Ajker Patrika

শিক্ষার্থীদের কাছে ‘বটবৃক্ষ’ ছিলেন রাবি শিক্ষক পুরনজিত

রিপন চন্দ্র রায়, রাবি 
আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫: ০৪
Thumbnail image
পুরনজিত মহালদার। ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পুরনজিত মহালদার। মুখে সর্বদাই হাসি লেগে থাকত তাঁর। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের ধরন ও আন্তরিকতার কারণে তিনি শিক্ষার্থীদের কাছে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। পুরো ক্যাম্পাসেও ছিলেন পরিচিত মুখ। যে কোনো বিপদে সবার আগে যাঁর কাছে ছুটে যেতেন, তাঁর মৃত্যুতে একজন আদর্শ শিক্ষক হারালেন শিক্ষার্থীরা।

গত সোমবার দুপুরে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে বের হয়েছিলেন পুরনজিত মহালদার। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে আর বাসায় ফেরা হয়নি। রাজশাহী নগরের ছোট বনগ্রাম এলাকার বারো রাস্তার মোড়ে স্কুটার নিয়ে বালুর ওপর পড়ে গিয়ে একটি ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খান। তাতে মাথা ও হাতে গুরুতর আঘাত পান তিনি। তাঁকে আহত অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সোমবার রাত ২টা ৩৫ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

পুরনজিত মহালদারের মরদেহ গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা ৫০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মু. শহীদুল্লাহ একাডেমিক ভবনের সামনে আনা হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সহকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। এই প্রয়াণ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তাঁরা। মরদেহ বিভাগের সামনে নিয়ে এলে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিক্ষার্থীরা। পুরো এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বন্ধুজন অনেকেই ফেসবুকে পোস্ট করে শোক প্রকাশ ও স্মৃতিচারণ করেছেন।

পুরনজিত মহালদার শিক্ষার্থীদের পিতার মতো আগলে রাখতেন মন্তব্য করে বাংলা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এরশাদ আলম বলেন, ‘স্যারের সঙ্গে দেখা হলেই কাঁধে হাত রেখে বলতেন, “কেমন আছিস বাবা?” আমাদের পরিবারের খোঁজও নিতেন তিনি। ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে শুরু করে সব ধরনের কথা শেয়ার করা যেত স্যারের সঙ্গে। আর একজন দায়িত্বশীল পিতার মতো আমাদের সহযোগিতা করতেন তিনি। স্যারের এ বিদায় কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।’

মাস্টার্সের আরেক শিক্ষার্থী সুমন রায় বলেন, ‘বিভাগের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্যার ছিলেন পুরনজিত মহালদার। তাঁর পড়ানোর ধরন, শিক্ষার্থীদের প্রতি আন্তরিকতা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। আমাদের যেকোনো প্রয়োজন ও বিপদ-আপদে সবার আগে ছুটে যেতাম পুরনজিত স্যারের কাছে। অথবা নির্দ্বিধায় ফোন করতাম। তিনি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে আমাদের সাহায্য করতেন। তিনি আমাদের ওপর একটা বটবৃক্ষের মতো ছিলেন। তাঁর প্রয়াণে আমরা সেই বটবৃক্ষটি হারালাম।’

বাংলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী অর্বাক আদিত্য তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘ছাত্রদের বিপদের কথা শুনে উদ্বিগ্ন হওয়া মানুষটাও চলে গেলেন। ক্যাম্পাস ছাড়ার পর একবারই কথা হয়েছে। অনেক জ্বালিয়েছি আপনাকে। ক্ষমা চাওয়ার সুযোগও হলো না। আমরা আপনাকে ভালোবাসি স্যার। আপনারে মনে রাখব।’

পুরনজিত মহালদার। ছবি: সংগৃহীত
পুরনজিত মহালদার। ছবি: সংগৃহীত

বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার শিমু ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন। এই গ্রহে আপনার মতো অমায়িক মানুষ আর দুটি মেলা ভার। আপনি ছিলেন একজন, আমাদের পুরনজিত মহালদার।’

বিভাগের শিক্ষার্থী নাদিরা নিশা তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা একজন আদর্শ বাবাকে হারিয়ে ফেলল।’

বাংলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শহীদ ইকবাল বলেন, ‘এ ঘটনা আমাদের জন্য অত্যন্ত মর্মান্তিক ও বেদনার। এমন একজন মেধাবী, সংস্কৃতিমনা, প্রগতিশীল চিন্তার তরুণ শিক্ষকের এমন প্রয়াণ আমাদের বিভাগের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি অত্যন্ত শিক্ষার্থীবান্ধব একজন শিক্ষক ছিলেন। এ ছাড়া সহকর্মী হিসেবেও তিনি বন্ধুসুলভ ছিলেন।’

বিভাগে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বেলা পৌনে ১১টার দিকে মরদেহ পুরনজিত মহালদারের গ্রামের বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়ার রংপুর গ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মরদেহবাহী গাড়িটি সেখানে পৌঁছায়। প্রথমে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘শিক্ষা কল্যাণ সংঘ’ প্রাঙ্গণে নেওয়া হয়। পরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে কেন্দ্রীয় শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

পুরনজিত মহালদার ২০১২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ২০২০ সালে তিনি সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘আহমদ ছফার কথাসাহিত্য’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থসহ তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ গবেষণাপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান রেখে গেছেন।

এদিকে পুরনজিত মহালদারের মৃত্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব, সহ-উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীন ও অধ্যাপক ফরিদ উদ্দীন খান গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কর্মকাণ্ডে প্রয়াতের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত