Ajker Patrika

‘আমার ছেলেরে ফেরত দিয়া ওই লাশ তুইলে নিয়া যান’

বাগেরহাট প্রতিনিধি
আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০২৩, ২০: ০০
‘আমার ছেলেরে ফেরত দিয়া ওই লাশ তুইলে নিয়া যান’

‘ওই লাশ যদি আমার হিলটনের না হয়, তাহলে আমার ছেলের লাশ কই? আমার ছেলের লাশ আমারে দিয়া যান। তারপরে লাশ তুইলে নিয়া যান।’ হিলটন নাথ হিসেবে সমাহিত করা ব্যবসায়ী মাহে আলমের লাশ তোলার সময় এভাবে বিলাপ করছিলেন হিলটনের মা বীথিকা নাথ। 

আজ সোমবার বেলা ১১টায় পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী মোংলার চিলা গ্রাম থেকে মরদেহ তোলা হয়েছে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মোংলা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. হাবিবুর রহমান, সহকারী পুলিশ সুপার মুশফিকুর রহমান তুষার, মোংলা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সামসুদ্দিনসহ স্থানীয়রা। 

এ সময় ঘরের কোণে বসে কাঁদছিলেন বীথিকা নাথ। সরকারি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এত দিন ভাবিছি আমার তা (ছেলে) আমার কোলের ধারে রাইছে। এখন আমি কী করে থাকব। আমার বাবা রে...। আপনারা আমার বাবারে এইনে দেন।’ 

পুলিশ, পরিবার ও স্থানীয়রা বলছে, চলতি বছরের ৭ এপ্রিল সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান চিলা গ্রামের জেলে হিলটন নাথ (২০)। এর পর থেকেই নিখোঁজ তিনি। এর কয়েক দিন পর ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে সুন্দরবনের করমজল এলাকায় একটি অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার হয়। স্থানীয়দের মাধ্যমে হিলটন নাথের মা বীথিকা নাথ জানতে পারেন তাঁর ছেলের লাশ মিলেছে। পরে তাঁর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ এপ্রিল খুলনার দাকোপ থানা-পুলিশ বীথিকা নাথের কাছে হস্তান্তর করে লাশটি। 

হিলটন নাথের বাড়ি বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার চিলা গ্রামে। খ্রিষ্টধর্মীয় রীতি অনুযায়ী হিলটন ভেবে সেই লাশ বাড়িতে এনে সমাহিত করেন মা বীথিকা নাথ। 

তবে পরবর্তী ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে জানা যায় হিলটন হিসেবে সমাহিত হওয়া মরদেহটি মোংলা পৌর শহরের ব্যবসায়ী মাহে আলমের। ১০ এপ্রিল থেকে তিনিও নিখোঁজ ছিলেন। পরে তাঁর ছেলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ওই মরদেহ কবর থেকে তুলে মাহে আলমের পরিবারের কাছে বুঝিয়ে দিতে আদেশ দেন আদালত। সেই অনুযায়ী আজ সোমবার হিলটন নাথের বাড়িতে সমাহিত মাহে আলমের লাশ উত্তোলন করা হয়।

এদিকে হিলটন নাথকে বন বিভাগের লোকজন মেরেছিল দাবি করে বীথিকা নাথ বলেন, ‘আমার ছেলে জাল ধরতি গেইল। জাল ধরতি গেলি সেদিন ফরেস্টাররা মারিলো। মারলি গাঙ্গে (নদী) পড়িলো। আমার ছেলের সেই লাশ জোংড়ায় বলে ফরেস্টদের অফিসে বান্ধা ছিল। ফরেস্টাররা কী করিছে তা কতি পারি না। পরে করমজলে খুঁজে এই লাশ পাইছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এলাকার বেল্লাল, বেলায়েত জানতি পাইরে তারপরে করমজলের তে নিয়ে আইছে। আমার ছেলে হিসেবেই তো আমি দাফন দিছিলাম। যখন লাশ আনিছি, তহন তো কেউ বলেনি। লাশ নিয়ে সারা রাইত রইছি। কোর্টেতে বলে রায় দিয়ে, এই লাশ মাহে আলমের। তালি আমার ছেলে লাশ আইনে দেন।’ 

সোমবার হিলটন নাথ হিসেবে সমাহিত করা ব্যবসায়ী মাহে আলমের লাশ তোলা হয়। ছবি: আজকের পত্রিকাএদিকে হিলটন নাথের মায়ের অভিযোগের বিষয়ে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মাহাবুব হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘একজনকে মেরে বাকি তিনজনকে আদালতে তোলা সম্ভব? তাঁরা তো আদালতকে বলে দেবেন। কারও প্ররোচনায় তাঁরা মিথ্যা বলছেন।’

মাহাবুব হাসানের দাবি, বনে জলদস্যু ও অন্যদের অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে তিনি অভিযান শুরু করেছিলেন। ফলে একটি পক্ষ ষড়যন্ত্র করে তাঁকে চাঁদপাই থেকে সরানোর চেষ্টা করে। তারাই এ ঘটনা সাজিয়েছে।

তবে তারা কারা, সেই নাম জানাতে চাননি তিনি। এ ঘটনার পর সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ অফিস থেকে তাঁকে শরণখোলা রেঞ্জে বদলি করা হয়।

এ বিষয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. হাবিবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে লাশটি আসলে হিলটনের নয়, মাহে আলমের। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা মরদেহ তুলে তার সন্তানদের কাছে হস্তান্তর করেছি।’ 

হিলটনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে যেহেতু ধারণা করা হয়েছিল এটি হিলটন নাথের লাশ, সেহেতু তাঁর পরিবার একভাবে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করেছিল। এখন যেহেতু এটা প্রমাণিত হয়েছে এটা মাহে আলমের লাশ, সেহেতু হিলটন জীবিত না মৃত এ বিষয়ে আমরা কেউ নিশ্চিত নই। বিষয়টি নিয়ে খুলনা পিবিআই তদন্ত করছে। জীবিত বা মৃত; হিলটন যে অবস্থাতে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুঁজে বের করার জন্য চেষ্টা করছে।’

মামলা সূত্রে জানা যায়, হিলটন নাথ হত্যার বিষয়ে খুলনার দাকোপ থানায় এবং মাহে আলম নিখোঁজ বিষয়ে বাগেরহাটের মোংলা থানায় দুটি পৃথক মামলা হয়। যা এখন তদন্তাধীন রয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত