Ajker Patrika

‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’

মন্টি বৈষ্ণব, ঢাকা
আপডেট : ০২ মে ২০২২, ০০: ২৪
‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’

আজ মহান মে দিবস। সারা বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণি ও শ্রমজীবী মানুষের দীপ্ত সংগ্রামের দিন। মে দিবসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কর্মঘণ্টার সঙ্গে সঙ্গে ন্যায্য মজুরির প্রশ্ন। আট ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকশ্রেণি ১৮৮৬ সালে ইতিহাস বদলে দেওয়া আন্দোলন শুরু করেছিল। বীরত্বপূর্ণ সে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে রচিত হয়েছিল নতুন ইতিহাস। সময়ের সঙ্গে দিবসটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেলেও শ্রমিকেরা এখনো বিভিন্ন কারখানায় বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু পাচ্ছেন না। আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে নানাভাবে তাঁদের প্রাপ্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মাস শেষে শ্রমিকদের যে বেতন দেওয়া হয়, তাতে তাঁরা মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নিশ্চিত করতে পারেন না। 

প্রতিটি উৎসবের আগে তাই এখনো বাংলাদেশের শ্রমিকদের বেতন-ভাতার দাবিতে আন্দোলনে নামতে হয়। এটা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি বছর এমন ঘটনা বলে দেয়—এ দেশের শ্রমিক শ্রেণি নিয়ে কারও তেমন কোনো মাথা ব্যথা নেই। অথচ এই শ্রমিক শ্রেণির কারণে রাষ্ট্র বহাল তবিয়তে টিকে রয়েছে। এ দেশের শ্রমিকেরা রপ্তানিতে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ করেও পাচ্ছে সর্বনিম্ন মজুরি। যদিও সরকার ও মালিকপক্ষ থেকে বলা হয়, শ্রমিকেরা দেশের অর্থনীতির মূল হাতিয়ার। শ্রমিকের শ্রমে ও ঘামে বাড়ছে জাতীয় উৎপাদন। কিন্তু সে অনুপাতে তাদের মজুরি বাড়ছে না। এ যেন ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’। 

ঈদ আসন্ন। ঈদের আগে বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন প্যারাডাইস ক্যাবলস কারখানার শ্রমিকেরা। এ কারখানার শ্রমিক মো. রাসেল হোসেন বলছেন, ‘আমাদের ১১ মাস ১৫ দিনের বকেয়া বেতন বাকি। শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের সঙ্গে আমাদের মালিকপক্ষের কথা হয়েছে। মালিকের বক্তব্য হলো আমাদের এ কারখানা থেকে শতভাগ উৎপাদন হয় না। তাই বেসিকের ৬০ শতাংশ বোনাস দেওয়া হবে। আর ধীরে ধীরে বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে।’ 

এই হিসাব মানতে রাজি নন রাসেল। তাঁর দৃষ্টিতে এটা শ্রমিক ঠকানোর অজুহাত মাত্র। বললেন, ‘আসলে আমরা শ্রমিকেরা সব সময় অবহেলিত। প্যারাডাইস কেবলসের শ্রমিকেরা যে এ দেশে একমাত্র শোষিত শ্রমিক, তা কিন্তু নয়। আমরা তো দেখি দেশের বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিকেরা তাদের ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না। এসব কলকারখানার শ্রমিকেরা মালিক দ্বারা নির্যাতিত, শোষিত। আমরা যখন আমাদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে মাঠে নামি, তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালায়।’ 

কারখানায় কাজ করতে গেলে শ্রমিকদের যেমন বিভিন্ন নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়, তেমনি কারখানার মালিকদের জন্যও রয়েছে নিয়মকানুন। মালিকপক্ষ যেন নিজেদের স্বার্থে শ্রমিকদের নির্যাতন করতে না পারেন, সে বিষয়টিও আইনে আছে উল্লেখ করে রাসেল বলেন, ‘আমাদের মালিকেরা চার ভাই। তাদের নিজেদের সম্পত্তি ভাগাভাগির জন্য কোন্দল চলছে। আর এর প্রভাব পড়ছে আমাদের মতো শ্রমিকদের ওপর। তাদের কোন্দলের কারণে আমরা শ্রমিকেরা মাস শেষে বেতন পাচ্ছি না। বেতন না পেলে শ্রমিকদের অসহনীয়ভাবে জীবন চালাতে হয়। আমার ১৪ মাসের এক মেয়ে আছে। টাকার অভাবে তার চিকিৎসার খরচ দিতে পারছি না। আবার নিজেও ঠিকমতো পেট ভরে খেতে পারছি না। এ কষ্ট শুধু আমার নয়। এ দেশের হাজার হাজার শ্রমিক এ রকম দুঃখ-কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন।’ 

