Ajker Patrika

রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে কিছু বিভ্রান্তি

জাহীদ রেজা নূর
রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে কিছু বিভ্রান্তি

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশ কিছু ভুল ধারণা পুষে রাখে মানুষ। কেউ কেউ সেই ভুল ধারণাগুলো অন্যের মনে পোক্ত করার জন্য ইন্ধন জোগায়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একদিকে হয় ব্যক্তিপূজা, অন্যদিকে তাঁকে নিয়ে চলতে থাকে বিষোদ্‌গার। তাতে সত্যিকার রক্ত-মাংসের মানুষ রবীন্দ্রনাথের জায়গায় কোথাও ঈশ্বরের খোঁজ করা হয়, কোথাও খোঁজ করা হয় খলনায়কের। রবীন্দ্রনাথ যেন ঈশ্বর অথবা সিনেমার ভিলেন! ডান-বাম-মধ্য—কোন দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ধাক্কা খাননি?

সে রকম দুটি কাহিনি বলব আজ। প্রচলিত কাহিনিগুলোর দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে, রবীন্দ্রনাথকে খাটো করার জন্যই এগুলো তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিকার তথ্য-উপাত্তের খোঁজ না পেলে মনে হতেই পারে, আরে! এই তাহলে রবীন্দ্রনাথ! এবং তখন রবীন্দ্রনাথের পিণ্ডি চটকানো যায় আরামসে!

মুক্তক ছন্দ
যাঁরা কবিতা ভালোবাসেন, তাঁরা কবিতায় ব্যবহৃত ছন্দগুলো কেমন, তা জানেন। যে পঙ্‌ক্তিগুলো অসম, কিন্তু যাতে ছন্দ স্রোত বয়, তাকে মুক্তক ছন্দ বলে। আলোচনার খাতিরে সে রকম দুটো কবিতার কয়েকটি পঙ্‌ক্তি আনছি উদাহরণ হিসেবে। যে আলোচনা হবে সামনে, সে কথা মনে রেখেই পঙ্‌ক্তিগুলো বাছা হয়েছে। প্রথমে নজরুলের একটা কবিতাংশ:
বল বীর—
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
 
এবার রবীন্দ্রনাথের:
কে তোমারে দিল প্রাণ
                      রে পাষাণ।
কে তোমারে জোগাইছে এ অমৃতরস
                      বরষ বরষ।
আশা করি বোঝা গেছে মুক্তক ছন্দের বিষয়টি।

একবার শঙ্খ ঘোষের কাছে এসেছিলেন দুজন লেখক। ধর্মপরিচয়ে তাঁরা মুসলিম। সাহিত্যচর্চা করেন। আলোচনা নানা দিকে গড়াল। এক সময় চমক লাগানো একটা কথা বলে ফেলেন লেখকদের একজন। ‘মুক্তক ছন্দের প্রবর্তক নজরুল, রবীন্দ্রনাথ নন, এ কথা গোপন করা হচ্ছে বহুদিন ধরে।’

শঙ্খ ঘোষ অবাক হলেন। কেন তা গোপন করতে হবে? ছন্দের এই মুক্তি এনেছেন নজরুল অথচ হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা তা স্বীকার করেন না—এটাই লেখকের কথা। শঙ্খ ঘোষ বুঝতে পারেন না, কী নিয়ে কথা হচ্ছে। জানতে চান, ‘নজরুল কোথায় এনেছিলেন মুক্তি?’
‘কেন, “বিদ্রোহী” কবিতায়।’

এই কথা নাকি অনেক আগেই বাংলাদেশে কেউ একজন প্রমাণ করে দিয়েছে। বেশ জোর দিয়েই বললেন লেখকদের একজন।
শঙ্খ ঘোষ বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তো বলাকার কবিতাগুলো লিখেছিলেন “বিদ্রোহী” কবিতার অনেক আগে।’
‘কী বলেন! বিদ্রোহী কি তার আগে লেখা নয়?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন একজন লেখক।
শঙ্খ ঘোষ বললেন, ‘সাল-তারিখের দিকে লক্ষ্য করলেই তো বুঝতে পারবেন। বলাকা বেরিয়ে গেছে ১৯১৬ সালে। বিদ্রোহী প্রথম ছাপা হয়েছে ১৯২২ সালে।’

বেচারা নজরুল জানলেনও না, তাঁকে আর রবীন্দ্রনাথকে শত্রু বানিয়ে কেউ কেউ ফায়দা লুটছে। এ কথাও তো অনেকে বলে, নজরুল নোবেল পুরস্কার পেয়ে যাবেন বুঝতে পেরে রবীন্দ্রনাথই তাঁকে বিষ খাইয়ে পাগল বানিয়েছেন!
 
পঞ্চম জর্জ ও ভারতের জাতীয় সংগীত
রবীন্দ্রনাথ কি ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ গানটি সম্রাট পঞ্চম জর্জের বন্দনাসংগীত হিসেবে লিখেছিলেন? এই আলোচনায় জগৎ মেতেছিল একসময়। এখনো কেউ কেউ সুযোগ পেলে বলে থাকেন, রবীন্দ্রনাথ তো সম্রাটের জন্যই লিখেছিলেন গানটি। এটা আবার কী করে ভারতের জাতীয় সংগীত হয়?

কথাগুলো কিন্তু আমজনতা বলে না। এমনকি ভারতের লোকসভায়ও এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছে। পঞ্চম জর্জের বন্দনাসংগীতটি কী করে ভারতের জাতীয় সংগীত হয়, তা নিয়েই লোকসভার বিতর্কটা জমে উঠেছিল। এ তো জাতির জন্য লজ্জার ব্যাপার। যে ইংরেজকে আমরা তাড়াতে চাইলাম, তারই মাথাকে তুষ্ট করেছেন রবীন্দ্রনাথ!

এবার ঘটনাটার দিকে তাকানো যাক। 

১৯১০ সালের ৬ মে সপ্তম এডওয়ার্ড মারা গেলে জর্জ রাজা হন। তিনি হন পঞ্চম জর্জ। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি ভারতবর্ষে আসেন, দিল্লিতে মুকুট পরিধান করেন এবং রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরের ঘোষণা দেন।

১৯১১ সালের ২৬ থেকে ২৮ ডিসেম্বর কলকাতায় বসেছিল কংগ্রেসের ২৬তম অধিবেশন। সে অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে সরলা দেবী চৌধুরী, অমলা দাশ, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমল হোমেরা সমবেত কণ্ঠে গেয়েছিলেন ‘জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে’ গানটি। সে সময় ইংল্যান্ডের সম্রাট পঞ্চম জর্জ সস্ত্রীক দিল্লি হয়ে কলকাতায় এসেছিলেন। 

কংগ্রেস অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে উদ্বোধনী সংগীতের পর কংগ্রেস নেতারা সৌজন্যবশত সম্রাট ও তাঁর স্ত্রীকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। শহরের নামী দুটি পত্রিকা ‘জনগণমন’ গানের সঙ্গে সম্রাটকে জুড়ে দিয়ে বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট তৈরি করেছিল। তারা লিখেছিল, ‘কয়েকজন বাঙালি ছেলেমেয়ে সমবেত কণ্ঠে হিন্দিতে পঞ্চম জর্জের প্রশস্তিমূলক জয়গান গেয়েছে।’ তাতে মনে হলো, সম্রাট-বন্দনার জন্যই বুঝি রবীন্দ্রনাথ এই গান লিখেছেন।

আসল ঘটনা কী ছিল, সেটা হয়তো আমরা একেবারেই জানতে পারতাম না, যদি এই ঘটনার আড়াই দশক পর অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে পুলিনবিহারী সেন নামে এক যুবক ঘটনাটির সঙ্গে সম্রাট পঞ্চম জর্জের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, সে বিষয়ে জানতে চেয়ে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি না লিখতেন। পুলিনের বয়স তখন ২৯ আর রবীন্দ্রনাথের ৭৬। রবীন্দ্রনাথ পুলিনবিহারীকে চিঠির উত্তরটি লিখেছিলেন ১৯৩৭ সালের ২০ নভেম্বর। সে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘সে বৎসর ভারত সম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনো বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্য আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।…শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল।…আমি জনগণমন-অধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয় ঘোষণা করেছি, পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থায় যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জই কোনোক্রমেই হতে পারেন না সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন। আজ মতভেদবশতঃ আমার প্রতি ক্রুদ্ধ ভাবটা দুশ্চিন্তার লক্ষণ নয়, কিন্তু বুদ্ধিভ্রংশটা দুর্লক্ষণ।’  

এবার আরেকটি ঘটনা বলা যাক, তাতে পঞ্চম জর্জ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনোভাবটি আরও পরিষ্কার হবে। ১৯৩৫ সালে সম্রাট পঞ্চম জর্জের রাজত্বের ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছিল। তা নিয়ে ব্রিটিশ উপনিবেশের সর্বত্রই একটা সাড়া পড়ে গিয়েছিল। সেকালের বিশিষ্ট মানুষদের আগ্রহে সম্রাটকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। সম্পাদনা করেছিলেন কেদারনাথ রায় আর সজনীকান্ত দাস। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৫ সালের জুন মাসে। 

বইয়ের মলাটে ছিল লাল অক্ষরে লেখা ‘রজত-জয়ন্তী’।

যে ২৭ জন লেখকের লেখা ছিল এই সংকলনে, তাঁদের মধ্যে ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, যদুনাথ সরকার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ক্ষিতিমোহন সেন, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দেবপ্রসাদ ঘোষ প্রমুখ। এই দীর্ঘ তালিকায় রবীন্দ্রনাথের নামটি পাওয়া যাচ্ছে না। তার মানে কি, রবীন্দ্রনাথের মতো একজন বিশিষ্ট মানুষকে এখানে লেখার জন্য বলা হয়নি? 

হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সেটা এড়িয়ে গেছেন। সম্পাদকেরা জানাচ্ছেন, ‘…বিশেষ চেষ্টা করিয়াও আমরা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের রচনা এই প্রবন্ধসংগ্রহে দিতে পারিলাম না।…শারীরিক অসুস্থতাবশতঃ তিনি লিখিয়া উঠিতে পারেন নাই।’ 

সম্পাদকেরা তো এই কথা জানালেন। কিন্তু আদৌ রবীন্দ্রনাথ সে সময় ছোটখাটো জ্বরজারির মধ্য দিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু বড় কোনো শারীরিক গোলযোগের মুখে পড়েননি। এবং এ সময় তিনি নিয়মিত লেখালেখিও করে গেছেন। তাহলে কী দাঁড়াল বিষয়টা, তা বিবেচনার ভার থাকল পাঠকের ওপর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিশ্ববাজারে সোনা বিক্রির হিড়িক, ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দরপতন

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বন্ধ করবে: আমীর খসরু

নির্বাচনের আগে প্রশাসনে রদবদল তাঁর তত্ত্বাবধানেই, যোগ্যদেরকে ডিসি নিয়োগ— বিএনপিকে প্রধান উপদেষ্টা

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত আজীবন নিষিদ্ধ

গাজার যুদ্ধবিরতি ভেঙে যেতে পারে—আশঙ্কা ট্রাম্প প্রশাসনের

এলাকার খবর
Loading...