Ajker Patrika

ভালো নেই সার্কাসের শিল্পীরা

রঞ্জন কুমার দে, শেরপুর (বগুড়া) 
আপডেট : ৩১ মে ২০২৩, ১৪: ০৪
ভালো নেই সার্কাসের শিল্পীরা

মাত্র ৯ বছর বয়সী শিশু জোনায়েদ, স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেন হবে। কিন্তু জীবিকার প্রয়োজনে কখনো সে সার্কাস প্যান্ডেলের ৮০ ফুট উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ে আবার কখনো ছোট তালাবদ্ধ ড্রামের ভেতরে থেকে গড়িয়ে চলে। প্রতি মুহূর্তেই ঝুঁকি নিয়ে জীবনও তার গড়িয়ে চলে এই মেলা থেকে ওই মেলায়।

জোনায়েদের মতো সার্কাসের শিল্পীদের জীবন বাঁধা পড়েছে প্যান্ডেলের তাঁবুতে। বিকল্প কোনো কাজে দক্ষতা না থাকায় পেশা পরিবর্তন করতে পারছে না এই মানুষগুলো। দর্শকদের বিনোদন দিলেও তাদের জীবনের গল্পগুলো করুণ বলে জানিয়েছেন বগুড়ার শেরপুরে কেল্লাপোষী মেলায় আসা দি নিউ গোল্ড স্টার সার্কাসের শিল্পীরা।

সার্কাসটির মালিক সাইদুল ইসলাম জানান, সারা দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫০টি সার্কাসের দল রয়েছে। মালিক ও শিল্পী সমিতিও রয়েছে। তার এই সার্কাসের দলে কাজ করেন ৭০ জন। বেশির ভাগ সপরিবারে এ কাজে যুক্ত। তবে তারা কেউ ভালো নেই। 

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে সবার হাতে হাতে স্মার্ট ফোন। তাই লোকজন আর সার্কাস দেখতে আগ্রহী না। সার্কাসে আমরা শারীরিক কসরত ছাড়া অশালীন কিছু দেখাই না। কিন্তু অশ্লীলতার কথা বলে অনুমোদনের জন্য প্রশাসন অনেক ঝামেলা করে। স্থানীয় অনেক মহলকে ম্যানেজ করতে হয়। প্রদর্শনীর অনুমোদনের ক্ষেত্রে প্রশাসনের আরও নমনীয় হওয়া উচিত।’

সার্কাস শিল্পী নাটোরের রেশমা (৪০) জানান, প্রায় ৩০ বছর আগে মা-বাবার হাত ধরে এই পেশায় এসেছেন। এখন স্বামী-সন্তানসহ পরিবারের ৫ জন ৩৫০ টাকা দিন মজুরিতে কাজ করছেন। এতে খেয়ে-পরে কোনো রকমে দিন চলে তাঁদের। সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারেননি। তারাও ছোট থেকে এই কাজ করছে। তাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই বলে মনে করেন হতাশ এই শিল্পী।

দি নিউ গোল্ড স্টার সার্কাসের সামনে উৎসুক মানুষের ভিড়একই কথা বলেছেন নাটোরের মালা বেগম। তিনি জানান, তাঁদের অনেকেই চেষ্টা করছেন পেশা পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু বংশপরম্পরায় এর বাইরে অন্য কিছু শেখেননি। বাধ্য হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ উপেক্ষা করে কোনো রকমে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।

শুরুতে যার গল্প বলা, সেই ছোট্ট জোনায়েদের মা ময়মনসিংহের ডালিয়া আক্তার। তিনিও মা-বাবার সূত্রে সার্কাসের দলে নাম লেখান। এখন তাঁর হাত ধরেই শিশু জোনায়েদ দড়ি বেয়ে ৮০ ফুট উঁচুতে উঠে দেখায় শারীরিক কসরত। আশঙ্কায় মায়ের মন দুরুদুরু করলেও জীবিকার তাগিদে হার মানে মমতা। তার পরও ছেলেকে শিক্ষিত করে অন্য পেশায় নেওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। 

সার্কাসের প্যান্ডেলে যতটা হাসিখুশি মনে হয়, বাস্তব জীবনটা তার চেয়েও কঠিন এই সার্কাস শিল্পীদের। নেই আর্থিক সচ্ছলতা, নেই সামাজিক মর্যাদা।

নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলার তিন ফুট উচ্চতার আব্দুল মজিদ কাজ করেন সার্কাসের জোকার হিসেবে। তিনি বলেন, ‘আমদের সম্মান শুধু সার্কাসের প্যান্ডেলেই। সমাজে আমাদের কোনো মূল্য নেই। সবার কাছে আমরা যেন ভিন্ন জগতের মানুষ।’

মজুরি নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন এই শিল্পীরা। জানান, যা পান পরিশ্রম অনুযায়ী তা খুবই সামান্য। অনেক সময় সার্কাসের মালিক ঠিকমতো বেতন দিতে চান না। বিপদের সময় কেউই সাহায্যে এগিয়ে আসে না। 

সার্কাসের প্যান্ডেলে হাসিখুশি থাকলেও তাঁদের বাস্তব জীবনটা অনেক কঠিন বলে জানান সার্কাসের শিল্পীরাগাইবান্ধার তরুণ শাহরিয়ার রহমান রিপন জানান, করোনার সময় খেয়ে-না খেয়ে জীবন কেটেছে। সরকার, সমিতি বা মালিক কেউই সাহায্য করেনি। এখন স্বাভাবিক অবস্থায় সারা বছরে কাজ থাকে সর্বোচ্চ ছয় মাস। তাঁদের জীবনের উন্নয়নের জন্য সরকারের বিশেষ গুরুত্বের দাবি করেন তিনি।

সার্কাসটির মালিক ও শিল্পীরা প্রণোদনা দিয়ে হলেও এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার দাবি জানান। অথবা পুনর্বাসনের মাধ্যমে সার্কাসের শিল্পীদের পেশা পরিবর্তনের সুযোগ দিতে হবে বলে মনে করেন তাঁরা।

অনুমতি প্রদানের জটিলতার বিষয়ে জানতে চাইলে শেরপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সানজিদা সুলতানা বলেন, ‘মেলায় সার্কাসের অনুমতি প্রদানে প্রশাসন সব সময় আন্তরিক। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সার্কাসের অনুমতি নিয়ে ভেতরে অশালীন নৃত্য পরিবেশন করা হয়। তাই সতর্কতা অবলম্বনের জন্যই শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া হয়।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত