Ajker Patrika

ভয়ংকর অপরাধ দেশে, বন্দী বিদেশে

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯: ৩২
Thumbnail image

একটি কথা স্বীকার করি, ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে ‘সেভেন স্টার’, ‘ফাইভ স্টার’ বলে সন্ত্রাসীদের কোনো গ্রুপ কস্মিনকালেও ছিল না। সন্ত্রাসী জোটের এই কল্পিত নাম দিয়েছিলেন দৈনিক পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টাররা। এরপর পুলিশও সেই নাম ব্যবহার শুরু করে। এর আগে সুব্রত বাইন ও মুরগি মিলনকে নিয়ে লেখার সময় আমি সেই নামকরণের গল্পটি বলেছিলাম। আজ আবার একটু বলি।

অপরাধবিষয়ক রিপোর্টার পারভেজ খান একদিন রাতে আমাকে বললেন, ঢাকার অপরাধজগতের দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন আর লিয়াকত আলাদা জোট করেছেন। লিয়াকতের সঙ্গে পাঁচজন আর সুব্রত বাইনের দলে আছে সাত সন্ত্রাসী। সুব্রতরা নিজেদের ‘সেভেন স্টার’ আর লিয়াকতেরা ‘ফাইভ স্টার’ বলছেন।
ফোন দিলাম ঢাকার অপরাধজগৎ সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন এমন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে। কেউ কিছু বলতে পারলেন না। শুধু ডিবির এসি আখতারুজ্জামান রুনু বললেন, সড়ক ও জনপথের (সওজ) ২৫০ কোটি টাকার টেন্ডার ভাগাভাগিতে সুব্রতদের সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে।

অগত্যা হালকা চালে একটি নিউজ ছেড়ে দিলাম, ‘ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে নতুন জোট–সেভেন স্টার’। এটা ছিল শতভাগ ‘টেবিল মেইড’ স্টোরি। দুই কলামে রিভার্স করে সেই রিপোর্ট ছাপা হলো। পরদিন দুই ছিঁচকে অপরাধীকে ধরে পুলিশ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলল, সেভেন স্টার বাহিনীর দুই সন্ত্রাসী ঢাকায় গ্রেপ্তার। ব্যস, শুরু হয়ে গেল ‘স্টার’ সন্ত্রাসীর যুগ।

সেই কথিত ‘সেভেন স্টার’ গ্রুপের ভয়ংকর সন্ত্রাসী ছিলেন মোল্লা মাসুদ। বহুদিন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঁপিয়ে এখন ভারতের কারাগারে। আজকের ‘আষাঢ়ে নয়’ তাঁকে নিয়ে গল্প।

মোল্লা মাসুদকে আমি একবারই দেখেছি, তা-ও আলো-আঁধারিতে। মগবাজারের চাংপাই চায়নিজ রেস্তোরাঁয় একবার খেতে গেছি। দেখি, তিনতলায় সব ফাঁকা। শুধু পাঁচ-ছয়জন একটা টেবিলে বসে কথা বলছেন। ওয়েটার সেখানে আমাদের বসতে দেবেন না। পরে জানলাম, সুব্রত বাইন আর মোল্লা মাসুদ সেখানে মিটিং করছেন। পরদিন ঠিকই জনকণ্ঠে ছাপা হলো ‘চায়নিজ রেস্তোরাঁয় সন্ত্রাসীর গোপন বৈঠক’। আর যায় কোথায়, ডিবি হানা দিয়ে রেস্তোরাঁর ম্যানেজারকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করল।

সেই খবরের তথ্য জোগাড় করতে গিয়ে প্রথমে জানলাম মোল্লা মাসুদ নামের এক ভয়ংকর সন্ত্রাসীর নানা কর্মকাণ্ডের বিবরণ। তার আগ পর্যন্ত মোল্লা মাসুদ সম্পর্কে আমার কাছে তেমন কোনো তথ্যই ছিল না। শুনেছিলাম, তিনি সুব্রত বাইনের সেকেন্ড ইন কমান্ড।

২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ঘোষণা করে সরকার। সেই তালিকায় মোল্লা মাসুদ ছিলেন ১৩ নম্বরে। তাঁকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণার পাশাপাশি সারা দেশে ছবিসহ পোস্টার সাঁটানো হয়েছিল। দেশের ইমিগ্রেশনে তাঁর ছবিও টাঙিয়ে দেওয়া হয়। ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে। এরপর মোল্লা মাসুদ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আস্তানা গাড়েন। আবার ফিরে আসেন। সর্বশেষ ২০০৪ সালে ঢাকায় ‘ক্রসফায়ার’ শুরু হলে সুব্রত বাইন আস্তানা গুটিয়ে ভারতে চলে যান। তাঁর সঙ্গে মোল্লা মাসুদও পালিয়ে যান। এরপর থেকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে মোল্লা মাসুদের উপস্থিতির কথা শোনা যায়নি। তবে ভারতে বসে ঢাকায় চাঁদাবাজির কথা শোনা যেত হরহামেশা।

পুলিশের খাতায় লেখা আছে, মোল্লা মাসুদের আদি নিবাস ঝালকাঠি সদর উপজেলার পোনাবালিয়া ইউনিয়নের সুগন্ধা নদীতীরবর্তী মহদিপুর গ্রামে। শহর থেকে সুগন্ধা নদী পাড়ি দিয়ে সেখানে যেতে হয়। মোল্লা মাসুদের বাবার নাম আমজাদ হোসেন। কিন্তু তাঁর জীবন শুরু হয় মাদ্রাসায় পড়তে আসার পর। রমনার মীরবাগে একটি মাদ্রাসা থেকে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন সিদ্ধেশ্বরী কলেজে। সেই কলেজে থাকার সময় জড়িয়ে পড়েন অপরাধ কর্মকাণ্ডে। সে সময় সারা দিন মাথায় টুপি দিয়ে ঘুরে বেড়াতেন বলে তাঁর নাম হয়ে যায় ‘মোল্লা মাসুদ’।

মগবাজারের বিশাল সেন্টারে ছিল তাঁদের আস্তানা। বিশাল সেন্টারের একটি দোকান নিয়ে মুরাদ নামের এক যুবক খুন হন। এই খুনই ছিল মোল্লা মাসুদের হাতেখড়ি। এরপর একে একে খুনে জড়িয়ে পড়েন মোল্লা মাসুদ। সর্বশেষ তাঁর বিরুদ্ধে ৩০টির বেশি মামলা ছিল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারের ভাগনে মামুন হত্যা, পুরান ঢাকায় মুরগি মিলন হত্যা। এ ছাড়া খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ায় ট্রিপল মার্ডার নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল। মোল্লা মাসুদের বিরুদ্ধে কত জিডি ছিল, তার হিসাব নেই।

১৯৯৭ সালের দিকে মোল্লা মাসুদ, সুব্রত বাইন, জয়, টিক্কা, আসিফ, জন ও চঞ্চল জোট করেন। পরে দ্বন্দ্বের কারণে সেটি ভেঙে যায়। এরপরই খিলগাঁও এলাকার একটি বাসায় পাঁচ খুনের ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে জন ও আসিফ ছিলেন।

এই দলকে সামাল দিতে লিয়াকত-মুরগি মিলন নেপথ্যে থেকে রাজা, অপু, আনোয়ার, মশিউর রহমান কচিকে নিয়ে আলাদা একটি জোট করেন। তাঁদের একমাত্র কাজ ছিল ঢাকা সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। পরে সেই দ্বন্দ্বের জের ধরে কচির ভাই আজাদ, মুরগি মিলন, আসিফ, জনসহ বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটে। মুরগি মিলন হত্যাকাণ্ডে মোল্লা মাসুদও জড়িত বলে অভিযোগ ছিল। ১৯৯৯ সালের দিকে সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদের গ্রুপের সদস্যরা যুবলীগ নেতা লিয়াকতের গাড়িতে হামলা করেছিলেন। এ ঘটনায় অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান লিয়াকত।

ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর মোল্লা মাসুদ পরিচিতি পান রাসেল মাসুদ নামে। পরে রিজিয়া সুলতানা নামের এক নারীকে বিয়ে করে মুর্শিদাবাদে স্থায়ী হন। কিন্তু তার পরও থেমে থাকেনি চাঁদাবাজি। ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীকে টার্গেট করে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করতেন। শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গে সুব্রত বাইনের সঙ্গে থেকে জাল নোটের কারবারেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। ২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি কলকাতা পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াড (এটিএস) মুর্শিদাবাদ থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এরপর থেকে কলকাতার আলিপুর প্রেসিডেন্সি কারাগারে আছেন।

মোল্লা মাসুদ ভারতে গ্রেপ্তারের সময় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম (বর্তমানে অতিরিক্ত আইজিপি, এসবি) আমাকে বলেছিলেন, মোল্লা মাসুদকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।

সেই চেষ্টা আর শেষ হয়নি। এত দিনেও মোল্লা মাসুদকে ফিরিয়ে আনা যায়নি। আনার ব্যাপারে আর কোনো আলোচনা আছে বলেও শুনিনি। কিন্তু যে পরিবারগুলো তাঁর কারণে স্বজন হারিয়েছে, তারা কি বিচার পাবে না? কী দোষ তাদের?

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত