কামরুল হাসান
টুনটুনকে শেষ অব্দি খুঁজে পাওয়া গেল। অবশ্য আমি নিজে তাঁর কোনো খোঁজ পাইনি। তাঁকে খুঁজে পেয়েছেন আজকের পত্রিকার রাজশাহী প্রতিনিধি রিমন রহমান। মহাভারতের বর্ণনায় সমুদ্র মন্থন করে দেবতারা যেভাবে অমৃত খুঁজে এনেছিলেন, রিমন সেভাবে শহর সেচে একটি মেয়েকে খুঁজে বের করেছেন। মেয়েটির নাম ছাড়াও তাঁর কাছে বাড়তি তথ্য ছিল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে পাস করা মেয়েটি দেখতে ভারী সুন্দর।
টুনটুন নামের এই মেয়ে আমার কাছে প্রথমবার এসেছিলেন ১৪ বছর আগে ২০০৮ সালে, সেটা সম্ভবত ৯ ফেব্রুয়ারি। এসেছিলেন তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর খুনের বিচার চাইতে, যার সঙ্গে টুনটুনের বিয়ের কথা পাকা হয়েছিল।
সংবাদপত্র অফিসে এ রকম অভিযোগ নিয়ে হরহামেশা লোকজন আসেন। রিপোর্ট ছাপা হওয়ার পর তাঁদের আর কোনো খোঁজ থাকে না। সেভাবেই টুনটুনের সঙ্গে আমার আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। তবে রিমনের খুঁজে দেওয়া নম্বর ধরে ফোন করতেই তিনি আমাকে চিনে ফেললেন।
প্রত্যাশা ছিল, আমার ফোন পেয়ে টুনটুন কিছুটা উচ্ছ্বসিত হবেন। তার বদলে তিনি একটু চুপসেই গেলেন। কথার ভেতরেও বেশ জড়তা। বললেন, তাঁর সেই বন্ধুর খুনের মামলার কোনো খবর তিনি আর জানেন না। কথার ফাঁকে বললেন, তিনি এখন সংসারী, একটি সন্তানও আছে। আমাকে বারবার অনুরোধ করলেন, তাঁর সেই বন্ধুকে নিয়ে কিছু লিখলে সেখানে যেন তাঁর নামপরিচয় আড়াল করি।
‘এই কাহিনির সব চরিত্র কাল্পনিক’ বলে যেসব গল্প শুরু হয়, ‘আষাঢ়ে নয়’ তার ঠিক উল্টো পিঠে। এখানে সব চরিত্রই বাস্তব। ঘটনাও বলা হয় সবার নাম-পরিচয় উল্লেখ করে। এসব গল্পে পরিচয়সহ আশপাশের লোকজনের বিবরণও থাকে, যাতে পাঠকেরা অন্তত সময়টা ধরতে পারেন। কিন্তু এত দিন পরে এই মেয়ের আবদারের কাছে আমাকে হার মানতে হলো। প্রিয় পাঠক, তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এটা বলে, টুনটুন মেয়েটির আসল নাম নয়। তবু গল্পটা এ নামেই চলুক, কেমন?
যে ছেলেটির সঙ্গে টুনটুনের বিয়ে পাকা হয়েছিল, তাঁর নাম হাফিজুল ইসলাম। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের দুর্গাপুরে। বাবা নুরুল ইসলামের ছয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে পরিচয় টুনটুনের সঙ্গে। পরে ঘনিষ্ঠতা থেকে বিয়ের পাকা কথা। দুজনে ভেবেছিলেন, মাস্টার্স শেষ হোক, যেকোনো একজনের চাকরি হলেই ঘর বাঁধবেন। অঞ্জন দত্তের বেলা বোসের মতো ‘মিথ্যে কথার শহরে’ লাল-নীল সংসারের স্বপ্ন দেখতেন দুজনে।
রাজশাহী থেকে চাকরির জন্য ঢাকায় এসে হাফিজুল উঠেছিলেন পূর্ব কাজীপাড়ায় এক বন্ধুর মেসে। ২০০৫ সালের ২২ এপ্রিল শুক্রবার সেই মেসের বন্ধু নুরুজ্জামানের সঙ্গে জুমার নামাজ পড়ে ফেরার পথে পূর্ব কাজীপাড়ার মাতবরের পুকুরপাড়ে গুলিবিদ্ধ হন। সে সময় ওই এলাকায় দুই দল সন্ত্রাসীর মধ্যে গুলিবিনিময় চলছিল। হঠাৎ একটি গুলি এসে হাফিজুলের গায়ে লাগে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক হাফিজুলকে মৃত ঘোষণা করেন।
কাফরুল থানার পুলিশ প্রথমে বেওয়ারিশ হিসেবে হাফিজুলের লাশটি গ্রহণ করে। পরিচয় জানার পর থানা থেকে হাফিজুলের বড় ভাই জয়নুল ইসলামকে ফোন দেয়। হাফিজুলের বাবা নুরুল ইসলাম থানায় এসে অজ্ঞাত আসামির নামে খুনের মামলা করেন। এরপর লাশ নিয়ে যান গ্রামের বাড়িতে।
হাফিজুলের ভাই জয়নুল ইসলাম দুই দিন আগে আমাকে বললেন, সেই মামলার কী হয়েছে, সেটা তাঁরা আর জানেন না। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় গিয়ে খুনের মামলার তদবির করার মতো অবস্থা তাঁদের নেই।
হাফিজুলের চাচাতো ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল। দুই দিন আগে তিনি আমাকে বললেন, খুনের পর কিছুদিন তিনিও এই মামলার খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেন। এখন তিনিও মামলার আর কোনো হদিস জানেন না।
সবাই যখন হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখন মামলার খোঁজ-খবর নিতেন টুনটুন। যদিও হাফিজুল নিহত হওয়ার খবর তিনি পেয়েছিলেন ঘটনার কয়েক দিন পরে। খবর শুনে ভেঙে পড়েছিলেন। ছয় মাস ঘর থেকেই বের হননি। একবার হাফিজুলদের বাড়িতেও গিয়েছিলেন সবার সঙ্গে দেখা করতে। এরপর রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসে খুনিদের গ্রেপ্তারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতেন। চিঠি লিখতেন এখানে-ওখানে। কিন্তু টুনটুনের কথা কেউ কানে তোলেনি।
এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন আমার কাছে এসেছিলেন সেই সব অভিযোগ জানাতে, সঙ্গে বিভিন্ন দপ্তরে লেখা চিঠির অনুলিপি। বলেছিলেন, তাঁর ভালোবাসার মানুষটি অবয়ব হারিয়ে শুধু একটি সংখ্যায় রূপ নিয়েছে। হাফিজুল এখন পুলিশের কাছে মামলার নম্বর ছাড়া কিছুই নয়।
হাফিজুলের সঙ্গে টুনটুনের শেষ কথা হয়েছিল রাজশাহীতে, হাফিজুলের ঢাকায় আসার আগে। প্রথম প্রস্তাবের সময় হাফিজুল তাঁকে বলেছিলেন, আমার সঙ্গে ঘর বাঁধবে? এমন ঘরভাঙানি ডাক টুনটুন উপেক্ষা করবেন কী করে? তার পরও ভালোবাসার কথা কোনো দিন মুখ ফুটে বলতে পারেননি। শুধু মনে মনে বলেছেন, ‘আমি তোমারই সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ....’।
শেষবার ঢাকায় আসার সময় এক হাট লোকের মধ্যে হাফিজুল ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন, বলো না ভালোবাসি! সেদিনও লজ্জায় নিরুত্তর ছিলেন টুনটুন। হাফিজুলের এমন মনভোলানি ডাকে কপিলার মতো তাঁরও খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘আমারে লগে নিবা মাঝি...’।
সেই টুনটুন লোকলজ্জার মাথা খেয়ে শেষবার দেখা হওয়ার সময় আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার ভালোবাসার কথা আপনি হাফিজুলের কাছে পৌঁছে দেবেন ভাই। লিখবেন, আমি তাঁকে খুব ভালোবাসি, খুব।’
টুনটুনের সেই ভালোবাসার কথা আমি লিখেছিলাম। হাফিজুলের কাছে সেই বার্তা পৌঁছেছে কি না, তা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জানেন না। এরপর নানা কাজের ভিড়ে টুনটুনকে হারিয়ে ফেলি। টুনটুনও ব্যস্ত হয়ে যান রোজকার যাপিত জীবনে। এভাবে চলতে চলতে একসময় পরিবারের চাপ আসে। বয়স বেড়ে যাচ্ছে, তবু বিয়ে করছেন না মেয়ে। চাপের কাছে একপর্যায়ে হার মানেন টুনটুন। সবকিছু ছেড়ে বিয়ে করে সংসারী হন। বন্ধ হয়ে যায় হাফিজুলের মামলার তদারকি।
হাফিজুলকে যারা খুন করেছিল, তাদের বিচারের কী হলো, তার খোঁজ নিতে কাফরুল থানায় গিয়েছিলেন আজকের পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার শাহরিয়ার হাসান। তাঁর অনুরোধে ধুলোর আস্তর সরিয়ে পুরোনা নথি খুঁজে বের করে দেন এক হৃদয়বান পুলিশ সদস্য। নথিতে দেখা গেল, এই মামলার কোনো আসামিকে পুলিশ শেষ পর্যন্ত খুঁজে পায়নি। খুনের পর সাতজনকে ধরেছিল, কিন্তু কেউ জবানবন্দি দেয়নি। মোহাম্মদ নাসিম নামের এক এসআই খুনের মামলাটি তদন্ত করেছিলেন। খুনের মাত্র আট মাসের মাথায় ২০০৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর তড়িঘড়ি করে তিনি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। তাতে উল্লেখ করেন, খুনের রহস্য তিনি উদ্ঘাটন করতে পারেনি। পুলিশের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে হাফিজুলের পক্ষ নিয়ে কেউ আদালতে নারাজি দেবেন, সে রকম লোকও ছিল না।
গত সপ্তাহের ‘আষাঢ়ে নয়’-এ চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা নিয়ে লিখেছিলাম। বিত্তশালীরা কীভাবে দেশের বিচারব্যবস্থাকে নিজের প্রয়োজনে থামিয়ে দেন, সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা হলো তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আর হাফিজুলের মামলাটি এমন, যেখানে বিচারের বাণী সরবে কাঁদে।
মামলার তদন্তের ফলাফল জানার পর টুনটুনের কাছে আবার ফোন করেছিলাম। বললাম, যে খুনের বিচার চেয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, সেই খুনের মামলার কোনো আসামিকেই খুঁজে পায়নি পুলিশ। কারও কোনো সাজাও হয়নি। এসব অগতির কথা শুনে কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন টুনটুন। কিছুই বললেন না, আবার ফোনও কাটলেন না। ফোনের ওপার থেকে শোনা যাচ্ছিল কান্নার আওয়াজ। টুনটুন কাঁদছেন।
ফোন রেখে দিতে দিতে আমার মনে হচ্ছিল, যে কান্না হৃদয় ভেঙে ঝরে, সেই বেদনা বড় সংক্রামক।
আরও পড়ুন:
টুনটুনকে শেষ অব্দি খুঁজে পাওয়া গেল। অবশ্য আমি নিজে তাঁর কোনো খোঁজ পাইনি। তাঁকে খুঁজে পেয়েছেন আজকের পত্রিকার রাজশাহী প্রতিনিধি রিমন রহমান। মহাভারতের বর্ণনায় সমুদ্র মন্থন করে দেবতারা যেভাবে অমৃত খুঁজে এনেছিলেন, রিমন সেভাবে শহর সেচে একটি মেয়েকে খুঁজে বের করেছেন। মেয়েটির নাম ছাড়াও তাঁর কাছে বাড়তি তথ্য ছিল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে পাস করা মেয়েটি দেখতে ভারী সুন্দর।
