Ajker Patrika

ভাদর কাটানি উৎসব, নববধূরা ফিরছেন বাবার বাড়ি

সাইফুল আলম বাবু, পঞ্চগড়
আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ২১: ০৬
Thumbnail image

গত বছরের আশ্বিন থেকে চলতি শ্রাবণ মাস পর্যন্ত বিবাহিত মেয়েদের অনেকে বাবার বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। স্বামীর মঙ্গল কামনার লক্ষ্যে ভাদ্র মাসের ১ থেকে ৩ তারিখ পর্যন্ত স্বামীর মুখ দর্শন থেকে বিরত থাকবেন তাঁরা। আনুষ্ঠানিক ও লৌকিক লোকাচার রীতি মেনে ঘটা করেই তাঁরা যাচ্ছেন বাবার বাড়ি।

পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলে স্থানীয়ভাবে লোকাচার রয়েছে, বিয়ের প্রথম বছরের ভাদ্র মাসের ১ থেকে ৩ তারিখ স্বামীর মুখ দর্শন করলে স্বামীর অমঙ্গল হয় এবং চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ার নববধূদের লৌকিক আশঙ্কা থাকে। এ জন্য নববধূরা বিয়ের পর প্রথম ভাদ্র মাস আসার আগেই শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি যান।

শ্রাবণের শেষ সপ্তাহে বাবার বাড়ির লোকজন পায়েস, নানা স্বাদের পিঠা-পুলি, মিষ্টান্ন ও ফলমূল নিয়ে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে মেয়েকে নিতে যায়। মেয়ের বাড়ি থেকে পাঠানো মজাদার সেসব খাদ্যসামগ্রী আশপাশের প্রতিবেশীদের বাড়িতে বিতরণও করে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তারাও নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে বউয়ের বাড়ির লোকজনকে সমাদর করার। সারা দিনই হইচই আর উৎসবে মেতে থাকে নববধূর শ্বশুরবাড়ি। নববধূকে বাবার বাড়ি নেওয়ার এ রেওয়াজটি স্থানীয়দের কাছে ‘ভাদর কাটানি’ উৎসব নামে পরিচিত।

পঞ্চগড় সদরের মীরগড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আতাউর রহমান ও শাহাজুল ইসলাম বলেন, উৎসবের রীতি অনুযায়ী গত এক বছরে যত মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তারা বিয়ের প্রথম বছরের প্রথম ভাদ্র মাসের ১ থেকে ৩ তারিখ পর্যন্ত স্বামীর মঙ্গল কামনায় স্বামীর মুখ দর্শন করেন না। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ‘ভাদর কাটানি’র কোনো ব্যাখ্যা না থাকলেও এ অঞ্চলের আদি প্রথা অনুযায়ী এ উৎসবটি যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে। নববিবাহিত বধূ বাবার বাড়িতে মেহমান হিসেবে ঘটা করে বাড়ি ফিরবে, এটা বাবার বাড়ির লোকেদের কাছে আনন্দের একটি উপলক্ষ। যা সব সময় আসে না। অনেকের কাছে এটি ঈদ উৎসবের মতোই।

বেসরকারি সংস্থার কর্মী নাজনীন আকতারের (২৮) পাঁচ মাস আগে বিয়ে হয়েছে। পঞ্চগড় শহরতলির মীরগড়ে ব্যবসায়ী আসিফ মৃধা পিউরের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর প্রথম ভাদ্র মাস। আঞ্চলিক রীতি মেনে স্বামীর মঙ্গল কামনা করে তিনি গতকাল এসেছেন মীরগড় দক্ষিণপাড়ায় বাবার বাড়ি। ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে আসা নাজনীন যদিও পুরোনো ভ্রান্ত বিশ্বাসে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু পুরোনো এই রীতিকে অস্বীকারও করেন না তিনি। তিন দিন স্বামীর মুখ না দেখে বাবার বাড়িতে কাটাবেন নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে। এ জন্য কর্মস্থল থেকে নিয়েছেন ছুটি।

শহরতলির ঘাটিয়াপাড়ায় বাবার বাড়িতে ভাদর কাটাতে এসেছেন শিলা মনি। ছবি: আজকের পত্রিকাবাবার বাড়ি ফিরেছেন ওই গ্রামের সুবর্ণা আকতারও (২০)। স্বামী মুদি ব্যবসায়ী মো. তামিমের কল্যাণ কামনা করে এক সপ্তাহ থাকবেন বাবা জালালউদ্দীনের বাড়িতে।

পঞ্চগড় সদরের স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়সহ বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর অঞ্চলে এবং ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিনাজপুর মালদহ এবং মুর্শিদাবাদের কোনো কোনো অংশে এই প্রথা এখনো চালু আছে। এ ছাড়া জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি জেলার কোনো কোনো অংশেও এই প্রথা বাঙালি সমাজে চালু রয়েছে বলে জানা যায়।

আধুনিক যুগে ভাদর কাটানির পক্ষে নিরপেক্ষ তর্ক-যুক্তি নেই। তবু ভাদর কাটানি উৎসব থেমে নেই। যারা মনেপ্রাণে বাঙালি, যারা বাঙালির রীতিনীতি ও প্রথা মেনে চলেন বা মানার চেষ্টা করেন, তাঁদের নিয়মের ভেতরেই রয়েছে ভাদর কাটানির এই প্রথা।

তবে জেলার গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, বিবাহিত জীবনের প্রথম ভাদ্র মাসের ১ থেকে ৩ তারিখ পর্যন্ত স্বামীর মুখ দেখলে পরিবারে অমঙ্গল হবে। তা ছাড়া সাধারণত ভাদ্র মাসে এ জেলায় বিয়ের কোনো আয়োজনও চোখে পড়ে না। প্রচলিত এ প্রথাটি যুগ যুগ ধরে এ অঞ্চলে চালু রয়েছে।

শহরের মানিকপীর বেংহারী ফাজিল মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক সেলিনা আকতার বলেন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভাদর কাটানি নামে কোনো উৎসব না থাকলেও নববধূরা একে কেন্দ্র করে বাবার বাড়িতে কিছুদিন থাকার সুযোগ পান; আত্মীয়স্বজনের দেখা সাক্ষাৎ হয়—এটা অনেক আনন্দের।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত