Ajker Patrika

সাদা পাথরের সৌন্দর্য হারানোর কান্না

লবীব আহমদ, সিলেট 
আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ০৮: ৫৯
সাদা পাথরের সৌন্দর্য হারানোর কান্না

দিনদুপুরে অবাধে চলছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের পাথর লুটপাট। সামনে দিয়ে বালু-পাথর লুট করে নিয়ে গেলেও প্রশাসনের ভ্রুক্ষেপ নেই বলে দাবি করছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। তাঁরা বলছেন, প্রশাসনের ব্যর্থতা আর মদদে এ লুটপাট হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই শুরু হয় এ লুটপাট। পরে স্থানীয় লোকজন ও সেনাবাহিনীর কারণে সাময়িক বন্ধ হলেও আবারও লুটপাট শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সময় প্রশাসন লোকদেখানো অভিযান চালালেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এলাকাবাসীর অভিযোগ, যেখানে পাথর কেনাবেচা হয় এবং যেদিক দিয়ে পাথর নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিকে অভিযান না হওয়ায় লুটপাট বন্ধ হচ্ছে না।

গত শনিবার সরেজমিনে সাদা পাথরে গিয়ে দেখা যায়, সাদা পাথরের প্রধান স্পট যেখানে পর্যটকেরা সাঁতার কাটছেন, এর পাশ থেকেই বারকি ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা দিয়ে চলছে অবাধে পাথর লুট। কয়েক শ নৌকায় করে এসব পাথর তোলা ও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

সাদা পাথর লুটপাট করে কারা, এ নিয়ে বেশ কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, সেখানে প্রতিদিন প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার শ্রমিক পাথর নিতে আসেন। যাঁদের ৫ ভাগের ১ ভাগ স্থানীয় লোক, বাকিরা বহিরাগত। যাঁরা ধলাই নদতীরবর্তী এলাকায় ভাড়ায় থেকে প্রতিদিন নৌকায় এসে পাথর লুট করেন।

কাউসার নামের এক শ্রমিক জানান, ‘আমরা ২ জন প্রতিদিন প্রায় ৩ থেকে ৪ ট্রিপ দেই। প্রতি ট্রিপে ২৫০০-২৬০০ টাকা পাওয়া যায়। আগে বাংকার থেকে যখন পাথর নিতাম, তখন নৌকাপ্রতি সাড়ে ৩ হাজার টাকা পেতাম। তখন বিজিবিকে

নৌকাপ্রতি ৩০০ টাকা দিতে হতো। এখন কাউকে দিতে হয় না। তবে স্থানীয় কিছু নেশাখোর সকালে আসে টাকা নেওয়ার জন্য। জোর করে অনেকের কাছ থেকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা নেয়। এখন মাঝেমধ্যে বিজিবি ও পুলিশ এসে দৌড়ায়। এখানে ৪ থেকে ৫ হাজার মানুষ। কতজনকে দৌড়াবে।’

আরেক শ্রমিক মধ্যবয়সী সুমন মিয়া বলেন, ‘সাদা পাথরে এক নৌকা পাথর তুলতে ১ ঘণ্টা লাগে। আর ভরতে ১০ মিনিট লাগে। পরে আমরা সেগুলো নৌকায় করে ধলাই নদের দুই পাশে নিয়েই বিক্রি করতে পারি। সেখানে প্রতি নৌকায় আড়াই, তিন হাজার টাকা পাওয়া যায়। বাংকারে কম মানুষ কাজ করার কারণে আমরা পাথর বিক্রি করে ভালো টাকা পেতাম, এখন সেটা কমে গেছে। এখন তেমন অভিযান হয় না, মাঝেমধ্যে বিজিবি এসে দৌড়ায়। আমরা ৪ জন একসঙ্গে কাজ করি।’

কোথায় বিক্রি হয় পাথর

ধলাই নদের দুই পাশে প্রতিদিন সাদা পাথর ও বাংকার থেকে নৌকায় করে আসা পাথর বিক্রি হয়। ধলাই নদের পূর্বপাড়ের কালাইরাগ, দয়ারবাজার ও কালীবাড়ি এরিয়ায় এবং পশ্চিমপাড়ে ১০ নম্বর ঘাট, ব্যাটারি ঘাট, ১০ নম্বর নৌকা ঘাট ও আশপাশে বিক্রি হয় এই সাদা পাথর। এখানে নদীর পাশে পাথর কিনে পরে তা অন্যত্র বিক্রি করা হয়। এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মূলত স্থানীয়রা। তাঁরা নৌকা থেকে পাথর কেনেন। পরে এগুলো ট্রাকে করে সারা দেশে যায়।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থেকে সরাসরি ট্রাকে পাথর ঢাকার কাঁচপুরে ও গাবতলীতে যায়। এই পাথর ভোলাগঞ্জ থেকে সড়কপথে নিতে হলে উপজেলার ভোলাগঞ্জ, টুকেরবাজার হয়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সামনে দিয়ে যেতে হয়। এসব এলাকায় পুলিশের চেকপোস্ট আছে। তবে এরপরও থামানো যাচ্ছে না পাথর পরিবহন।

এদিকে স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনজীবী ফরহাদ খন্দকার বলেন, সাদা পাথর রক্ষায় প্রশাসন নিষ্ক্রিয়। সেখানে প্রশাসন ১৫-২০ দিনে একবার অভিযান চালায়। একবার অভিযানের পর আরেকবার অভিযানে যেতে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করতে আরও ১৫ দিন চলে যায়। এই ১৫ দিনে কমপক্ষে ১৫ কোটি টাকার পাথর লুট হয়ে যায়। প্রশাসন যদি আইনি পদক্ষেপ নেয়, অপরাধীদের যদি আইনের আওতায় আনে—তাহলেই লুটপাট বন্ধ হবে।

এ নিয়ে গত সোমবার বিকেলে কথা হয় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আজিজুন্নাহারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা ডিসি অফিসে কথা বলেছি। হয়তোবা এ সপ্তাহের মধ্যে আবার ক্রাশারগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হবে। আগেরবার আমরা অনেকটা শক্ত অভিযানে ছিলাম। পরবর্তী সময়ে পরিবহন শ্রমিকেরা সড়ক অবরোধ করে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এরপর থেকেই এই লুটপাট হচ্ছে।’

তবে অধিকারকর্মীরা বলছেন ভিন্ন কথা। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ সাহেদা আখতার বলেন, ‘প্রশাসনকে আমি সাদা পাথর রক্ষার্থে ব্যর্থ বলব না। ব্যর্থ তারা তখনই হতো, যখন চেষ্টা করত। সাদা পাথর রক্ষার্থে তো তারা কখনো কোনো চেষ্টাই করেনি।’

সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘সাদা পাথর রক্ষার্থে আমরা তো নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি; কিন্তু কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না।’

পুলিশের সামনে লুট

গত শনিবার সাদা পাথরে দেখা যায় ট্যুরিস্ট পুলিশের ২ জন মহিলা ও ১ জন পুরুষ সদস্যকে। তারা হাঁটছেন ওই স্পটেই। আর এর কয়েক হাত দূর থেকেই সাদা পাথর লুট করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ট্যুরিস্ট পুলিশের ভোলাগঞ্জ জোনের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) অভিরঞ্জন দেবের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘ভোলাগঞ্জে আমাদের ট্যুরিস্ট পুলিশের ক্যাম্প রয়েছে। আমিসহ ৩ জন মহিলা পুলিশ নিয়ে ১২ জন রয়েছি। প্রতিদিন ২ শিফটে ৬ জন দায়িত্ব পালন করেন। আমরা মূলত পর্যটকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করি। আমাদের তো লোকবল নেই, আর আমরা চাইলেও তাদের (সাদা পাথর লুটকারীদের) কোনোভাবে মোকাবিলা করতে পারব না।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে হত্যা: গৃহকর্মী আয়েশা ঝালকাঠিতে গ্রেপ্তার

প্রাথমিকভাবে ১২৫ আসনে এনসিপির প্রার্থী ঘোষণা

৫০ বছর ধরে কবর খুঁড়ছেন মজিরুল, নিঃস্বার্থ সেবায় গাংনীর গোরখোদকেরা

বুমরার বিতর্কিত উইকেটে ‘জড়িত’ এক ভারতীয় আম্পায়ার

শ্রীপুরে বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ, ফটকে তালা ঝুলিয়ে পালিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ

এলাকার খবর
Loading...