কামরুল হাসান
‘ইন্টারোগেশন চেম্বারে’ বসা এক নারী আসামি। দুই হাত চেয়ারের সঙ্গে আটকানো। নড়ার কোনো উপায় নেই। চোখের ওপরে উজ্জ্বল আলো; সামনে কারা আছেন, তা-ও দেখা যাচ্ছে না। তিন সংস্থার তিনজন কর্মকর্তা জেরার জন্য প্রস্তুত। সবার হাতে নারী সম্পর্কে একটি গোপন প্রতিবেদন।
– আপনার নাম?
– নাসিমা আক্তার।
– বাড়ি?
– ঢাকার রামপুরা।
–আপনি তো বোমা মেরে বিদ্যুৎকেন্দ্র উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। আপনার সঙ্গে আর কারা আছে?
নাসিমা নীরব। এ প্রশ্নের কোনো উত্তর তিনি জানেন না। যতই অস্বীকার করেন, কেউ বিশ্বাস করেন না। এভাবে কেটে যায় এক দিন। পরের দিন আবার জেরা, সেই একই প্রশ্ন—কেন নাশকতার ছক কষলেন? কথায় কাজ না হলে জিজ্ঞাসাবাদের মাত্রা বাড়ানোর ইঙ্গিত। তবু অটল নাসিমা। তাঁর একটাই কথা, ‘আমি এসবের কিছু জানি না।’
নেটফ্লিক্সে ‘গুল’ (Ghoul) নামে একটি ভারতীয় সিনেমা আছে। মূল চরিত্রে রাধিকা আপ্তে অভিনয় করেছেন। বিশেষায়িত জিজ্ঞাসাবাদ সেলে কীভাবে আসামিদের জেরা করা হয়, তা দেখানো হয়েছে সেই ছবিতে। সেটা দেখলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে। নাসিমার জেরাও ‘গুল’-এর সেই জিজ্ঞাসাবাদ দৃশ্যের চেয়ে কম কিছু হয়নি। টানা তিন দিন তাঁকে জেরা করে ক্ষান্ত হন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এরপর থানা-পুলিশের কাছে ফেরত পাঠানো হয়। সেখানে আরও কয়েক দিন রিমান্ডে থাকেন।
এই ‘ভয়ংকর’ আসামি নাসিমা আক্তারকে ধরেছিল খিলগাঁও থানা-পুলিশ। তখন খিলগাঁওয়ের ওসি ছিলেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ। নাসিমা থাকতেন রামপুরার একটি বাসায়। সেই বাসা থেকে ১৯৯৯ সালের ২৫ এপ্রিল তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ। বলা হয়, তিনি পানি শোধনাগার ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন। গ্রেপ্তারের পর সে কারণেই তাঁকে টিএফআই বা টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেলে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঠানো হয়।
নাসিমাকে গ্রেপ্তারের পর মিন্টো রোডের পুলিশের জনসংযোগ শাখা থেকে তাঁর ছবিসহ তথ্য পাঠিয়ে খিলগাঁও থানার ওসি এবং পুলিশের জনসংযোগ শাখার একজন কর্মকর্তা ফোন করে সাংবাদিকদের অনুরোধ করেছিলেন, যাতে ভালো করে ছাপা হয়। অবশ্য পরের দিন দেশের সব দৈনিকের প্রথম পাতায় ছবিসহ নাসিমাকে গ্রেপ্তারের খবর ফলাও করে ছাপা হয়। তাতে বলা হয়, তিনি একজন ভয়ংকর আসামি। আমার মনে আছে, জনকণ্ঠে প্রথম পাতার ডান দিকে শেষ কলামে নাসিমার ছবিসমেত খবর ছাপা হয়েছিল।
স্বাভাবিকভাবেই পরের দিন খিলগাঁও থানায় গেলাম নাসিমার ফলোআপ করতে। নাসিমাকে নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকার কভারেজে ওসি অনেক খুশি। কিছুক্ষণ পরপর তাঁর ফোন আসছে। এর মধ্যে একটি ফোনালাপ আমার কানে এল। মনে হলো, নাসিমাকে নিয়ে খবর দেওয়ার ব্যাপারে কেউ তাঁকে সাবধান করে দিচ্ছেন। অনেকক্ষণ বসে আছি, ওসি এটা-সেটা খাওয়াচ্ছেন কিন্তু কোনো তথ্য দিচ্ছেন না। নাসিমার বাড়ির নম্বর চাইতেই তাঁর মুখ কালো হয়ে গেল। একটু আমতা-আমতা করলেন, দেব-দিচ্ছি করে আর দিলেন না। আমার মনে হলো, এ ঘটনার মধ্যে অন্য কিছু আছে। ডিউটি অফিসারের কাছে গিয়ে জানতে পারলাম, নাসিমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়নি, তাঁকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। খটকা আরও বেড়ে গেল।
পরিচিত ডিউটি অফিসারের কাছ থেকে নাসিমার বাসার নম্বর নিয়ে গেলাম রামপুরায় নাসিমার বাসায়। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। বাসায় তালা ঝুলছে। নাসিমা গ্রেপ্তারের পর বাড়ির সবাই ভয়ে অন্যত্র চলে গেছে। এক প্রতিবেশী বললেন, মেয়েটাকে ফাঁসানো হয়েছে। কিন্তু কী নিয়ে ফাঁসানো হয়েছে, তা তিনি জানেন না। রিমান্ড শেষ হওয়ার পর নাসিমাকে পাঠানো হলো কারাগারে। এবার মনে হলো, উপায় হলেও হতে পারে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কর্মকর্তাকে অনুরোধ করলাম নাসিমার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। তিনি ব্যবস্থা করে দিলেন। জেলারের অফিস রুমের ঢোকার মুখে বন্দীদের সাক্ষাতের একটি স্থানে নাসিমাকে আনা হলো। প্রথমে অচেনা লোক দেখে তিনি একটু ঘাবড়ে গেলেন। পরে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। পকেটে মিনি টেপরেকর্ডার। নাসিমা যা বলছেন, সব রেকর্ড হচ্ছে।
ঢাকার মেয়ে নাসিমা এসএসসি পাস করার পর একটি চাকরি নিয়ে কুয়েতে চলে যান। সেখানে দিনকাল ভালোই চলছিল। এর মধ্যে ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট কুয়েত আক্রমণ করল ইরাক। অবস্থা বুঝে তিনি দেশে চলে এলেন। নিজের জমানো টাকা দিয়ে উত্তরায় ২১ শতক জমি কিনলেন। ইচ্ছে ছিল, বিয়ে করে সুখে সংসার করার। ইত্তেফাক পত্রিকার ‘পাত্র চাই’ কলামে বিজ্ঞাপন দিলেন। এগিয়ে আসেন জাকির হোসেন নামের এক প্রকৌশলী। পরে দুজনে সম্মত হয়ে বিয়ে করে রামপুরায় থাকতে শুরু করেন।
ধীরে ধীরে কুয়েতের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেল। কোম্পানি থেকে ডাক এল ফিরে যাওয়ার জন্য। জাকির তখন তাঁকে প্রস্তাব দিলেন উত্তরার সেই ২১ শতক জমিটি তাঁকে লিখে দিতে হবে। তিনি গ্রামে গিয়ে ব্যবসা করবেন। নাসিমা কিছুতেই রাজি না। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হলো। নাসিমা একাই কুয়েত চলে গেলেন। কয়েক মাস পরে কুয়েতে বসে পেলেন ডিভোর্সের চিঠি। সেই চিঠি হাতে পেয়ে মন খারাপ করে আবার দেশে ফিরে এলেন। জাকিরের কাছে কারণ জানতে চাইলেন। জাকির সব ভুলে গিয়ে আবার তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলেন, করলেনও। কিন্তু মনে মনে জাকির জমি দখলের ফন্দি আঁটলেন।
নাসিমার উত্তরার জমির সীমানা নিয়ে এক প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধ ছিল। জাকির তাঁর সঙ্গে হাত মেলালেন। সেই জমির মালিকের এক বন্ধু ছিলেন একটি বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা। তাঁর সাহায্য নিয়েই নাসিমাকে রাষ্ট্রদ্রোহী সাজিয়ে গ্রেপ্তার করালেন। নাসিমা আমাকে বললেন, পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করার পর একদিন রাতে চোখ বেঁধে একটি স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখেন সেই কর্মকর্তা বসে আছেন। ওই কর্মকর্তা তাঁকে হুমকি দিয়ে বলেন, জমিটা ছেড়ে না দিলে জানটা আর থাকবে না। নাসিমা বললেন, কষ্টের টাকায় কেনা একখণ্ড জমি সুখের বদলে তাঁর জীবনের কাল হয়ে গেল। সাক্ষাৎকার নিয়ে বের হয়ে এলাম। পরের দিন সেই খবর ছাপা হলো।
এরপর হইচই পড়ে গেল। বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নজর এড়াল না। তিনি পুলিশকে সব খতিয়ে দেখতে বললেন। খিলগাঁওয়ের ওসিকে সরিয়ে দেওয়া হলো। নাসিমার স্বামী প্রকৌশলী জাকির অবস্থা বেগতিক দেখে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে নিজের দোষ এড়ানোর চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, নাসিমার সঙ্গে বড় বড় সন্ত্রাসীর জানাশোনা আছে। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা যেসব প্রশ্ন করলেন, তার কোনোটারই সদুত্তর তিনি দিতে পারলেন না।
অবশেষে ১৯৯৯ সালের ৩ মে নাসিমা জামিনে মুক্ত হলেন। আদালত থেকে বারবার পুলিশের কাছে রাষ্ট্রদ্রোহের তথ্যপ্রমাণ চাওয়া হলো। কিন্তু পুলিশ এসব দিতে ব্যর্থ হলো। শেষ পর্যন্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেলেন নাসিমা। নাসিমা মুক্তি পাওয়ার পর প্রায় সব কাগজেই তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হলো। কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থাও তাঁকে সহায়তা দিতে এগিয়ে এল। অনেক কাজের ভিড়ে নাসিমাকে ভুলে গেলাম।
কয়েক বছর পর কী একটা কাজে বিমানবন্দরে গেছি। দেখি বিদেশগামী যাত্রীদের লাইনে নাসিমা দাঁড়িয়ে, বোর্ডিং কার্ড নিচ্ছেন। আমাকে দেখে চিনতে পেরে এগিয়ে এলেন। বললেন, নিজের জীবনটুকু ছাড়া আর সবই হারিয়েছেন। জমি-বাড়ি কিছুই নেই তাঁর, আছে শুধু জীবনটা। এটা আর হারাতে চান না, তাই বিদেশ চলে যাচ্ছেন। এটুকু বলতেই চোখ ছলছল করে উঠল নাসিমার, বাঁ হাতে চোখ-মুখ মুছে ইমিগ্রেশনের দিকে এগোলেন। আমিও আর কিছুই বলতে পারলাম না, শুধু তাঁর পথের দিকে চেয়ে রইলাম।
আরও পড়ুন:
‘ইন্টারোগেশন চেম্বারে’ বসা এক নারী আসামি। দুই হাত চেয়ারের সঙ্গে আটকানো। নড়ার কোনো উপায় নেই। চোখের ওপরে উজ্জ্বল আলো; সামনে কারা আছেন, তা-ও দেখা যাচ্ছে না। তিন সংস্থার তিনজন কর্মকর্তা জেরার জন্য প্রস্তুত। সবার হাতে নারী সম্পর্কে একটি গোপন প্রতিবেদন।
– আপনার নাম?
– নাসিমা আক্তার।
– বাড়ি?
– ঢাকার রামপুরা।
–আপনি তো বোমা মেরে বিদ্যুৎকেন্দ্র উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। আপনার সঙ্গে আর কারা আছে?
নাসিমা নীরব। এ প্রশ্নের কোনো উত্তর তিনি জানেন না। যতই অস্বীকার করেন, কেউ বিশ্বাস করেন না। এভাবে কেটে যায় এক দিন। পরের দিন আবার জেরা, সেই একই প্রশ্ন—কেন নাশকতার ছক কষলেন? কথায় কাজ না হলে জিজ্ঞাসাবাদের মাত্রা বাড়ানোর ইঙ্গিত। তবু অটল নাসিমা। তাঁর একটাই কথা, ‘আমি এসবের কিছু জানি না।’
নেটফ্লিক্সে ‘গুল’ (Ghoul) নামে একটি ভারতীয় সিনেমা আছে। মূল চরিত্রে রাধিকা আপ্তে অভিনয় করেছেন। বিশেষায়িত জিজ্ঞাসাবাদ সেলে কীভাবে আসামিদের জেরা করা হয়, তা দেখানো হয়েছে সেই ছবিতে। সেটা দেখলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে। নাসিমার জেরাও ‘গুল’-এর সেই জিজ্ঞাসাবাদ দৃশ্যের চেয়ে কম কিছু হয়নি। টানা তিন দিন তাঁকে জেরা করে ক্ষান্ত হন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এরপর থানা-পুলিশের কাছে ফেরত পাঠানো হয়। সেখানে আরও কয়েক দিন রিমান্ডে থাকেন।
এই ‘ভয়ংকর’ আসামি নাসিমা আক্তারকে ধরেছিল খিলগাঁও থানা-পুলিশ। তখন খিলগাঁওয়ের ওসি ছিলেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ। নাসিমা থাকতেন রামপুরার একটি বাসায়। সেই বাসা থেকে ১৯৯৯ সালের ২৫ এপ্রিল তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ। বলা হয়, তিনি পানি শোধনাগার ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন। গ্রেপ্তারের পর সে কারণেই তাঁকে টিএফআই বা টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেলে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঠানো হয়।
নাসিমাকে গ্রেপ্তারের পর মিন্টো রোডের পুলিশের জনসংযোগ শাখা থেকে তাঁর ছবিসহ তথ্য পাঠিয়ে খিলগাঁও থানার ওসি এবং পুলিশের জনসংযোগ শাখার একজন কর্মকর্তা ফোন করে সাংবাদিকদের অনুরোধ করেছিলেন, যাতে ভালো করে ছাপা হয়। অবশ্য পরের দিন দেশের সব দৈনিকের প্রথম পাতায় ছবিসহ নাসিমাকে গ্রেপ্তারের খবর ফলাও করে ছাপা হয়। তাতে বলা হয়, তিনি একজন ভয়ংকর আসামি। আমার মনে আছে, জনকণ্ঠে প্রথম পাতার ডান দিকে শেষ কলামে নাসিমার ছবিসমেত খবর ছাপা হয়েছিল।
স্বাভাবিকভাবেই পরের দিন খিলগাঁও থানায় গেলাম নাসিমার ফলোআপ করতে। নাসিমাকে নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকার কভারেজে ওসি অনেক খুশি। কিছুক্ষণ পরপর তাঁর ফোন আসছে। এর মধ্যে একটি ফোনালাপ আমার কানে এল। মনে হলো, নাসিমাকে নিয়ে খবর দেওয়ার ব্যাপারে কেউ তাঁকে সাবধান করে দিচ্ছেন। অনেকক্ষণ বসে আছি, ওসি এটা-সেটা খাওয়াচ্ছেন কিন্তু কোনো তথ্য দিচ্ছেন না। নাসিমার বাড়ির নম্বর চাইতেই তাঁর মুখ কালো হয়ে গেল। একটু আমতা-আমতা করলেন, দেব-দিচ্ছি করে আর দিলেন না। আমার মনে হলো, এ ঘটনার মধ্যে অন্য কিছু আছে। ডিউটি অফিসারের কাছে গিয়ে জানতে পারলাম, নাসিমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়নি, তাঁকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। খটকা আরও বেড়ে গেল।
পরিচিত ডিউটি অফিসারের কাছ থেকে নাসিমার বাসার নম্বর নিয়ে গেলাম রামপুরায় নাসিমার বাসায়। কিন্তু সেখানে কেউ নেই। বাসায় তালা ঝুলছে। নাসিমা গ্রেপ্তারের পর বাড়ির সবাই ভয়ে অন্যত্র চলে গেছে। এক প্রতিবেশী বললেন, মেয়েটাকে ফাঁসানো হয়েছে। কিন্তু কী নিয়ে ফাঁসানো হয়েছে, তা তিনি জানেন না। রিমান্ড শেষ হওয়ার পর নাসিমাকে পাঠানো হলো কারাগারে। এবার মনে হলো, উপায় হলেও হতে পারে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কর্মকর্তাকে অনুরোধ করলাম নাসিমার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। তিনি ব্যবস্থা করে দিলেন। জেলারের অফিস রুমের ঢোকার মুখে বন্দীদের সাক্ষাতের একটি স্থানে নাসিমাকে আনা হলো। প্রথমে অচেনা লোক দেখে তিনি একটু ঘাবড়ে গেলেন। পরে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। পকেটে মিনি টেপরেকর্ডার। নাসিমা যা বলছেন, সব রেকর্ড হচ্ছে।
ঢাকার মেয়ে নাসিমা এসএসসি পাস করার পর একটি চাকরি নিয়ে কুয়েতে চলে যান। সেখানে দিনকাল ভালোই চলছিল। এর মধ্যে ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট কুয়েত আক্রমণ করল ইরাক। অবস্থা বুঝে তিনি দেশে চলে এলেন। নিজের জমানো টাকা দিয়ে উত্তরায় ২১ শতক জমি কিনলেন। ইচ্ছে ছিল, বিয়ে করে সুখে সংসার করার। ইত্তেফাক পত্রিকার ‘পাত্র চাই’ কলামে বিজ্ঞাপন দিলেন। এগিয়ে আসেন জাকির হোসেন নামের এক প্রকৌশলী। পরে দুজনে সম্মত হয়ে বিয়ে করে রামপুরায় থাকতে শুরু করেন।
ধীরে ধীরে কুয়েতের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেল। কোম্পানি থেকে ডাক এল ফিরে যাওয়ার জন্য। জাকির তখন তাঁকে প্রস্তাব দিলেন উত্তরার সেই ২১ শতক জমিটি তাঁকে লিখে দিতে হবে। তিনি গ্রামে গিয়ে ব্যবসা করবেন। নাসিমা কিছুতেই রাজি না। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হলো। নাসিমা একাই কুয়েত চলে গেলেন। কয়েক মাস পরে কুয়েতে বসে পেলেন ডিভোর্সের চিঠি। সেই চিঠি হাতে পেয়ে মন খারাপ করে আবার দেশে ফিরে এলেন। জাকিরের কাছে কারণ জানতে চাইলেন। জাকির সব ভুলে গিয়ে আবার তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলেন, করলেনও। কিন্তু মনে মনে জাকির জমি দখলের ফন্দি আঁটলেন।
নাসিমার উত্তরার জমির সীমানা নিয়ে এক প্রতিবেশীর সঙ্গে বিরোধ ছিল। জাকির তাঁর সঙ্গে হাত মেলালেন। সেই জমির মালিকের এক বন্ধু ছিলেন একটি বাহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা। তাঁর সাহায্য নিয়েই নাসিমাকে রাষ্ট্রদ্রোহী সাজিয়ে গ্রেপ্তার করালেন। নাসিমা আমাকে বললেন, পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করার পর একদিন রাতে চোখ বেঁধে একটি স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখেন সেই কর্মকর্তা বসে আছেন। ওই কর্মকর্তা তাঁকে হুমকি দিয়ে বলেন, জমিটা ছেড়ে না দিলে জানটা আর থাকবে না। নাসিমা বললেন, কষ্টের টাকায় কেনা একখণ্ড জমি সুখের বদলে তাঁর জীবনের কাল হয়ে গেল। সাক্ষাৎকার নিয়ে বের হয়ে এলাম। পরের দিন সেই খবর ছাপা হলো।
এরপর হইচই পড়ে গেল। বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নজর এড়াল না। তিনি পুলিশকে সব খতিয়ে দেখতে বললেন। খিলগাঁওয়ের ওসিকে সরিয়ে দেওয়া হলো। নাসিমার স্বামী প্রকৌশলী জাকির অবস্থা বেগতিক দেখে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে নিজের দোষ এড়ানোর চেষ্টা করলেন। তিনি বললেন, নাসিমার সঙ্গে বড় বড় সন্ত্রাসীর জানাশোনা আছে। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা যেসব প্রশ্ন করলেন, তার কোনোটারই সদুত্তর তিনি দিতে পারলেন না।
অবশেষে ১৯৯৯ সালের ৩ মে নাসিমা জামিনে মুক্ত হলেন। আদালত থেকে বারবার পুলিশের কাছে রাষ্ট্রদ্রোহের তথ্যপ্রমাণ চাওয়া হলো। কিন্তু পুলিশ এসব দিতে ব্যর্থ হলো। শেষ পর্যন্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেলেন নাসিমা। নাসিমা মুক্তি পাওয়ার পর প্রায় সব কাগজেই তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হলো। কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থাও তাঁকে সহায়তা দিতে এগিয়ে এল। অনেক কাজের ভিড়ে নাসিমাকে ভুলে গেলাম।
কয়েক বছর পর কী একটা কাজে বিমানবন্দরে গেছি। দেখি বিদেশগামী যাত্রীদের লাইনে নাসিমা দাঁড়িয়ে, বোর্ডিং কার্ড নিচ্ছেন। আমাকে দেখে চিনতে পেরে এগিয়ে এলেন। বললেন, নিজের জীবনটুকু ছাড়া আর সবই হারিয়েছেন। জমি-বাড়ি কিছুই নেই তাঁর, আছে শুধু জীবনটা। এটা আর হারাতে চান না, তাই বিদেশ চলে যাচ্ছেন। এটুকু বলতেই চোখ ছলছল করে উঠল নাসিমার, বাঁ হাতে চোখ-মুখ মুছে ইমিগ্রেশনের দিকে এগোলেন। আমিও আর কিছুই বলতে পারলাম না, শুধু তাঁর পথের দিকে চেয়ে রইলাম।
আরও পড়ুন:
চাঁদপুর-মুন্সিগঞ্জ নৌ সীমানার মোহনপুর এলাকায় মেঘনা নদীতে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে দুই জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরও একজন। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মুন্সিগঞ্জ ও চাঁদপুর মতলব উত্তর মোহনপুরের চড় আব্দুল্লাহপুর নাছিরার চরে নদীতে এ ঘটনা ঘটে।
১ দিন আগেরাজধানীর মোহাম্মদপুরে আবারও অস্ত্রের মুখে একটি পরিবারকে জিম্মি করে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আজ বৃহস্পতিবার ভোররাতে মোহাম্মদপুরের বছিলাসংলগ্ন লাউতলা এলাকার ৮ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তত্ত্বাবধায়ক নাসিমা বেগম মোহাম্মদপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।
২৮ নভেম্বর ২০২৪রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
০৮ নভেম্বর ২০২৪পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
০৭ নভেম্বর ২০২৪