Ajker Patrika

ফলোআপ /ভয় দেখিয়ে দেওয়া হয় টাকা, ‘খাসির খানা’ হচ্ছে না

 রিমন রহমান, রাজশাহী
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১: ১২
ঘটনাস্থলে পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা। ছবি: আজকের পত্রিকা
ঘটনাস্থলে পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা। ছবি: আজকের পত্রিকা

রাজশাহীর মোল্লাপাড়ায় পাহাড়িয়াদের ভয় দেখিয়ে টাকা দেন সাজ্জাদ আলী। তিনি বলেছিলেন, পাহাড়িয়ারা যদি থানা-পুলিশে দৌড়াদৌড়ি করে, তাহলে যে টাকা দেওয়া হচ্ছে, সেটাও দেওয়া হবে না। আজ বৃহস্পতিবার সকালে নগরের কাশিয়াডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল বারী ওই মহল্লায় গেলে সবার সামনে পাহাড়িয়ারা এমন কথাই বলেছে।

এর আগে গতকাল বুধবার আজকের পত্রিকা'র অনলাইনে ‘শুক্রবার খাওয়ানো হবে খাসি জবাই করে, রোববার ছাড়তে হবে ঘর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরদিন আজ বৃহস্পতিবার আজকের পত্রিকার প্রিন্ট সংস্করণেও এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে উঠে আসে, ৫৩ বছর পাহাড়িয়ারা ১৬ কাঠা জমির ওপর বাস করে আসছে। এলাকার বাসিন্দা সাজ্জাদ আলী এত দিন পর এ জমির মালিকানা দাবি করছেন। তাঁর চাপে তিনটি পরিবার জায়গা ছেড়ে চলে গেছে।

আজকের পত্রিকায় সংবাদটি প্রকাশের পর শুরু হয় তোলপাড়। তৎপর হয় পুলিশ-প্রশাসন। আজ সকালে পাহাড়িয়াদের মহল্লায় যান পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার লোকজন। সরেজমিনে দেখা যায়, পুলিশের একটি দল নিয়ে আসেন কাশিয়াডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল বারী। তিনি সাজ্জাদ আলীকেও ফোন করে ডেকে আনেন।

ওসি আজিজুল বারী পাহাড়িয়াদের প্রশ্ন করেন, ‘আপনারা কেন থানায় যাননি?’ জবাবে ভুক্তভোগী এক নারী বলেন, ‘সাজ্জাদ আলী বলেছেন যে তোমরা যদি বাড়াবাড়ি কর, যেটুকু টাকা দিচ্ছি, সেটাও দেব না। এটার জন্য আমরা কোনো জায়গাতে যেতে পারলাম না। আমরা টাকা নিতে বাধ্য হলাম।’

আরও একজন বলেন, ‘এখানে জন্মজায়গা। আমরা যদি এখানে থাকতে পারি, থাকতে চাই। জন্মজায়গা ছেড়ে কেউ চলে যেতে চায়? কেউ তো চাই না। কিন্তু আমরা কুনু জাগাতেই যাইনি। আমাদের বুলেছে, তোমরা যুদি হাঁটাহাঁটি করো, তাহিলে কুনু টাকাই পাবা না।’

এলাকার বাসিন্দা আসাদ আলীও এসেছিলেন। পুলিশের সামনেই বললেন, ‘এখানে এরা ৬২ বছর ধরে বাস করছে। এই জমির মালিক ইন্দ্র ধুপি। সাজ্জাদের কথা আমরা শুনিনি।’

সেখানে ছিলেন সাজ্জাদ আলীর কেয়ারটেকার মো. শাহীন। ওসি আজিজুল বারী সাজ্জাদকে কয়েকবার ফোন করান তাঁকে দিয়ে। একপর্যায়ে একটি দলিল হাতে আসেন সাজ্জাদ। তিনি দাবি করেন, এ জায়গা তিনি ১৯৯৪ সালে কিনেছেন। পুনর্বাসন করে জায়গা দখলে নিচ্ছেন।

খাসি জবাই করে খাওয়ানোর আয়োজনের বিষয়ে সাজ্জাদ বলেন, ‘তারা এখানে এত দিন ছিল। চলে যাচ্ছে। আমি তাদের মুরগি খাওয়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারাই বলেছে যে খাসি খাওয়াতে হবে।’

তবে পুলিশের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, আগামীকাল শুক্রবার কোনো ‘খাওয়া’ হবে না সেখানে।

এ সময় বিভিন্ন মানবাধিকার ও অন্যান্য সংগঠনের নেতারাও সেখানে আসেন।

ওসি আজিজুল বারী জানান, বিষয়টি তাঁর কাছে ঢাকা থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে। তিনি প্রতিটি বাড়ির তালিকা করে নেন। তিনি ১৩টি পরিবার থেকে ১৩ জন এবং সাজ্জাদ আলীকে বিকেল ৫টায় কাশিয়াডাঙ্গা জোনের উপপুলিশ কমিশনারের (ডিসি) কার্যালয়ে ডাকেন। ওই সময় তিনি ঘটনাস্থল থেকে মোবাইল ফোনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সবকিছু জানান।

ওসি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি সংবাদমাধ্যমে জেনে এখানে এসেছি। এ বিষয়গুলো নিয়ে তারা কখনো আগে থানায় যায়নি। নিউজ হওয়ার পরে আপনারা এসেছেন, আমরাও এসেছি। আমরা সকলে মিলে যেটা সুষ্ঠু সমাধান হয়, সেটা করব। যেটাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে না, সেটা করব। আপাতত এখানকার বাসিন্দারা এভাবেই থাকবেন। জমির কাগজপত্র চুলচেরা বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জমির মালিক কে?

পাহাড়িয়াদের দাবি, এ জমির মালিক ছিলেন ইন্দ্র ধুপি নামের একজন ধোপা। মুক্তিযুদ্ধের পর ভারত থেকে ফিরে আসা ছয়টি পাহাড়িয়া পরিবারকে তিনি এখানে বাড়ি করতে দেন। জায়গাটি তখন ইন্দ্র ধুপির বাথান নামে পরিচিত ছিল। ইন্দ্র ধুপি নিঃসন্তান ছিলেন।

ভূমি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, হড়গ্রাম মৌজায় ৫১ নম্বর জে এল ও ১২৯০ নম্বর দাগে জমিটির পরিমাণ ৩৭ দশমিক ৯৪ শতক। ৪০৫ নম্বর আরএস খতিয়ানে জমিটির মালিক হিসেবে লেখা রয়েছে রাজশাহীর কাজীহাটা এলাকার গাজিয়া রজকিনি ও ময়মনসিংহের কোতোয়ালির মনিতারা রজকিনি।

তবে ১৯৯৪-৯৫ সালে এ জমি খারিজ হয়েছে সাজ্জাদ আলী, সৈয়দ আলী, ইমতিয়াজ ও ফাহামিদার নামে। সাজ্জাদ আলী পুলিশের সামনে যে দলিল হাজির করেন, সেখানে দেখা যায়, মধুসূদন দাস, দিলীপ দাস, আমমোক্তার সূর্য কমল দাস, প্রকাশ দাস ও তৃপাল রজকের কাছ থেকে তাঁরা কিনেছেন।

ভূমি অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, আরএস রেকর্ডে গাজিয়া রজকিনি ও মনিতারা রজকিনির কাছ থেকে সাজ্জাদের কাছে সরাসরি দলিল হলে কোনো প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু মধুসূদন দাস, দিলীপ দাস, আমমোক্তার সূর্য কমল দাস, প্রকাশ দাস ও তৃপাল রজকের নামে জমি কীভাবে হয়েছিল, আগে সে দলিল দরকার। ওই দলিল না পাওয়া গেলে সাজ্জাদের কাছে থাকা দলিল থাকা প্রশ্নবিদ্ধ। এ দলিল সঠিক কি না, সেটা তদন্ত করে দেখতে হবে।

তদন্তে জেলা প্রশাসন

পাহাড়িয়াদের ওই মহল্লা পরিদর্শন করেছেন জুলাই-৩৬ পরিষদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ জামাল কাদেরী, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি গণেশ মার্ডি, সাধারণ সম্পাদক বিমল চন্দ্র রাজেয়াড়, মানবাধিকারকর্মী আরিফ ইথার, বরেন্দ্র ইয়ুথ ফোরামের সহসাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমানসহ অনেকে। তাঁরা সবার সঙ্গে কথা বলেন।

এ সময় আদিবাসী নেতা গণেশ মার্ডি বলেন, ‘এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, আমরাও এ বিষয়ে কিছু জানতাম না। তারা আমাদেরও কিছু জানায়নি। এভাবেই তারা বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। আমরা চাই, প্রশাসন এ ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত করে যেন ব্যবস্থা নেবে।’

জুলাই-৩৬ পরিষদের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ জামাল কাদেরী বলেন, এই পরিবারগুলো ৫৩ বছর ধরে এখানে বাস করছে। এর মধ্যে আরএস রেকর্ড হয়েছে। তখন মালিক না হোক, দখলীয় হিসেবেও তো আদিবাসীদের কথা লেখা উচিত ছিল। কিন্তু সেটাও হয়নি।

জানতে চাইলে নগরের বড়কুঠি ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফুল ইসলাম জানান, বিষয়টি জেলা প্রশাসন তাঁকে তদন্ত করতে বলেছে। তিনি দুপুরে একজন সার্ভেয়ারকে পাঠিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি নিজেও যাবেন। সবকিছু তদন্ত করে একটা প্রতিবেদন দেবেন।

উল্লেখ্য, মোল্লাপাড়ার এ জায়গা রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডে। রাজশাহীর আমচত্বর-কাশিয়াডাঙ্গা সড়কসংলগ্ন এ জায়গার দাম এখন কয়েক কোটি টাকা। ৫৩ বছর আগে এখানে প্রথমে ছয়টি পরিবার বাড়ি করার সুযোগ পায়। তিন প্রজন্মে বাড়ি হয় ১৬টি।

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন দিন পর একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারী সাজ্জাদ আলী সেখানে যান এবং জানান যে জমির মালিক তিনি। এখন তাঁদের উঠে যেতে হবে। এরও বছর দুয়েক আগে তিনি এ দাবি তুললে তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম দুপক্ষকে নিয়ে বসেছিলেন। পাহাড়িয়াদের দাবি, তখন সাজ্জাদের দলিলকে ‘জাল’ বলেছিলেন কাউন্সিলর। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নজরুল ইসলাম আত্মগোপনে রয়েছেন। তাই তাঁর সঙ্গে কথা বলে বিষয়টির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

সাজ্জাদ আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, ভয়ভীতি দেখিয়ে অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে তিনি আরও জমি দখল করেছেন। এটিই তাঁর কৌশল। পাহাড়িয়াদেরও তিনি টাকা দিয়েছেন। প্রথম বাড়ি করা ছয়টি পরিবার ধরে প্রতিটি বাড়িতে দিয়েছেন ৬ লাখ করে টাকা। ছয় পরিবার এখন বেড়ে হয়েছে ১৬টি। মোট ৩০ লাখ টাকা ১৬ পরিবারে ভাগ হয়েছে। কেউ পেয়েছেন ৫০ হাজার, কেউ ১ লাখ, কেউবা ২ লাখ। তা নিয়েই তাঁরা চলে যাচ্ছিলেন।

ইতিমধ্যে তিনটি পরিবার অন্যত্র চলে গেছে। অন্য ১৩ পরিবারকে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছিল রোববার। তার আগে শুক্রবার সাজ্জাদ আলী খাসি জবাই করে সবাইকে খাওয়ানোর আয়োজন করেছিলেন। সেখানে আশপাশের লোকজনকেও দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