টুনটুন নামের এই মেয়ে আমার কাছে প্রথমবার এসেছিলেন ১৪ বছর আগে ২০০৮ সালে, সেটা সম্ভবত ৯ ফেব্রুয়ারি। এসেছিলেন তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর খুনের বিচার চাইতে, যার সঙ্গে টুনটুনের বিয়ের কথা পাকা হয়েছিল।
সংবাদপত্র অফিসে এ রকম অভিযোগ নিয়ে হরহামেশা লোকজন আসেন। রিপোর্ট ছাপা হওয়ার পর তাঁদের আর কোনো খোঁজ থাকে না। সেভাবেই টুনটুনের সঙ্গে আমার আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। তবে রিমনের খুঁজে দেওয়া নম্বর ধরে ফোন করতেই তিনি আমাকে চিনে ফেললেন।
প্রত্যাশা ছিল, আমার ফোন পেয়ে টুনটুন কিছুটা উচ্ছ্বসিত হবেন। তার বদলে তিনি একটু চুপসেই গেলেন। কথার ভেতরেও বেশ জড়তা। বললেন, তাঁর সেই বন্ধুর খুনের মামলার কোনো খবর তিনি আর জানেন না। কথার ফাঁকে বললেন, তিনি এখন সংসারী, একটি সন্তানও আছে। আমাকে বারবার অনুরোধ করলেন, তাঁর সেই বন্ধুকে নিয়ে কিছু লিখলে সেখানে যেন তাঁর নামপরিচয় আড়াল করি।
‘এই কাহিনির সব চরিত্র কাল্পনিক’ বলে যেসব গল্প শুরু হয়, ‘আষাঢ়ে নয়’ তার ঠিক উল্টো পিঠে। এখানে সব চরিত্রই বাস্তব। ঘটনাও বলা হয় সবার নাম-পরিচয় উল্লেখ করে। এসব গল্পে পরিচয়সহ আশপাশের লোকজনের বিবরণও থাকে, যাতে পাঠকেরা অন্তত সময়টা ধরতে পারেন। কিন্তু এত দিন পরে এই মেয়ের আবদারের কাছে আমাকে হার মানতে হলো। প্রিয় পাঠক, তাই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এটা বলে, টুনটুন মেয়েটির আসল নাম নয়। তবু গল্পটা এ নামেই চলুক, কেমন?
যে ছেলেটির সঙ্গে টুনটুনের বিয়ে পাকা হয়েছিল, তাঁর নাম হাফিজুল ইসলাম। বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের দুর্গাপুরে। বাবা নুরুল ইসলামের ছয় সন্তানের মধ্যে সবার ছোট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে পরিচয় টুনটুনের সঙ্গে। পরে ঘনিষ্ঠতা থেকে বিয়ের পাকা কথা। দুজনে ভেবেছিলেন, মাস্টার্স শেষ হোক, যেকোনো একজনের চাকরি হলেই ঘর বাঁধবেন। অঞ্জন দত্তের বেলা বোসের মতো ‘মিথ্যে কথার শহরে’ লাল-নীল সংসারের স্বপ্ন দেখতেন দুজনে।
রাজশাহী থেকে চাকরির জন্য ঢাকায় এসে হাফিজুল উঠেছিলেন পূর্ব কাজীপাড়ায় এক বন্ধুর মেসে। ২০০৫ সালের ২২ এপ্রিল শুক্রবার সেই মেসের বন্ধু নুরুজ্জামানের সঙ্গে জুমার নামাজ পড়ে ফেরার পথে পূর্ব কাজীপাড়ার মাতবরের পুকুরপাড়ে গুলিবিদ্ধ হন। সে সময় ওই এলাকায় দুই দল সন্ত্রাসীর মধ্যে গুলিবিনিময় চলছিল। হঠাৎ একটি গুলি এসে হাফিজুলের গায়ে লাগে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক হাফিজুলকে মৃত ঘোষণা করেন।
কাফরুল থানার পুলিশ প্রথমে বেওয়ারিশ হিসেবে হাফিজুলের লাশটি গ্রহণ করে। পরিচয় জানার পর থানা থেকে হাফিজুলের বড় ভাই জয়নুল ইসলামকে ফোন দেয়। হাফিজুলের বাবা নুরুল ইসলাম থানায় এসে অজ্ঞাত আসামির নামে খুনের মামলা করেন। এরপর লাশ নিয়ে যান গ্রামের বাড়িতে।
হাফিজুলের ভাই জয়নুল ইসলাম দুই দিন আগে আমাকে বললেন, সেই মামলার কী হয়েছে, সেটা তাঁরা আর জানেন না। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ঢাকায় গিয়ে খুনের মামলার তদবির করার মতো অবস্থা তাঁদের নেই।
হাফিজুলের চাচাতো ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল। দুই দিন আগে তিনি আমাকে বললেন, খুনের পর কিছুদিন তিনিও এই মামলার খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেন। এখন তিনিও মামলার আর কোনো হদিস জানেন না।
সবাই যখন হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখন মামলার খোঁজ-খবর নিতেন টুনটুন। যদিও হাফিজুল নিহত হওয়ার খবর তিনি পেয়েছিলেন ঘটনার কয়েক দিন পরে। খবর শুনে ভেঙে পড়েছিলেন। ছয় মাস ঘর থেকেই বের হননি। একবার হাফিজুলদের বাড়িতেও গিয়েছিলেন সবার সঙ্গে দেখা করতে। এরপর রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসে খুনিদের গ্রেপ্তারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতেন। চিঠি লিখতেন এখানে-ওখানে। কিন্তু টুনটুনের কথা কেউ কানে তোলেনি।
এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন আমার কাছে এসেছিলেন সেই সব অভিযোগ জানাতে, সঙ্গে বিভিন্ন দপ্তরে লেখা চিঠির অনুলিপি। বলেছিলেন, তাঁর ভালোবাসার মানুষটি অবয়ব হারিয়ে শুধু একটি সংখ্যায় রূপ নিয়েছে। হাফিজুল এখন পুলিশের কাছে মামলার নম্বর ছাড়া কিছুই নয়।
হাফিজুলের সঙ্গে টুনটুনের শেষ কথা হয়েছিল রাজশাহীতে, হাফিজুলের ঢাকায় আসার আগে। প্রথম প্রস্তাবের সময় হাফিজুল তাঁকে বলেছিলেন, আমার সঙ্গে ঘর বাঁধবে? এমন ঘরভাঙানি ডাক টুনটুন উপেক্ষা করবেন কী করে? তার পরও ভালোবাসার কথা কোনো দিন মুখ ফুটে বলতে পারেননি। শুধু মনে মনে বলেছেন, ‘আমি তোমারই সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ....’।
শেষবার ঢাকায় আসার সময় এক হাট লোকের মধ্যে হাফিজুল ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন, বলো না ভালোবাসি! সেদিনও লজ্জায় নিরুত্তর ছিলেন টুনটুন। হাফিজুলের এমন মনভোলানি ডাকে কপিলার মতো তাঁরও খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘আমারে লগে নিবা মাঝি...’।
সেই টুনটুন লোকলজ্জার মাথা খেয়ে শেষবার দেখা হওয়ার সময় আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার ভালোবাসার কথা আপনি হাফিজুলের কাছে পৌঁছে দেবেন ভাই। লিখবেন, আমি তাঁকে খুব ভালোবাসি, খুব।’
টুনটুনের সেই ভালোবাসার কথা আমি লিখেছিলাম। হাফিজুলের কাছে সেই বার্তা পৌঁছেছে কি না, তা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জানেন না। এরপর নানা কাজের ভিড়ে টুনটুনকে হারিয়ে ফেলি। টুনটুনও ব্যস্ত হয়ে যান রোজকার যাপিত জীবনে। এভাবে চলতে চলতে একসময় পরিবারের চাপ আসে। বয়স বেড়ে যাচ্ছে, তবু বিয়ে করছেন না মেয়ে। চাপের কাছে একপর্যায়ে হার মানেন টুনটুন। সবকিছু ছেড়ে বিয়ে করে সংসারী হন। বন্ধ হয়ে যায় হাফিজুলের মামলার তদারকি।
হাফিজুলকে যারা খুন করেছিল, তাদের বিচারের কী হলো, তার খোঁজ নিতে কাফরুল থানায় গিয়েছিলেন আজকের পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার শাহরিয়ার হাসান। তাঁর অনুরোধে ধুলোর আস্তর সরিয়ে পুরোনা নথি খুঁজে বের করে দেন এক হৃদয়বান পুলিশ সদস্য। নথিতে দেখা গেল, এই মামলার কোনো আসামিকে পুলিশ শেষ পর্যন্ত খুঁজে পায়নি। খুনের পর সাতজনকে ধরেছিল, কিন্তু কেউ জবানবন্দি দেয়নি। মোহাম্মদ নাসিম নামের এক এসআই খুনের মামলাটি তদন্ত করেছিলেন। খুনের মাত্র আট মাসের মাথায় ২০০৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর তড়িঘড়ি করে তিনি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। তাতে উল্লেখ করেন, খুনের রহস্য তিনি উদ্ঘাটন করতে পারেনি। পুলিশের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে হাফিজুলের পক্ষ নিয়ে কেউ আদালতে নারাজি দেবেন, সে রকম লোকও ছিল না।
গত সপ্তাহের ‘আষাঢ়ে নয়’-এ চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা নিয়ে লিখেছিলাম। বিত্তশালীরা কীভাবে দেশের বিচারব্যবস্থাকে নিজের প্রয়োজনে থামিয়ে দেন, সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা হলো তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আর হাফিজুলের মামলাটি এমন, যেখানে বিচারের বাণী সরবে কাঁদে।
মামলার তদন্তের ফলাফল জানার পর টুনটুনের কাছে আবার ফোন করেছিলাম। বললাম, যে খুনের বিচার চেয়ে তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, সেই খুনের মামলার কোনো আসামিকেই খুঁজে পায়নি পুলিশ। কারও কোনো সাজাও হয়নি। এসব অগতির কথা শুনে কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন টুনটুন। কিছুই বললেন না, আবার ফোনও কাটলেন না। ফোনের ওপার থেকে শোনা যাচ্ছিল কান্নার আওয়াজ। টুনটুন কাঁদছেন।
ফোন রেখে দিতে দিতে আমার মনে হচ্ছিল, যে কান্না হৃদয় ভেঙে ঝরে, সেই বেদনা বড় সংক্রামক।
আরও পড়ুন:
সাতক্ষীরার ওয়ারী গ্রামে ব্যবসায়ী স্বামীকে শ্বাসরোধে হত্যার পর বুকের ওপর ‘সরি জান, আই লাভ ইউ’ লিখে স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। আজ শুক্রবার দুপুরে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের ওয়ারিয়ার পালপাড়ায় একটি ভাড়া বাড়ি থেকে পুলিশ মরদেহ দুটি উদ্ধার করেছে।
৩ দিন আগেরাজধানীর উত্তরায় প্রকাশ্যে এক দম্পতিকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় দায়ের করা হত্যাচেষ্টার মামলায় গ্রেপ্তার আরও ৩ ‘কিশোর গ্যাং’ সদস্যকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আজ বুধবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহিন রেজা রিমান্ডে নেওয়ার এ আদেশ দেন।
১২ দিন আগেরাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নির্যাতনের শিকার কল্পনা (১৩) সাড়ে তিন মাস চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে। আজ বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা মেডিকেল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট থেকে তাঁকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়।
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫গণহত্যার সংজ্ঞা ও বিচার নিয়ে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত সনদ হলো Genocide Convention বা গণহত্যা সনদ, যা ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত হয়। এই সনদের আওতায় একটি জাতি, নৃগোষ্ঠী, বর্ণ বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংস করার লক্ষ্যে সংঘটিত অপরাধকেই গণহত্যা বলা হয়। এর মধ্যে হত্যা, শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি,
০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