কামরুল হাসান
‘বিচারের বাণী কাঁদে’, শুনতে একটু ক্লিশে লাগে না? এই সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হতেই পারে, এভাবে বলা কিছুটা গতানুগতিক। তবু এই শিরোনামে আমার একটি সিরিজ রিপোর্ট পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। সেই প্রতিবেদনগুলোতে উঠে এসেছিল বিচারবঞ্চিত মানুষের হাহাকার।
তার আগে একটু বলি, যেকোনো প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে আমি সব সময় সেই ঘটনাকে নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। এটা অনেকটা দুটি বিদ্যুৎ সুপরিবাহী তার যতটা নিরাপদ দূরত্বে থাকে, ততটুকু। এতে সুবিধা আছে, ঘটনার সঙ্গে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে যে তা-ই হবে, তেমন কোনো কথা নেই। অনেক ঘটনা টেনে নিয়ে যেতে হয় অনেক দূর অবধি। আজ সে রকম একটা ঘটনা বলি।
২০০৫ সালের ২৪ জুন, শুক্রবার। সকালের দিকে তেমন কোনো কাজ ছিল না। বিকেলে একটু দেরি করে অফিসে যাওয়ার ইচ্ছে। কিন্তু জুমার নামাজ শেষ হতে না হতেই একের পর এক ফোন। শুনলাম, ঢাকা মহানগর যুবদল দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক ছগির আহমেদ ছগির (৪২) খুন হয়েছেন। কিসের আরাম-বিরাম! বাইক নিয়ে দিলাম ছুট।
ঢাকা জজকোর্টের উল্টো দিকের গলি ধরে কয়েক পা গেলেই রঘুনাথ দাস লেনের সোনা মিয়া আল ফালাহ জামে মসজিদ। সেই মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে এসেছিলেন সে সময়ের নামকরা সন্ত্রাসী ও যুবদল নেতা ছগির। মসজিদের অদূরে নাসির উদ্দিন সরকার লেনের গলির ভেতরে তাঁর পাঁচতলা বাড়ি। এদিন তাঁর মায়ের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। নামাজ পড়ে খাবার বিতরণের কথা বলে তিনি মসজিদে আসেন। সঙ্গে শিশুসন্তান তৌসিফ এবং তারই সমবয়সী গৃহকর্মী জালাল।
জালাল আমাকে বলেছিল, মসজিদ থেকে বের হয়ে ছগিরের ছেলে তৌসিফ ও সে একসঙ্গে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। তৌসিফ ছিল তার পেছনে। রায়সাহেব বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গলিতে তিন যুবক দাঁড়িয়ে। ছগিরকে দেখেই তারা এগিয়ে আসে। এরপর কোনো কথা না বলে সোজা গুলি করে। গুলির শব্দে দুজনেই দেখতে পায়, ছগির রাস্তায় পড়ে যাচ্ছেন। তারা দৌড়ে গিয়ে বাসায় খবর দেয়। ছুটে আসেন ছগিরের স্ত্রী নাসিমা আক্তার রুবী। এ ঘটনার পর সেখানে অনেক মানুষ জড়ো হয়। তারা সন্ত্রাসীদের পালাতে দেখে ধাওয়া করে। সে সময় টহল পুলিশের হাবিলদার রফিক একজনকে জাপটে ধরেন। ছেলেটার নাম শাওন। পরে সে র্যাবের হাতে প্রাণ হারায়। তখন শোনা যায়, এই শাওন বিএনপির তৎকালীন এমপি প্রয়াত নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টুর ছোট ভাই মনিরের ঘনিষ্ঠ। শাওনের মৃত্যু নিয়েও নানা আলোচনা হয়।
দুপুরের পর ছগিরের লাশ নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। সেখানে গিয়ে দেখি, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী আমানুল্লাহ আমান, গণপূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাস, সংসদ সদস্য মোসাদ্দেক আলী ফালু, সংসদ সদস্য নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টুসহ শত শত নেতা-কর্মী জড়ো হয়েছেন।
অপরাধ রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির বায়োগ্রাফিটা সব সময় খুব জরুরি। এতে পাঠক সেই ব্যক্তি সম্পর্কে একটি ধারণা করতে পারেন। খোঁজ করতে গিয়ে দেখি, ছগিরের পিতার নাম হাজি আফতাব উদ্দিন। তাঁরা সূত্রাপুরের নাসির উদ্দিন সরদার লেনের স্থায়ী বাসিন্দা। চার ভাই, এক বোনের মধ্যে ছগির দ্বিতীয়। তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল। ১০ বছর আগে তিনি বিয়ে করেন নাসিমা আক্তারকে। ছগিরের দুই সন্তান—তৌসিফ ও রামিশা। এদের একজনের বয়স পাঁচ বছর, আরেকজনের তিন।
ছগির নিহত হন বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে। সে সময় জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদলের কমিটি এবং একটি ভবন দখল নিয়ে বিরোধ চলছিল। ছগিরের মত উপেক্ষা করে কমিটি করা হয়। এ নিয়ে সেদিন সকালে তিনি ঢাকার মেয়রের সঙ্গে বৈঠকও করেন। সেই বৈঠক শেষ করে বাসায় ফিরে আসার পর খুন হন ছগির। ছগিরের বিরুদ্ধে সে সময় সার্জেন্ট ফরহাদ হত্যাসহ ১২টি মামলা চলছিল। পুরান ঢাকায় ছগিরের পরিচিতি ছিল ত্রাস হিসেবে।
২৫ জুন বেলা ১১টার দিকে ছগিরের লাশ নেওয়া হয় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সেখানে তাঁর কফিন দলীয় পতাকা দিয়ে মোড়ানো হয়। এ সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ বিএনপির প্রায় সব মন্ত্রী ও দলের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ছগিরের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
ছগিরের মতো সন্ত্রাসীর মরদেহে প্রধানমন্ত্রীর ফুল দেওয়া দেখে জনকণ্ঠে প্রকাশিত আমার সেই ‘বিচারের বাণী কাঁদে’ সিরিজের কথা মনে পড়ে যায়। সেই সিরিজের ১৯৯৯ সালের ৩১ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ছিল সার্জেন্ট ফরহাদ হত্যা নিয়ে। ফরহাদ খুনের মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ছগির আহমেদ। ফরহাদ ছিলেন কোতোয়ালি থানার এসআই। তখন জগন্নাথ কলেজ ছাত্রদলে ছগির ও কাজলের দুটি গ্রুপ ছিল, যাদের মধ্যে প্রায়ই গোলাগুলি হতো। কাজলের বাসা ছিল কলেজের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার তীরে, আর ছগিরের বাসা আদালত ভবনের কাছে। ১৯৯৪ সালের ১৫ মার্চের সকালে দুই পক্ষের গোলাগুলির সময় সেখানে পুলিশ নিয়ে যান এসআই ফরহাদ। তিনি ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করেন ছগির।
এ ঘটনা নিয়ে কোতোয়ালির ওসি মুজিবুল হক ছগির, কাজলসহ ৩০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। তাঁদের মধ্যে ছগির ও কাজল ভারতে পালিয়ে যান। কিছুদিন পর ফিরে এসে জামিন নেন। জামিন পেয়ে আবার বিদেশে পালিয়ে যান কাজল। সেই থেকে তিনি বিদেশেই আছেন। ছগির মূল দলে মিশে রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেন। অবশ্য বিএনপি ক্ষমতায় থাকতেই ডিবির এসি আখতারুজ্জামান রুনু এ মামলার অভিযোগপত্র দেন। যথারীতি জজ আদালতে মামলা শুরু হয়। মামলার ৩০ সাক্ষীর ২১ জনই ছিলেন পুলিশ সদস্য। বাকি ৯ জন জব্দ তালিকার। কিন্তু পুলিশ সদস্যদের কেউই তাঁদের সহকর্মী খুনের বিচারের জন্য আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাননি। সাক্ষ্য না দেওয়ায় অতলে তলিয়ে যায় মামলাটি।
আমার মনে আছে, এই মামলার ফলোআপ করার সময় ফরহাদের স্ত্রী শারমিন আক্তার যোগাযোগ করতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁকে রাজারবাগ স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি দেওয়া হয়েছিল। তিনি রাজারবাগ কোয়ার্টারেই থাকতেন।
ছগির খুনের পরের দিন রাজারবাগ স্কুলে গেলাম শারমিনকে খুঁজতে। শুনি তাঁর চাকরি নেই। তাঁকে কোয়ার্টার থেকেও বের করে দেওয়া হয়। এক সহকর্মী আমাকে শারমিনের বাসার ঠিকানা দিলেন। ২০০৫ সালের ২৭ জুন সকালে গেলাম শারমিনের চামেলীবাগের বাসায়।
ফরহাদ যেদিন খুন হন, পরের দিন তাঁর ছোট ছেলে সিয়ামের জন্ম হয়েছিল। আমি যখন তাদের বাসায় গেলাম, তখন সিয়াম মতিঝিল আইডিয়ালে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। শারমিনের বড় ছেলে সানি পড়ত ঢাকা সিটি কলেজে। শারমিন বললেন, ‘ফরহাদ মারা যাওয়ার চার বছর পর নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি বিয়ে করি। বিয়ে করার অপরাধে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মতিউর রহমান আমাকে চাকরিচ্যুত করেন। চাকরির অব্যাহতিপত্রে লেখেন, দ্বিতীয় বিয়ে করার অভিযোগে চাকরিচ্যুত করা হলো। চাকরির সঙ্গে বাসাও ছাড়তে হলো। এমনকি পুলিশ কল্যাণ তহবিলের টাকাও বন্ধ হয়ে গেল।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ছগিরের মরদেহে প্রধানমন্ত্রীর ফুল দেওয়ার দৃশ্য সেদিন বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হয়েছিল। শারমিনের পরিবারের সবাই তা দেখেছেন। বললেন, টিভির খবরে ছগিরের মরদেহে প্রধানমন্ত্রীর ফুল দেওয়ার দৃশ্য দেখেছে সানি। এরপর সারা দিন কারও সঙ্গে কথা বলেনি, কিছু মুখেও দেয়নি। বাবার খুনিকে সরকারের বড় বড় নেতার সম্মান দেখানোর দৃশ্য কোনো সন্তান কি মেনে নিতে পারে ভাই? যে সন্ত্রাসী আমার জীবন তছনছ করেছে, দুই সন্তানসহ আমাকে পথে বসিয়েছে, সে কী করে এত মর্যাদা পায়! তার জন্য দেশের মন্ত্রীদের এত মায়া কেন?’
সানি এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল। হঠাৎ বলে উঠল, সন্ত্রাসীর হাতে বাবার মৃত্যুর কথা শুনে আমার মা খুব কেঁদেছিলেন, কাল আবার কাঁদলেন তাঁর স্বামীর খুনির মরদেহে প্রধানমন্ত্রীর ফুল দেওয়ার দৃশ্য দেখে। শুধু মা নন, আমরাও কেঁদেছি। ছেলের কথা শুনে আমি শারমিনের দিকে তাকাই, তিনিও কাঁদছেন। মায়ের কান্না দেখে পাশে থাকা ছোট ছেলেটাও কেঁদে ওঠে।
এ মুহূর্তে শারমিন যেন আমার স্বজন হয়ে যান। মা আর সন্তানদের ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি, আমারও গলা ধরে আসে। কিছুই বলতে পারি না। যে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রের কর্তাদের, তা আমার মতো নিতান্ত ছাপোষা সংবাদকর্মী দেবে কীভাবে?
আরও পড়ুন:
‘বিচারের বাণী কাঁদে’, শুনতে একটু ক্লিশে লাগে না? এই সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হতেই পারে, এভাবে বলা কিছুটা গতানুগতিক। তবু এই শিরোনামে আমার একটি সিরিজ রিপোর্ট পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। সেই প্রতিবেদনগুলোতে উঠে এসেছিল বিচারবঞ্চিত মানুষের হাহাকার।
তার আগে একটু বলি, যেকোনো প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে আমি সব সময় সেই ঘটনাকে নিরাপদ দূরত্ব থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। এটা অনেকটা দুটি বিদ্যুৎ সুপরিবাহী তার যতটা নিরাপদ দূরত্বে থাকে, ততটুকু। এতে সুবিধা আছে, ঘটনার সঙ্গে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে যে তা-ই হবে, তেমন কোনো কথা নেই। অনেক ঘটনা টেনে নিয়ে যেতে হয় অনেক দূর অবধি। আজ সে রকম একটা ঘটনা বলি।
২০০৫ সালের ২৪ জুন, শুক্রবার। সকালের দিকে তেমন কোনো কাজ ছিল না। বিকেলে একটু দেরি করে অফিসে যাওয়ার ইচ্ছে। কিন্তু জুমার নামাজ শেষ হতে না হতেই একের পর এক ফোন। শুনলাম, ঢাকা মহানগর যুবদল দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক ছগির আহমেদ ছগির (৪২) খুন হয়েছেন। কিসের আরাম-বিরাম! বাইক নিয়ে দিলাম ছুট।
ঢাকা জজকোর্টের উল্টো দিকের গলি ধরে কয়েক পা গেলেই রঘুনাথ দাস লেনের সোনা মিয়া আল ফালাহ জামে মসজিদ। সেই মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে এসেছিলেন সে সময়ের নামকরা সন্ত্রাসী ও যুবদল নেতা ছগির। মসজিদের অদূরে নাসির উদ্দিন সরকার লেনের গলির ভেতরে তাঁর পাঁচতলা বাড়ি। এদিন তাঁর মায়ের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। নামাজ পড়ে খাবার বিতরণের কথা বলে তিনি মসজিদে আসেন। সঙ্গে শিশুসন্তান তৌসিফ এবং তারই সমবয়সী গৃহকর্মী জালাল।
জালাল আমাকে বলেছিল, মসজিদ থেকে বের হয়ে ছগিরের ছেলে তৌসিফ ও সে একসঙ্গে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। তৌসিফ ছিল তার পেছনে। রায়সাহেব বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গলিতে তিন যুবক দাঁড়িয়ে। ছগিরকে দেখেই তারা এগিয়ে আসে। এরপর কোনো কথা না বলে সোজা গুলি করে। গুলির শব্দে দুজনেই দেখতে পায়, ছগির রাস্তায় পড়ে যাচ্ছেন। তারা দৌড়ে গিয়ে বাসায় খবর দেয়। ছুটে আসেন ছগিরের স্ত্রী নাসিমা আক্তার রুবী। এ ঘটনার পর সেখানে অনেক মানুষ জড়ো হয়। তারা সন্ত্রাসীদের পালাতে দেখে ধাওয়া করে। সে সময় টহল পুলিশের হাবিলদার রফিক একজনকে জাপটে ধরেন। ছেলেটার নাম শাওন। পরে সে র্যাবের হাতে প্রাণ হারায়। তখন শোনা যায়, এই শাওন বিএনপির তৎকালীন এমপি প্রয়াত নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টুর ছোট ভাই মনিরের ঘনিষ্ঠ। শাওনের মৃত্যু নিয়েও নানা আলোচনা হয়।
দুপুরের পর ছগিরের লাশ নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। সেখানে গিয়ে দেখি, ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, শ্রম ও জনশক্তি প্রতিমন্ত্রী আমানুল্লাহ আমান, গণপূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাস, সংসদ সদস্য মোসাদ্দেক আলী ফালু, সংসদ সদস্য নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টুসহ শত শত নেতা-কর্মী জড়ো হয়েছেন।
অপরাধ রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তির বায়োগ্রাফিটা সব সময় খুব জরুরি। এতে পাঠক সেই ব্যক্তি সম্পর্কে একটি ধারণা করতে পারেন। খোঁজ করতে গিয়ে দেখি, ছগিরের পিতার নাম হাজি আফতাব উদ্দিন। তাঁরা সূত্রাপুরের নাসির উদ্দিন সরদার লেনের স্থায়ী বাসিন্দা। চার ভাই, এক বোনের মধ্যে ছগির দ্বিতীয়। তাঁদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল। ১০ বছর আগে তিনি বিয়ে করেন নাসিমা আক্তারকে। ছগিরের দুই সন্তান—তৌসিফ ও রামিশা। এদের একজনের বয়স পাঁচ বছর, আরেকজনের তিন।
ছগির নিহত হন বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে। সে সময় জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদলের কমিটি এবং একটি ভবন দখল নিয়ে বিরোধ চলছিল। ছগিরের মত উপেক্ষা করে কমিটি করা হয়। এ নিয়ে সেদিন সকালে তিনি ঢাকার মেয়রের সঙ্গে বৈঠকও করেন। সেই বৈঠক শেষ করে বাসায় ফিরে আসার পর খুন হন ছগির। ছগিরের বিরুদ্ধে সে সময় সার্জেন্ট ফরহাদ হত্যাসহ ১২টি মামলা চলছিল। পুরান ঢাকায় ছগিরের পরিচিতি ছিল ত্রাস হিসেবে।
২৫ জুন বেলা ১১টার দিকে ছগিরের লাশ নেওয়া হয় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সেখানে তাঁর কফিন দলীয় পতাকা দিয়ে মোড়ানো হয়। এ সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ বিএনপির প্রায় সব মন্ত্রী ও দলের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ছগিরের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
ছগিরের মতো সন্ত্রাসীর মরদেহে প্রধানমন্ত্রীর ফুল দেওয়া দেখে জনকণ্ঠে প্রকাশিত আমার সেই ‘বিচারের বাণী কাঁদে’ সিরিজের কথা মনে পড়ে যায়। সেই সিরিজের ১৯৯৯ সালের ৩১ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ছিল সার্জেন্ট ফরহাদ হত্যা নিয়ে। ফরহাদ খুনের মামলার প্রধান আসামি ছিলেন ছগির আহমেদ। ফরহাদ ছিলেন কোতোয়ালি থানার এসআই। তখন জগন্নাথ কলেজ ছাত্রদলে ছগির ও কাজলের দুটি গ্রুপ ছিল, যাদের মধ্যে প্রায়ই গোলাগুলি হতো। কাজলের বাসা ছিল কলেজের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার তীরে, আর ছগিরের বাসা আদালত ভবনের কাছে। ১৯৯৪ সালের ১৫ মার্চের সকালে দুই পক্ষের গোলাগুলির সময় সেখানে পুলিশ নিয়ে যান এসআই ফরহাদ। তিনি ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাঁকে খুব কাছ থেকে গুলি করেন ছগির।
এ ঘটনা নিয়ে কোতোয়ালির ওসি মুজিবুল হক ছগির, কাজলসহ ৩০ জনকে আসামি করে মামলা করেন। তাঁদের মধ্যে ছগির ও কাজল ভারতে পালিয়ে যান। কিছুদিন পর ফিরে এসে জামিন নেন। জামিন পেয়ে আবার বিদেশে পালিয়ে যান কাজল। সেই থেকে তিনি বিদেশেই আছেন। ছগির মূল দলে মিশে রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করেন। অবশ্য বিএনপি ক্ষমতায় থাকতেই ডিবির এসি আখতারুজ্জামান রুনু এ মামলার অভিযোগপত্র দেন। যথারীতি জজ আদালতে মামলা শুরু হয়। মামলার ৩০ সাক্ষীর ২১ জনই ছিলেন পুলিশ সদস্য। বাকি ৯ জন জব্দ তালিকার। কিন্তু পুলিশ সদস্যদের কেউই তাঁদের সহকর্মী খুনের বিচারের জন্য আদালতে সাক্ষ্য দিতে যাননি। সাক্ষ্য না দেওয়ায় অতলে তলিয়ে যায় মামলাটি।
আমার মনে আছে, এই মামলার ফলোআপ করার সময় ফরহাদের স্ত্রী শারমিন আক্তার যোগাযোগ করতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁকে রাজারবাগ স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি দেওয়া হয়েছিল। তিনি রাজারবাগ কোয়ার্টারেই থাকতেন।
ছগির খুনের পরের দিন রাজারবাগ স্কুলে গেলাম শারমিনকে খুঁজতে। শুনি তাঁর চাকরি নেই। তাঁকে কোয়ার্টার থেকেও বের করে দেওয়া হয়। এক সহকর্মী আমাকে শারমিনের বাসার ঠিকানা দিলেন। ২০০৫ সালের ২৭ জুন সকালে গেলাম শারমিনের চামেলীবাগের বাসায়।
ফরহাদ যেদিন খুন হন, পরের দিন তাঁর ছোট ছেলে সিয়ামের জন্ম হয়েছিল। আমি যখন তাদের বাসায় গেলাম, তখন সিয়াম মতিঝিল আইডিয়ালে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। শারমিনের বড় ছেলে সানি পড়ত ঢাকা সিটি কলেজে। শারমিন বললেন, ‘ফরহাদ মারা যাওয়ার চার বছর পর নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি বিয়ে করি। বিয়ে করার অপরাধে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মতিউর রহমান আমাকে চাকরিচ্যুত করেন। চাকরির অব্যাহতিপত্রে লেখেন, দ্বিতীয় বিয়ে করার অভিযোগে চাকরিচ্যুত করা হলো। চাকরির সঙ্গে বাসাও ছাড়তে হলো। এমনকি পুলিশ কল্যাণ তহবিলের টাকাও বন্ধ হয়ে গেল।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ছগিরের মরদেহে প্রধানমন্ত্রীর ফুল দেওয়ার দৃশ্য সেদিন বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হয়েছিল। শারমিনের পরিবারের সবাই তা দেখেছেন। বললেন, টিভির খবরে ছগিরের মরদেহে প্রধানমন্ত্রীর ফুল দেওয়ার দৃশ্য দেখেছে সানি। এরপর সারা দিন কারও সঙ্গে কথা বলেনি, কিছু মুখেও দেয়নি। বাবার খুনিকে সরকারের বড় বড় নেতার সম্মান দেখানোর দৃশ্য কোনো সন্তান কি মেনে নিতে পারে ভাই? যে সন্ত্রাসী আমার জীবন তছনছ করেছে, দুই সন্তানসহ আমাকে পথে বসিয়েছে, সে কী করে এত মর্যাদা পায়! তার জন্য দেশের মন্ত্রীদের এত মায়া কেন?’
সানি এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল। হঠাৎ বলে উঠল, সন্ত্রাসীর হাতে বাবার মৃত্যুর কথা শুনে আমার মা খুব কেঁদেছিলেন, কাল আবার কাঁদলেন তাঁর স্বামীর খুনির মরদেহে প্রধানমন্ত্রীর ফুল দেওয়ার দৃশ্য দেখে। শুধু মা নন, আমরাও কেঁদেছি। ছেলের কথা শুনে আমি শারমিনের দিকে তাকাই, তিনিও কাঁদছেন। মায়ের কান্না দেখে পাশে থাকা ছোট ছেলেটাও কেঁদে ওঠে।
এ মুহূর্তে শারমিন যেন আমার স্বজন হয়ে যান। মা আর সন্তানদের ভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি, আমারও গলা ধরে আসে। কিছুই বলতে পারি না। যে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রের কর্তাদের, তা আমার মতো নিতান্ত ছাপোষা সংবাদকর্মী দেবে কীভাবে?
আরও পড়ুন:
চাঁদপুর-মুন্সিগঞ্জ নৌ সীমানার মোহনপুর এলাকায় মেঘনা নদীতে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে দুই জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরও একজন। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মুন্সিগঞ্জ ও চাঁদপুর মতলব উত্তর মোহনপুরের চড় আব্দুল্লাহপুর নাছিরার চরে নদীতে এ ঘটনা ঘটে।
১ দিন আগেরাজধানীর মোহাম্মদপুরে আবারও অস্ত্রের মুখে একটি পরিবারকে জিম্মি করে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। আজ বৃহস্পতিবার ভোররাতে মোহাম্মদপুরের বছিলাসংলগ্ন লাউতলা এলাকার ৮ নম্বর সড়কের ১০ নম্বর বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তত্ত্বাবধায়ক নাসিমা বেগম মোহাম্মদপুর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন।
২৮ নভেম্বর ২০২৪রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
০৮ নভেম্বর ২০২৪পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
০৭ নভেম্বর ২০২৪