Ajker Patrika

যে হাসির নাম বাংলাদেশ

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ০৩
Thumbnail image

জীবনে দুবার মুখের হাসি উবে গিয়েছিল চম্পার। প্রথমবার ’৭১-এর এপ্রিলে, যেদিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে গেল। আর দ্বিতীয়বার, যেদিন পাবনা মানসিক হাসপাতালের মতো ভালোবাসার আশ্রয় ছেড়ে আসতে হলো। বাকি সময় হাসিটা লেগেই ছিল মুখে। হানাদারের দল তাঁকে পাঁচ মাস ক্যাম্পে আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করেছে, কেড়ে নিয়েছিল সবকিছু। শুধু নিতে পারেনি ওই নাছোড় হাসি। এই হাসিটুকুর নামই বাংলাদেশ।

চম্পার খোঁজ আমাকে দিয়েছিলেন পাবনার তৎকালীন পুলিশ সুপার শাহ আলম সিকদার। মাদক ও চোরাচালান নিয়ে একটি রিপোর্ট করতে গিয়েছিলাম পাবনায়। পুলিশ সুপার নানা কথার ফাঁকে এই বীরাঙ্গনার কথা বলেছিলেন। পরে পাবনা মানসিক হাসপাতালে খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম, টুম্পা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে মানবাধিকার সংস্থা চম্পাকেও ঢাকায় নিয়ে গেছে।

টুম্পার কথা এর আগে ‘আষাঢ়ে নয়’-এ লিখেছিলাম। তবে সেদিন চম্পার সঙ্গে আমার দেখা না হলেও তাঁকে নিয়ে হাসপাতালের কর্মীদের ভালোবাসার কথা শুনেছিলাম। চম্পা যেদিন হাসপাতাল ছেড়ে চলে আসেন, সেদিন কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল সবাই।

ঢাকায় এসে চম্পাকে পেলাম ৩৪ বিজয়নগরে, মানবাধিকার সংস্থার অফিসে। এটা ১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিলে। দেখি, সোফার এক কোণে বসে আছেন। নাম জানতে চাইলে বললেন–চম্পা। মুখের সেই হাসিটা নীল মাছির মতো ঘুরছে।

বললাম, ছোটবেলার কথা মনে আছে? শুনে কিছু বললেন না। আপনার মা কি কপালে কাজলের টিপ দিতেন ছোটবেলায়? আবারও সেই হাসি। বললেন, নজর-টজর না লাগে, সে জন্য দিতেও পারে। তবে আমার এসব কিছু মনে নেই।

চম্পা তাঁর ছোটবেলার কোনো কথাই বলতে পারেন না। স্বজনদের নাম-পরিচয় কিছুই তাঁর মনে নেই। চম্পা নামটিও দিয়েছিলেন মানসিক হাসপাতালের এক চিকিৎসক।

চম্পা আমাকে বললেন, তাঁর শুধু মনে আছে বাড়ির পাশে একটি নদী ছিল, কুলকুল করে বয়ে যেত। বর্ষায় খরস্রোতা সেই নদীতে ঝাঁপ দিতেন। এটুকু বলতেও হাসেন। যেন দুঃখ তাঁকে কিছুতেই ছুঁতে না পারে। মানসিক হাসপাতালের লোকেরা আমাকে বলেছিলেন, চম্পার আসলে কিছুই মনে নেই। ছোটবেলার যে গল্প তিনি বলেন, সবই কল্পনা থেকে।

মানবাধিকার সংস্থার এক কর্মী আমার হাতে মানসিক হাসপাতালের কিছু কাগজ ধরিয়ে দেন। সেটা ডাক্তারি ভাষায় লেখা চম্পার জীবনবৃত্তান্ত। পড়ে যা উদ্ধার করলাম তাতে মনে হলো, চম্পার আসল নাম আলেয়া। পিতার নাম আবদুল গনি। গ্রাম পাথরঘাটা, থানা নলছিটি, জেলা বরিশাল (বর্তমানে ঝালকাঠি)। একাত্তরের এই কিশোরী কবে, কোথায় পিতামাতাকে হারিয়েছে তা কেউ জানে না।

নথি অনুসারে ’৭১-এর এপ্রিলের ঘটনা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রচণ্ড তাণ্ডব ঢাকায়। বীর মুক্তিযোদ্ধারা তখনো সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি। জীবন বাঁচাতে শহরের মানুষ দিগ্‌বিদিক ছুটছে। এভাবে পালাতে গিয়ে চম্পাও হারিয়ে ফেলেন তাঁর পিতামাতাকে। ১৩ বছরের অসহায় কিশোরী ঘুরতে থাকেন শহরময়, উদ্বাস্তুর মতো। এপ্রিলের শেষের দিকে হানাদার বাহিনী তাঁকে ধরে ফেলে। নিয়ে যায় ঢাকার সদরঘাট এলাকার আর্মি ক্যাম্পে। সেখানে ধর্ষিত হয় চম্পা। তাঁর ওপর চলতে থাকে পাশবিক নির্যাতন। এই অমানুষিক নির্যাতনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন চম্পা। ক্যাম্পের বন্দিশালায় তাঁর কেটে যায় পাঁচ মাস। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পটি দখল করেন। এ সময় সেখানে আটক অনেক মা-বোনের সঙ্গে চম্পাকেও উদ্ধার করা হয়। কিন্তু চম্পা তখন ছিলেন অজ্ঞান। নির্যাতনের চিহ্ন তাঁর সারা শরীরে। এ অবস্থায় এই বীরাঙ্গনা কিশোরীকে নিয়ে বিপাকে পড়েন মুক্তিযোদ্ধারা। অবশেষে রমনার নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে তাঁকে রাখা হয়। যুদ্ধ শেষের পরও দুই বছর ধরে সেখানে চিকিৎসা চলে। কিন্তু কোনো উন্নতি হয় না। কিছুই বলতে পারেন না, কোনো কিছুই মনেও করতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত চম্পাকে পাঠানো হয় পাবনার মানসিক হাসপাতালে।

হাসপাতালের নথিতে রয়েছে, রমনার নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের মেট্রন মীরা চৌধুরী তাঁকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। মীরা চৌধুরী আর বেঁচে নেই। হাসপাতালের খাতায় ভর্তির তারিখ রয়েছে ২২ অক্টোবর, ১৯৭৩। এরপর থেকে কেউ আর চম্পার খোঁজ করতে আসেনি।

কয়েক মাস চিকিৎসার পর চম্পা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যান। কিন্তু তিনি আর যাবেন কোথায়? হাসপাতালেই থেকে যান। মানসিক হাসপাতালের নথিতে মেট্রন মীরা চৌধুরী যে ঠিকানা দিয়েছিলেন, সেই ঠিকানায় অনেকবার চিঠি পাঠিয়েছিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তার কোনো উত্তর আসেনি। চিঠি গেছে আকাশের ঠিকানায়।

’৯৮ সালে মানবাধিকার সংস্থার কর্মীরা মানসিক হাসপাতাল থেকে টুম্পা নামের মেয়েটিকে উদ্ধার করতে গিয়ে চম্পার খোঁজ পান। টুম্পার সঙ্গে তিনিও চম্পাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেই থেকে চম্পা ঢাকায় মানবাধিকার সংস্থার আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন। এখন তাঁর বয়স ৬৪ বছর। চম্পার খোঁজ করতে গিয়ে কয়েক দিন আগে ফোন দিয়েছিলাম আইনজীবী এলিনা খানকে। তিনি বললেন, আশ্রয়কেন্দ্রে বেশ ভালোই আছেন চম্পা।

’৭৩ সালে মানসিক হাসপাতালে যাওয়ার পর ২৫ বছর সেখানেই কাটান চম্পা। এত দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকার সুবাদে অনেক কাজ শিখে গিয়েছিলেন। হাসপাতালের নার্সদের মতো রোগীর সেবা করতেন। আর করতেন বাগান পরিচর্যার কাজ। কাজের ফাঁকে জনে জনে বিলিয়ে দিতেন মুখের সেই হাসি। নতুন রোগী এলেই তাঁর সঙ্গে ভাব জমে যেত। কেউ হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেলে ডুকরে কেঁদে উঠতেন স্বজন হারানোর বেদনায়।

চম্পার কাছে এসে হাসপাতালের সেই গল্প তুলতেই হেসে ফেললেন। কিন্তু তাঁর দুই চোখ টলটল। পাশে বসে জানতে চাইলাম, এখন বয়স কত হলো? বললেন, ৪০-৫০ হবে। কিছু খেয়েছেন কি না বলতেই বললেন, কলা-টলা খেয়েছি।

চম্পাকে যা জিজ্ঞাসা করি, শব্দের মাঝে হাইফেন দেওয়া উত্তর দেন। সেটাই তাঁর বাতিক। ৪০-৫০, কলা-টলা, এটা-সেটা...।

কিন্তু ওই হাইফেনের ভেতরে কী আছে, তা কি জানেন চম্পা? হয়তো আছে এক দুরন্ত বালিকার ফেলে আসা জীবন, মায়ের হাতে নিকানো উঠান, আলপথ ধরে হেঁটে যাওয়া বিস্তীর্ণ প্রান্তর। আর আছে একটি স্বাধীন দেশের লাল-সবুজের পতাকা। হাওয়ায় দোল খাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই নুয়ে পড়ছে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত