ক্ষমতা পাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট

এলাকার খবর
Loading...