Ajker Patrika

সুবর্ণজয়ন্তীতে বিজয়ভাবনা

আবুল মোমেন
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১২: ৩২
Thumbnail image

এবার বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী। মনে হচ্ছে, গত কয়েক বছরে দেশে এবং পৃথিবীতে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে, সেগুলো বাদ দিয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতা বোঝা যায় না। অমর্ত্য সেন ও কৌশিক বসুর মতো দুজন খ্যাতকীর্তি বাঙালি অর্থনীতিবিদসহ পশ্চিমের অনেক বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকও উন্নয়নের বিচারে বাংলাদেশকে বিস্ময় আখ্যা দিয়েছেন। এ বিস্ময়কর অর্জনগুলো এড়িয়ে সঠিক বাংলাদেশকে কি বোঝা যাবে?

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী যখন হানাদার পাকিস্তানি সেনাদলকে পরাজিত করে দেশ দখলমুক্ত করেছিল, তখন জাতি ঐক্যবদ্ধ, স্বপ্নে ও প্রত্যাশায় চঞ্চল। সেটা ছিল আদর্শবাদী চিন্তা ও মহৎ স্বপ্নের কাল। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শকে মূলনীতি করে সংবিধান রচিত হয়েছিল। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-নির্বিশেষে সব নাগরিকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করে গণতান্ত্রিক ধারায় দেশের অগ্রগতি ছিল লক্ষ্য।

কিন্তু তার জন্য কি নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধাসহ দেশের মানুষ প্রস্তুত ছিলেন না। কেন ছিলেন না, তা বোঝা যাবে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতার আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথের সাবধানবাণী থেকে। তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা অন্তরের সামগ্রী।’ এ কথায় বোঝাতে চেয়েছিলেন, নিজের মধ্যকার পরাধীনতার প্রবণতাগুলো রেখে স্বাধীনতার সুফল মেলে না। নিজে ব্যক্তিগত রিপুর বশীভূত, ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থের দাবির কাছে দুর্বল থাকলে স্বাধীনতা মাত্রা ছাড়িয়ে অর্থহীন হবে। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থকে দেশের ও মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের মাঝে বিলিয়ে দিতে না-পারলে কীভাবে মানুষটা দেশের হয়ে কাজ করবে? দেশবাসী বুঝে না-বুঝে, কিংবা অবস্থার গতিকে, একাত্তরের মুক্তযুদ্ধকালীন নয় মাস এই উচ্চ ভাবাদর্শ পালনের স্বাক্ষর রেখেছিল।

কিন্তু মানুষ তো স্বাভাবিক অবস্থায় সামাজিক জীব, সংসারের দায়কে অগ্রাধিকার দিতেই অভ্যস্ত। ষাটের দশক থেকে দেশের ছাত্র-শ্রমিক এবং সচেতন নাগরিক সমাজ রাজনৈতিক সংগ্রামে প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবেই লিপ্ত ছিলেন। আর তখন বঙ্গবন্ধুর নির্ভরযোগ্য আবার আকর্ষণীয় নেতৃত্ব পেয়ে দেশে এক অসাধারণ গণজাগরণ ঘটেছিল, আর তার ফলে সৃষ্ট হয় অভূতপূর্ব ঐক্য। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ বাদে বাঙালির রূপান্তর ঘটেছিল সেদিন, ভেতো ভীতু বাঙালি বীরত্বের ডাকে সাড়া দিল, কলহ ও কোন্দল ভুলে এক হয়ে গেল, বাক্যবাগীশ কর্মবিমুখ না-থেকে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এর ফল মুক্তিযুদ্ধ এবং ফসল বিজয়।

দুর্ভাগ্য, যুদ্ধকালের এই উদ্দীপনা, এই ব্রতী মনোভাব যুদ্ধ-পরবর্তী শান্তিকালে দেশগঠনের লড়াই অবধি ধরে রাখা গেল না। প্রায় বিজয়ের পরপরই যেন মানুষ ফিরে গেল তাদের সামাজিক, সাংসারিক সত্তায়। বরং এত দিনের ত্যাগ ও সংযমের পর অকস্মাৎ যেন ক্ষুদ্র স্বার্থের বাঁধ ভেঙে গেল। একটা অস্থির বিশৃঙ্খল সময় দেশকে গ্রাস করেছিল তখন। এমন অস্থিতিশীল সময়ের সুযোগ নেওয়ার মানুষেরও অভাব ছিল না। একদল বিপ্লবী আদর্শের স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নামল তো আরেক দল পরাজিত আদর্শের বীজ সংরক্ষণ করে প্রত্যাঘাতের ষড়যন্ত্রে নেমে গেল। দেশের আদর্শ কি পরিকল্পনা–সবই ওলটপালট হয়ে গেল। সামরিক স্বৈরশাসনে রাজনীতিক এবং শিক্ষিতসমাজ উভয়ের চরম অবক্ষয় ঘটায় সমাজের বড় ক্ষতি হলো। রাজনীতি সম্পূর্ণ আদর্শচ্যুত হয়ে গেল। আদর্শের ভিত ছাড়া ছাত্র-রাজনীতি তো চলতেই পারে না, হয়তো তাই এর আদর্শচ্যুতি ঘটেছে সবশেষে, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর। কিন্তু তারপর অবক্ষয় এত ক্ষিপ্রগতিতে ঘটেছে যে, কয়েক বছরেই চলে গেল অপশক্তির গ্রাসে। এখন এর নানান বিকার রাজনীতি ও সমাজ উভয়কেই বড্ড ভোগাচ্ছে।

মার্কিন সমাজ দার্শনিক ডেনিয়েল বেল ১৯৬৫ সালে পরিবর্তমান মার্কিন সমাজের প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন বই ‘আদর্শবাদের সমাপ্তি’—দ্য এন্ড অব আইডিওলজি। নব্বইয়ের দশকে এই লক্ষণ আমাদের সমাজেও দেখতে পেলাম। এই বাস্তবতায় সনাতন বা ধ্রুপদি ধারণা থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বা সুশাসনের মান বিচার করলে হতাশ হতে হবে। গণতান্ত্রিক বিকাশের সঙ্গে মানবাধিকারের সুরক্ষা, আইনের শাসনের নিশ্চয়তা, সব মত-পথের অন্তর্ভুক্তি, স্বাধীন স্থানীয় সরকার, মানুষের অংশগ্রহণ, নাগরিক অধিকারের সাম্য ও এর সুরক্ষা, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদি মোটামুটি সহনীয় মাত্রায় ও মানে চর্চা হওয়ার কথা। এসব ক্ষেত্রে আমাদের বাস্তবতা প্রত্যাশিত মানের কাছাকাছি নেই, এটা মানতেই হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্য যেমন রাজনীতিচর্চা কঠিন করে রাখা হয়েছে, তেমনি ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সম্পদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করা যায়নি।

কিন্তু এ-ই শেষ কথা নয়। বাংলাদেশ থেমে থাকেনি। বহুকাল আগে মনীষী হুমায়ুন কবীর কবিতার প্রসঙ্গে এই ভাঙাগড়ার দেশে মানুষের উদ্যমশীলতার কথা বলেছিলেন। প্রাণচঞ্চল, খামখেয়ালি দুর্বার প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস করে আসা এই জনপদের মানুষের রয়েছে ঘাড় গুঁজে বিপর্যয় সইবার ক্ষমতা আর দুর্যোগের পর-ই নবোদ্যমে জীবনজয়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার অফুরন্ত উদ্যম।

এই মানুষ গণতন্ত্র বা সুশাসনের অপেক্ষায় বসে থাকেনি, নিজের মতো করে প্রাপ্ত সব সুযোগ কাজে লাগিয়ে রীতিমতো ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সরকারি কিছু কর্মীর আন্তরিক ভূমিকা, বেসরকারি সংস্থার দূরদর্শী সহায়তা, বেসরকারি উদ্যোক্তার বিনিয়োগ গ্রামবাংলার পল্লিবধূ আর ভীরু বালিকাদের দলে দলে কর্মীতে রূপান্তরিত করেছে। নিম্নবর্গের খেটে খাওয়া মানুষের বেকারত্ব ঘুচিয়ে সত্তর দশকের তেলের উচ্চমূল্য তাদের জন্য বিদেশে রোজগারের পথ খুলেছে। এ সময় কৃষি উৎপাদনে চমকপ্রদ বিপ্লব ঘটতে সাহায্য করেছে সরকারি উদ্যোগ ও কৃষকদের শ্রম। একাত্তরে যখন আমরা বিজয় অর্জন করি, তখন সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার খাদ্যসংস্থান করতে পারতাম না, এখন দ্বিগুণেরও বেশি মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করছেন দেশের কৃষক। প্রত্যেক মানুষের দু-একটা শার্ট আছে, পায়ে আছে অন্তত রাবারের চপ্পল, গ্রামের হাটে মহার্ঘ্য ফলের সওদা মেলে, মেয়েরা দল বেঁধে স্কুলে যায়, গর্ভবতী নারী স্বাস্থ্য পরামর্শ পান ঘরের কাছেই। একটু খেয়াল করলে বুঝব, বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিসর বড় হচ্ছে, তাতে অংশীদারত্বের ব্যাপ্তিও ঘটছে। যে তিনটি ক্ষেত্রের অবদানে অর্থনীতির বিকাশ ঘটে—মানসম্পন্ন শিক্ষা, পুঁজি সঞ্চারের ক্ষমতা এবং অবকাঠামোর উন্নয়ন ইত্যাদিকে সরকার অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ফলে যেকোনো পরিস্থিতিতে—প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রকট রাজনৈতিক সংকট কিংবা বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থার প্রতিকূল অবস্থান, সবই বাংলাদেশ নিজেই উপেক্ষা করে এগোতে পারে আজ। দেশের এই সামর্থ্যকে উপেক্ষা করা অন্যায় হবে।

গণতন্ত্র এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধিকার সংকোচনের জন্য সরকারের দিকে আঙুল তোলাই যায়। তোলাই যায়; কিন্তু মনে হয় তাতেই সমস্যা বোঝার এবং তার সমাধানের সূত্র পাওয়ার দাবি করা যায় না। আদতে গত তিন দশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির, বিশেষত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিস্ময়কর যে বিস্তার ঘটেছে, তা কেবল সর্বগামী ও সুলভ তা নয়, এর প্রভাবে ব্যক্তি ও সমষ্টির জীবনযাপন এবং মানসজগৎ উভয়েই বড় রকমের গুণগত পরিবর্তনের চাপ তৈরি হয়েছে। মানুষের নিজ নিজ জীবন নতুন ধরনের এক গতি, বৈচিত্র্যময় এবং ভোক্তা সুবিধার সম্মুখীন হয়েছে। এতে তাঁকে জড়িয়ে পড়তেই হচ্ছে। এর ওপর চলাচল ও যোগাযোগের বিশ্বায়ন এবং বাজার অর্থনীতির একচ্ছত্র দাপটেও যাপিত জীবন ও মানসজগতে গুণগত পরিবর্তনের চাপ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এর চাপ দৈনন্দিন আহার্য, ব্যবহার্য থেকে সাংস্কৃতিক বিনোদন হয়ে আধ্যাত্মিক চেতনা পর্যন্ত প্রভাবিত, প্রসারিত হচ্ছে।

আমার ধারণা, পরিবর্তনের বর্তমান প্রচণ্ড চাপে নিজেদের সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত মনে করছেন সনাতন চিন্তার ধর্মীয় কট্টরপন্থী মানুষ। তাঁরা কখনোই বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি। এই বকেয়া জমেছে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সময় থেকে। আজ তাঁরা কীভাবে নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার মতো গভীর মনীষার পরিচয় দেবেন? এ রকম গোঁড়ামি হয়তো সেক্যুলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তৈরি হতে পারে। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ার দাপট ততটা মরিয়া ও মারাত্মক হবে না, তাই রক্ষা।

আমরা জানি, কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদীদের জঙ্গি তৎপরতার; যেমন, আইএস বা আল কায়েদা ইত্যাদির পেছনে আরও স্বার্থ জড়িত আছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ যেমন কলকাঠি নাড়ে, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকেরাও এদের সৃষ্ট অস্থিরতার সুযোগ নেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও এ কথাই সত্য যে, কট্টরপন্থার এই দীর্ঘমেয়াদি স্থবিরতার পেছনে চিন্তার অচলায়তনের ভূমিকাই প্রধান। হতাশার কথা হলো এ রকম এক জটিল ক্রান্তিকালে দেশের নাগরিক সমাজ কার্যকর এবং গঠনমূলক ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

এই ব্যর্থতার আড়ালে বাংলাদেশে আরও এক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। সরকারের প্রায় সর্বময় ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে তিন মেয়াদে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৬-২০০১-এর হাসিনা নন, কেবল আরও পরিণত হয়েছেন তা নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ও কাজ সম্পর্কে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন, যে আত্মবিশ্বাস দেশের প্রতি অঙ্গীকারের দ্বারা বলীয়ান। উত্তরাধিকারের রাজনীতি তাঁর ক্ষেত্রে যেন নেতিবাচক হয়নি, ইতিবাচক পথেই তিনি একে চালাতে পারছেন। তবে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে—তাঁর পরে কে?

বঙ্গবন্ধুর পর আওয়ামী লীগ দিশা হারিয়েছিল, শেখ হাসিনার পর কী হবে? তিনি কি দেশে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন করছেন? শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছাড়া উন্নয়ন বা গণতন্ত্র কিছুই যথাযথ ফল দেবে না। শেষ পর্যন্ত উন্নয়ন তো মানুষের জন্যই, উন্নত মানুষ ও তাঁর গড়া উন্নত সমাজই তো কাম্য। সে পথে আমরা এখনো নেই।

আবুল মোমেন, সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত