কামরুল হাসান
পুরোনো পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে মুহাম্মদ আবদুল হান্নানের প্রতি আমার বিশেষ টান ছিল। কাজের ফাঁকে সময়-সুযোগ পেলেই তাঁর কাছে ছুটে যেতাম গল্প শুনতে। একনিষ্ঠ শ্রোতা পেয়ে তিনিও বৈঠকি ঢঙে গল্প চালিয়ে যেতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাঁর গল্পগুলো সাধারণ কোনো গল্প ছিল না, ছিল হিরের কুচির মতো, যার পরতে পরতে ছড়ানো থাকত খবরের উপাদান। সংবাদকর্মী হিসেবে সেই গল্প আমাকে আঠার মতো বেঁধে রাখত।
আবদুল হান্নান পান খেতেন কড়া জর্দা দিয়ে। গালে পান না থাকলে তাঁর আলাপই জমত না। আমি সামনে গেলে ‘বও মিয়া’ বলেই একটা পান এমনভাবে মুখে গুঁজে দিতেন, যেন এর চেয়ে সুখ আর কোনো কিছুতে নেই। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে মনে হতো, হুমায়ূন আহমেদের নাটকের চরিত্র সামনে বসা।
প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসা বিএনপি আমলের শেষের দিকে (১৯৯৬) তিনি ছিলেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার। এরপর আসেন এসবিতে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাঁর পোস্টিং হয় ডিবিতে, ডিসি ডিবি হিসেবে। ডিবিতে তখন একজনই ডিসি ছিলেন। এরপর দ্বিতীয় দফায় বিএনপি ক্ষমতায় এসে প্রথম যে ১৫ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়, তিনি ছিলেন সেই তালিকায়। যেদিন অবসরে গেলেন, সেদিনও মুখে একটা পান পুরে হাসতে হাসতে অফিস ছাড়লেন।
একদিন তিনি আমাকে একটি অস্ত্রের চালানের গল্প বললেন। তাঁর কাছে তখন কোনো কাগজপত্র ছিল না, স্মৃতিতে যতটুকু ছিল। সেই গল্প শোনার পর লেগে পড়লাম ঘটনার আদ্যোপান্ত জানতে। দিন দশেকের মধ্যে সব তথ্য মোটাতাজা হয়ে গেল। ফিরে এসে তাঁকে যখন সবকিছু খুলে বললাম, শুনে খুব খুশি হলেন। কিন্তু কী কারণে যেন পত্রিকায় সেই রিপোর্টটা ছাপা হলো না। বছর পাঁচেক পর (১৮ মে ২০০৫, প্রথম আলো) সেই রিপোর্ট ছাপা হলো নতুন কর্মস্থলে। আজ ‘আষাঢ়ে নয়’-এ সেই ঘটনা বলি।
১৯৯৬ সালের ২৪ মার্চ। কক্সবাজারে পরিবেশ হঠাৎ গুমোট। বড় একটি অস্ত্রের চালান আসছে এমন একটি আলোচনা চলছে ভেতরে-ভেতরে, কিন্তু পরিষ্কার করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। পুলিশ ও গোয়েন্দারা নানা দিক থেকে ভাসা ভাসা তথ্য পাচ্ছেন, কিন্তু কিনারা করতে পারছেন না। হঠাৎ স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যান ফোন করলেন পুলিশ সুপারের অফিসের নম্বরে। বললেন, চোফলদণ্ডি ইউনিয়নের জেটিঘাটে গভীর রাতে একটি অস্ত্রভর্তি জাহাজ ভিড়ছে। ট্রলার থেকে সেই অস্ত্র ট্রাকে তোলা হবে। এ খবর পেয়েই পুলিশ সুপার যোগাযোগ করেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে। শুরু করেন অভিযানের প্রস্তুতি।
আবদুল হান্নান আমাকে বলেছিলেন, ঘটনাস্থল ছিল কক্সবাজার শহর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে, মহেশখালীর পূর্ব পাশে। রাত দেড়টার দিকে ঘাটে ভেড়ে অস্ত্রভর্তি দুটি ট্রলার। এর একটু পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। একটি ট্রাক আগে থেকেই সেখানে রাখা ছিল। ট্রলার দুটি ঘাটে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে একদল অস্ত্রধারী চারদিকে দাঁড়িয়ে অস্ত্র খালাস শুরু করে। হঠাৎ চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলা হয়। উপায় না দেখে আত্মসমর্পণ করেন ১৩ যুবক, এঁরা কেউ বাংলা জানেন না। জিজ্ঞাসাবাদে বললেন, তাঁরা সবাই নাগাল্যান্ডের বাসিন্দা।
আবদুল হান্নানের সূত্র ধরে কক্সবাজারে গিয়ে সেই ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীকে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম। তাঁরা আমাকে বলেছিলেন, অস্ত্র পরিবহনের জন্য আনা আটক ট্রাক দুটির মালিক ছিলেন বাবুল ও কবির কোম্পানি নামের দুই ভাই। তখনকার স্থানীয় বড়শি বোট মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল কাদের এবং জিপ-মাইক্রো শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা মো. কামাল বান্দরবানে চালের বস্তা নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ট্রাক দুটি ঈদগাহ এলাকা থেকে ভাড়া করেছিলেন। সে সময় কাদের ও কামালের মধ্যস্থতায় জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের জন্য ভাড়া করা হয় মাছ ধরার ট্রলার। আর সামনে থেকে অস্ত্রের চালান খালাসের কাজ তদারক করছিলেন ভারতের নাগাল্যান্ডের বিদ্রোহী নেতা সম্বুয়েং। অস্ত্রের চালান ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্বুয়েং পালিয়ে যান। সে সময় অনেকে আমাকে বলেছিলেন, অস্ত্রের চালান আটকের ৮-৯ মাস আগে থেকে তিনি কক্সবাজারের রাখাইনপাড়ায় বসবাস শুরু করেন। সেখানে বিয়েও করেন। পরে ২০০৩ সালে নাগাল্যান্ড পুলিশের গুলিতে সম্বুয়েং মারা যান বলে শুনেছিলাম।
এই অভিযানে থাকা অনেকে আমাকে বলেছিলেন, আটক হওয়া যুবকেরা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছিলেন, তাঁরা সবাই নাগাল্যান্ডের উগ্রপন্থী গ্রুপের সদস্য। পুরো টিমের নেতৃত্বে ছিলেন গ্রুপের ব্রিগেডিয়ার পদবিধারী জেমস। নাগাল্যান্ডের উখায় তাঁর বাড়ি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও ১২ জন, যাঁরা নাগা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানতেন না।
তখন আটক উগ্রপন্থীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছিল যে তাঁরা এই অস্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন কম্বোডিয়ার খেমাররুজ বিদ্রোহী গ্রুপের কাছ থেকে। এরপর অস্ত্রভর্তি জাহাজটি গভীর সমুদ্রবন্দরে নোঙর করা হয়। এটি তখন পর্যন্ত ছিল দেশের ইতিহাসে প্রথম বড় অস্ত্রের চালান। অস্ত্রভর্তি জাহাজটি থাইল্যান্ডের একটি বন্দর থেকে এসেছিল।
উদ্ধার করা অস্ত্র প্রথমে নিয়ে আসা হয় কক্সবাজার জেলা পুলিশ লাইনসে। সেই চালানে ছিল এসএমজি ৩১২টি, রাইফেল ১১২টি, এলএমজি ৪৮টি, পিস্তল ১৬৮টি, ম্যাগাজিন ৩ হাজার ৫১৫টি, আরআর চায়নিজ ২০টি, মর্টার-৯টি, মর্টার সাইট ৯টি, এলএমজি ড্রাম ম্যাগাজিন ২৪০টি, এসএমজি ম্যাগাজিন ১৭৯টি, এএমজি ৩ হাজার ৯৩৪টি, অস্ত্রের যন্ত্রাংশ ২ বস্তা, এলএমজি-এসএমজি অ্যাম্যুনেশন ৭৬ বস্তা, এসএমজি ম্যাগাজিন ১১ বস্তা, আরআর গোলা ৬৯ বস্তা, হ্যান্ডগ্রেনেড ১৩ বস্তা এবং ৮ বস্তা বিস্ফোরক।
অস্ত্র উদ্ধারের পর চট্টগ্রামের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান সেখানে পরিদর্শনে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র দেখে উপস্থিত সবার সামনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি তখন উপস্থিত পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, এসব অস্ত্র দিয়ে সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড সাজানো সম্ভব। ওই চালান আটকের সময় উপস্থিত একজন পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন, অস্ত্র খালাসের সময় ১৩ জন উগ্রপন্থীকে আটক করা হয়েছিল। তাঁদের হাতে তখন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াকিটকি ছিল।
অনুসন্ধানের সময় কক্সবাজার আদালতের সাবেক এপিপি নূরুল ইসলাম আমাকে বলেন, ১৩ জন নাগা বিদ্রোহীকে তখন ৫৪ ধারায় কক্সবাজার আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
মেজর জেনারেল (অব.) এম আজিজুর রহমান ২০০৫ সালে আমাকে বলেছিলেন, চোফলদণ্ডির আগে আরও একটি চালান ধরা পড়েছিল। তবে সেটা তত বড় নয়।
অস্ত্রের চালান আটকের পর ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কক্সবাজার শহরে প্রতিবাদ সমাবেশ করে বিএনপি সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন, কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর এ নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করেননি। এরপর ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম থেকে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান ধরা পড়ে।
১০ ট্রাক অস্ত্রের চালানের তদন্তে বেরিয়ে আসে, সেই চালানের অর্থ জুগিয়েছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। আর তাদের হয়ে চালানের টাকা অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানিকে পরিশোধ করেছিলেন দুবাইয়ের এআরওয়াই টিভির মালিক আবদুর রাজ্জাক ইউসুফ। আমার ধারণা, এই চালানের সঙ্গেও তারা থাকতে পারে।
আবদুল হান্নানের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল বছরখানেক আগে। কথায় কথায় তাঁকে বলেছিলাম, আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছিও। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, শুধু পান খাওয়াটা শিখলেন না।
আরও পড়ুন:
পুরোনো পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে মুহাম্মদ আবদুল হান্নানের প্রতি আমার বিশেষ টান ছিল। কাজের ফাঁকে সময়-সুযোগ পেলেই তাঁর কাছে ছুটে যেতাম গল্প শুনতে। একনিষ্ঠ শ্রোতা পেয়ে তিনিও বৈঠকি ঢঙে গল্প চালিয়ে যেতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তাঁর গল্পগুলো সাধারণ কোনো গল্প ছিল না, ছিল হিরের কুচির মতো, যার পরতে পরতে ছড়ানো থাকত খবরের উপাদান। সংবাদকর্মী হিসেবে সেই গল্প আমাকে আঠার মতো বেঁধে রাখত।
আবদুল হান্নান পান খেতেন কড়া জর্দা দিয়ে। গালে পান না থাকলে তাঁর আলাপই জমত না। আমি সামনে গেলে ‘বও মিয়া’ বলেই একটা পান এমনভাবে মুখে গুঁজে দিতেন, যেন এর চেয়ে সুখ আর কোনো কিছুতে নেই। তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে মনে হতো, হুমায়ূন আহমেদের নাটকের চরিত্র সামনে বসা।
প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসা বিএনপি আমলের শেষের দিকে (১৯৯৬) তিনি ছিলেন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার। এরপর আসেন এসবিতে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাঁর পোস্টিং হয় ডিবিতে, ডিসি ডিবি হিসেবে। ডিবিতে তখন একজনই ডিসি ছিলেন। এরপর দ্বিতীয় দফায় বিএনপি ক্ষমতায় এসে প্রথম যে ১৫ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়, তিনি ছিলেন সেই তালিকায়। যেদিন অবসরে গেলেন, সেদিনও মুখে একটা পান পুরে হাসতে হাসতে অফিস ছাড়লেন।
একদিন তিনি আমাকে একটি অস্ত্রের চালানের গল্প বললেন। তাঁর কাছে তখন কোনো কাগজপত্র ছিল না, স্মৃতিতে যতটুকু ছিল। সেই গল্প শোনার পর লেগে পড়লাম ঘটনার আদ্যোপান্ত জানতে। দিন দশেকের মধ্যে সব তথ্য মোটাতাজা হয়ে গেল। ফিরে এসে তাঁকে যখন সবকিছু খুলে বললাম, শুনে খুব খুশি হলেন। কিন্তু কী কারণে যেন পত্রিকায় সেই রিপোর্টটা ছাপা হলো না। বছর পাঁচেক পর (১৮ মে ২০০৫, প্রথম আলো) সেই রিপোর্ট ছাপা হলো নতুন কর্মস্থলে। আজ ‘আষাঢ়ে নয়’-এ সেই ঘটনা বলি।
১৯৯৬ সালের ২৪ মার্চ। কক্সবাজারে পরিবেশ হঠাৎ গুমোট। বড় একটি অস্ত্রের চালান আসছে এমন একটি আলোচনা চলছে ভেতরে-ভেতরে, কিন্তু পরিষ্কার করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। পুলিশ ও গোয়েন্দারা নানা দিক থেকে ভাসা ভাসা তথ্য পাচ্ছেন, কিন্তু কিনারা করতে পারছেন না। হঠাৎ স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যান ফোন করলেন পুলিশ সুপারের অফিসের নম্বরে। বললেন, চোফলদণ্ডি ইউনিয়নের জেটিঘাটে গভীর রাতে একটি অস্ত্রভর্তি জাহাজ ভিড়ছে। ট্রলার থেকে সেই অস্ত্র ট্রাকে তোলা হবে। এ খবর পেয়েই পুলিশ সুপার যোগাযোগ করেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে। শুরু করেন অভিযানের প্রস্তুতি।
আবদুল হান্নান আমাকে বলেছিলেন, ঘটনাস্থল ছিল কক্সবাজার শহর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে, মহেশখালীর পূর্ব পাশে। রাত দেড়টার দিকে ঘাটে ভেড়ে অস্ত্রভর্তি দুটি ট্রলার। এর একটু পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। একটি ট্রাক আগে থেকেই সেখানে রাখা ছিল। ট্রলার দুটি ঘাটে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে একদল অস্ত্রধারী চারদিকে দাঁড়িয়ে অস্ত্র খালাস শুরু করে। হঠাৎ চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলা হয়। উপায় না দেখে আত্মসমর্পণ করেন ১৩ যুবক, এঁরা কেউ বাংলা জানেন না। জিজ্ঞাসাবাদে বললেন, তাঁরা সবাই নাগাল্যান্ডের বাসিন্দা।
আবদুল হান্নানের সূত্র ধরে কক্সবাজারে গিয়ে সেই ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীকে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম। তাঁরা আমাকে বলেছিলেন, অস্ত্র পরিবহনের জন্য আনা আটক ট্রাক দুটির মালিক ছিলেন বাবুল ও কবির কোম্পানি নামের দুই ভাই। তখনকার স্থানীয় বড়শি বোট মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল কাদের এবং জিপ-মাইক্রো শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা মো. কামাল বান্দরবানে চালের বস্তা নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ট্রাক দুটি ঈদগাহ এলাকা থেকে ভাড়া করেছিলেন। সে সময় কাদের ও কামালের মধ্যস্থতায় জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের জন্য ভাড়া করা হয় মাছ ধরার ট্রলার। আর সামনে থেকে অস্ত্রের চালান খালাসের কাজ তদারক করছিলেন ভারতের নাগাল্যান্ডের বিদ্রোহী নেতা সম্বুয়েং। অস্ত্রের চালান ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্বুয়েং পালিয়ে যান। সে সময় অনেকে আমাকে বলেছিলেন, অস্ত্রের চালান আটকের ৮-৯ মাস আগে থেকে তিনি কক্সবাজারের রাখাইনপাড়ায় বসবাস শুরু করেন। সেখানে বিয়েও করেন। পরে ২০০৩ সালে নাগাল্যান্ড পুলিশের গুলিতে সম্বুয়েং মারা যান বলে শুনেছিলাম।
এই অভিযানে থাকা অনেকে আমাকে বলেছিলেন, আটক হওয়া যুবকেরা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছিলেন, তাঁরা সবাই নাগাল্যান্ডের উগ্রপন্থী গ্রুপের সদস্য। পুরো টিমের নেতৃত্বে ছিলেন গ্রুপের ব্রিগেডিয়ার পদবিধারী জেমস। নাগাল্যান্ডের উখায় তাঁর বাড়ি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও ১২ জন, যাঁরা নাগা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানতেন না।
তখন আটক উগ্রপন্থীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছিল যে তাঁরা এই অস্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন কম্বোডিয়ার খেমাররুজ বিদ্রোহী গ্রুপের কাছ থেকে। এরপর অস্ত্রভর্তি জাহাজটি গভীর সমুদ্রবন্দরে নোঙর করা হয়। এটি তখন পর্যন্ত ছিল দেশের ইতিহাসে প্রথম বড় অস্ত্রের চালান। অস্ত্রভর্তি জাহাজটি থাইল্যান্ডের একটি বন্দর থেকে এসেছিল।
উদ্ধার করা অস্ত্র প্রথমে নিয়ে আসা হয় কক্সবাজার জেলা পুলিশ লাইনসে। সেই চালানে ছিল এসএমজি ৩১২টি, রাইফেল ১১২টি, এলএমজি ৪৮টি, পিস্তল ১৬৮টি, ম্যাগাজিন ৩ হাজার ৫১৫টি, আরআর চায়নিজ ২০টি, মর্টার-৯টি, মর্টার সাইট ৯টি, এলএমজি ড্রাম ম্যাগাজিন ২৪০টি, এসএমজি ম্যাগাজিন ১৭৯টি, এএমজি ৩ হাজার ৯৩৪টি, অস্ত্রের যন্ত্রাংশ ২ বস্তা, এলএমজি-এসএমজি অ্যাম্যুনেশন ৭৬ বস্তা, এসএমজি ম্যাগাজিন ১১ বস্তা, আরআর গোলা ৬৯ বস্তা, হ্যান্ডগ্রেনেড ১৩ বস্তা এবং ৮ বস্তা বিস্ফোরক।
অস্ত্র উদ্ধারের পর চট্টগ্রামের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান সেখানে পরিদর্শনে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র দেখে উপস্থিত সবার সামনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি তখন উপস্থিত পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, এসব অস্ত্র দিয়ে সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড সাজানো সম্ভব। ওই চালান আটকের সময় উপস্থিত একজন পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন, অস্ত্র খালাসের সময় ১৩ জন উগ্রপন্থীকে আটক করা হয়েছিল। তাঁদের হাতে তখন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াকিটকি ছিল।
অনুসন্ধানের সময় কক্সবাজার আদালতের সাবেক এপিপি নূরুল ইসলাম আমাকে বলেন, ১৩ জন নাগা বিদ্রোহীকে তখন ৫৪ ধারায় কক্সবাজার আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাঁদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
মেজর জেনারেল (অব.) এম আজিজুর রহমান ২০০৫ সালে আমাকে বলেছিলেন, চোফলদণ্ডির আগে আরও একটি চালান ধরা পড়েছিল। তবে সেটা তত বড় নয়।
অস্ত্রের চালান আটকের পর ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কক্সবাজার শহরে প্রতিবাদ সমাবেশ করে বিএনপি সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন, কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর এ নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করেননি। এরপর ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম থেকে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান ধরা পড়ে।
১০ ট্রাক অস্ত্রের চালানের তদন্তে বেরিয়ে আসে, সেই চালানের অর্থ জুগিয়েছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। আর তাদের হয়ে চালানের টাকা অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানিকে পরিশোধ করেছিলেন দুবাইয়ের এআরওয়াই টিভির মালিক আবদুর রাজ্জাক ইউসুফ। আমার ধারণা, এই চালানের সঙ্গেও তারা থাকতে পারে।
আবদুল হান্নানের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়েছিল বছরখানেক আগে। কথায় কথায় তাঁকে বলেছিলাম, আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছিও। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, শুধু পান খাওয়াটা শিখলেন না।
আরও পড়ুন:
চাঁদপুর-মুন্সিগঞ্জ নৌ সীমানার মোহনপুর এলাকায় মেঘনা নদীতে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে দুই জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরও একজন। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মুন্সিগঞ্জ ও চাঁদপুর মতলব উত্তর মোহনপুরের চড় আব্দুল্লাহপুর নাছিরার চরে নদীতে এ ঘটনা ঘটে।
১ দিন আগেরাজধানীর মোহাম্মদপুরে আবারও অস্ত্রের মুখে একটি পরিবারকে জিম্মি করে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আজ বৃহস্পতিবার ভোররাতে মোহাম্মদপুরের বছিলাসংলগ্ন লাউতলা এলাকার ৮ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তত্ত্বাবধায়ক নাসিমা বেগম মোহাম্মদপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।
২৮ নভেম্বর ২০২৪রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
০৮ নভেম্বর ২০২৪পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
০৭ নভেম্বর ২০২৪