এবার একটু পরিসংখ্যানে নজর দেওয়া যাক। শিল্প পুলিশের এপ্রিল মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধ-সংক্রান্ত এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বিজিএমইএ ১৬১৫টি কারখানার মধ্যে বেতন পরিশোধ করা হয়েছে ৩৫টি কারখানায়। বকেয়া রয়েছে ১৫৮০টি কারখানায়। বিকেএমইএ ৬৮৫টি কারখানার মধ্যে বেতন পরিশোধ করা হয়েছে ৩১ টিতে; বকেয়া রয়েছে ৬৫৪টি কারখানা। বিটিএমএ ৩৩৮টি কারখানার মধ্যে বেতন পরিশোধ করা হয়েছে ৯ টিতে, বকেয়া রয়েছে ৩২৯ টির। বেপজা ৩৪৮টি কারখানার মধ্যে বেতন পরিশোধ করা হয়েছে ১০ টির, বকেয়া রয়েছে ৩৩৮ টির। পাটকলের ৮৩টি কারখানার মধ্যে বেতন পরিশোধ করা হয়েছে ৫৮ টির, বকেয়া রয়েছে ২৫ টির। অন্যান্য কারখানা মিলে মোট ৯১৭৬টি কারখানার মধ্যে মোট ১০২৫টি কারখানায় বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়েছে। বকেয়া রয়েছে ৮১৫১ টির বেতন-ভাতা। 

শ্রমিকদের পাওনা মজুরি পরিশোধের প্রসঙ্গে বিকেএমই-এর নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম বলেন, ‘আমরা সব কল-কারখানায় বকেয়া বেতন, বোনাস পরিশোধ করতে পারিনি। ব্যাংক খোলা আছে। আশা করছি ঈদের আগে শতভাগ কারখানার বকেয়া বেতন ও উৎসব ভাতা পরিশোধ করতে পারব। তবে কয়েকটা কারখানায় কিছু সমস্যা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সেখানে কারখানার বকেয়া বেতন পরিশোধ না করে মালিক পলাতক রয়েছে। আমরা মনে করি, কল-কারখানার যত সমস্যায়ই থাকুক না কেন, শ্রমিকদের বেতন, বোনাস দিয়ে দিতে হবে। আমরা এ বিষয়ে বিকল্প কোনো কথা শুনব না। শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা দিতে হবে।’ 

মো. হাতেম বলেন, ‘যেসব কারখানা নিয়মিত বেতন পরিশোধ করে না, সেসব কারখানা আমরা নজরদারিতে রেখেছি। এ ধরনের কারখানার মালিকদের সঙ্গে আমরা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। এসব কারখানার ক্ষেত্রে অনেক সময় কারখানার মেশিন বিক্রি করে হলেও শ্রমিকদের পাওনা টাকা পরিশোধ করার কথা বলে থাকি।’ 

সময়ের সঙ্গে মে দিবস রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পেলেও শ্রমিকেরা এখনো বিভিন্ন কারখানায় বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকু পাচ্ছেন না। ছবি: হাসান রাজাকিন্তু পরিসংখ্যান তো সে কথা বলছে না। অনেক সময়ই দেখা যায়, বেতন-ভাতা বকেয়া রেখে দিনের পর দিন সরকার ও মালিক পক্ষ আন্দোলনকারী শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যায়। মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ তেমন একটা দেখা যায় না। এ বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মন্টু ঘোষ বলেন, ‘গার্মেন্টস শিল্প এ দেশের অন্যতম প্রধান শিল্প খাত। এই খাতে প্রায় ৪০ লাখের বেশি নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। আবার এ খাতের রপ্তানির পরিমাণও অনেক বেশি। করোনাকালে এ শ্রমিকেরাই দেশের অর্থনীতি টিকেয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু এ গুরুত্বপূর্ণ শিল্প শ্রমিকদের মজুরি কম। মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন করলে মালিক পক্ষ চাকরিচ্যুতির ভয় দেখায়।’ 

ন্যায্য মজুরি না পাওয়ার তালিকায় শুধু গার্মেন্টস শ্রমিকেরাই নন। এ তালিকায় আছেন চা বাগানের শ্রমিকেরা। চা শিল্প এ দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প। চা শ্রমিকের জীবন ছেঁটে দেওয়া চা গাছের মতো। এখানকার শ্রমিকেরাও কাজ শেষে প্রাপ্য মজুরি পান না। এ বিষয়ে কথা হয় হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের লস্করপুর চা বাগানের চা শ্রমিক বীরেন কালিন্দীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়িতে আমি একজন শ্রমিক। আমার কর্ম দ্বারা আমার বাবা-মা, সন্তানকে খাওয়াতে হয়। সেই হিসাবে আমাদেরর চা শ্রমিকের মজুরি ৫০০ টাকা হওয়া উচিত। অথচ আমরা মজুরি পাই ১২০ টাকা। প্রতিদিন ২৩ কেজি চা পাতা তুলি। আবার প্রতিদিন যদি ২৩ কেজি চা পাতা তুলতে না পারি, তাহলে আবার টাকা কেটে রাখা হয়। নারী চা শ্রমিকদের জন্য আবার বাগানে শৌচাগারের কোনো ব্যবস্থা নেই। এখানকার নারী শ্রমিকেরা অনেক বেশি শোষিত। শোষণের কারণে আমাদের সন্তানেরা লেখাপড়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।’ 

বছর বছর একইভাবে শ্রমিক শোষণের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে শ্রমিক অধিকার আদায়ের দীর্ঘ লড়াই নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন। মে দিবসের আলোকে দেশে শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘মে দিবসের মূল তাৎপর্য ছিল ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবির অন্তরালে এমন একটা মজুরি, যা তার জীবন-জীবিকা নির্বাহে সহায় হবে এবং তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষা দেবে। এখন মে দিবসের ১৩৬ বছর পর যদি আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৮ ঘণ্টা কাজের মজুরি কাঠামোর দিকে দেখি, তাহলে দেখব ৮ ঘণ্টা শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা যায়—এমন কোনো মজুরি কাঠামো কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসে যে গার্মেন্টস খাত থেকে, সে খাতের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। এই খাতে আইন করে মালিকদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ আইন বলে মালিকেরা এই খাতের শ্রমিকদের এমনকি ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করিয়ে নিতে পারছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশে মজুরি পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ।’ 

শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কত হওয়া উচিত এবং কতগুলো কারখানায় এটি নিশ্চিত হয়েছে জানতে চাইলে রাজেকুজ্জামান বলেন, ‘শ্রমিকদের কতটুকু মজুরি হলে সেটা ন্যায্য হয়, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। এই বিষয়ে আমরা অন্তত বলতে চাই, সরকারের মজুরি ও উৎপাদনশীলতা কমিশনের পক্ষ থেকে ২০১৫ সালে নির্ধারণ করা হয়েছিল যে, পে স্কেলে সর্বনিম্ন মজুরি কত হবে এবং বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি কত হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শ্রমিকদের জন্য পে স্কেলে সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল বেসিক ৮ হাজার ২৫০ টাকা। আর মজুরি কমিশনের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল ৮ হাজার ৩০০ টাকা। ২০১৫ সালের ৮ হাজার ২৫০ টাকা বেসিক হলে সেটা বর্তমান সময়ের বাজার দর অনুযায়ী ২০২২ সালে ২০ হাজার টাকার ওপরে হয়। এখন কথা হলো সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন এ মজুরি বাংলাদেশের কোনো খাতে কি দেওয়া হয়? সরকার যে মজুরি নির্ধারণ করেছিল, তাও বৈষম্যমূলক ছিল। কিন্তু সে বৈষম্যমূলক মজুরিও যে বেসরকারি মালিকেরা দিচ্ছেন না, সে ব্যাপারে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। এই পলিসিই চলছে সবদিকে।’ 

রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘আমরা দেখছি সরকার নির্ধারিত মজুরি কমিশনের মজুরিও ৪৩টি খাতের জন্য গঠিত মজুরি বোর্ড কার্যকর করেনি। ৪৩টা সেক্টর মজুরি নির্ধারণ করার কথা শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতি ৫ বছর পরপর। এর মধ্যে প্রায় ২৯টা মতো সেক্টরে ২০১৩ সালের পর থেকে মজুরি নির্ধারণ করা হয়নি। সরকারের নীতি অনুযায়ী যদি প্রতি বছর ৬ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতি হয়, তাহলে ২০১৩ সাল থেকে সরল হিসাব করলেও গত ৮ বছরে অন্তত ৪৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। যার মানে হলো ২০১৩ সালে শ্রমিক ১০০ টাকায় যে জিনিস কিনতেন, তা এখন কিনছেন ১৪৮ টাকায়। করোনাকালে একদিকে শ্রমিক তার কাজ হারিয়েছে, অন্যদিকে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সবকিছুর দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে শ্রমিকের জীবনের সব ক্ষেত্রে। আমাদের শ্রমিকদের আয়ের প্রায় ৬২ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্যপণ্য ক্রয়ের পেছনে। ফলে মজুরি কমলে তার পরিবারে খাদ্য সংকট দেখা দেবে, যা শুধু তার নয়, তার পরবর্তী প্রজন্মের পুষ্টি নিরাপত্তায়ও প্রভাব ফেলছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টা হতে চেয়েছিলেন আসিফ নজরুল: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী

শিক্ষার্থীদের অর্থ আত্মসাৎ: বিএসবির খায়রুল বাশারকে আদালতে মারধর

বামপন্থীদের ‘মেরে ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে চান ডাকসু নেতা সর্বমিত্র, অভিযোগ ঢাবি শিক্ষার্থীর

পরীক্ষায় অটো পাসের মতো কোনো বিষয় তো সংবিধানে থাকতে পারে না: সালাহউদ্দিন আহমদ

জোটের প্রার্থীদের ইচ্ছেমতো প্রতীক চেয়ে আইন উপদেষ্টাকে বিএনপির লিখিত আবেদন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কুয়াকাটায় রিসোর্ট প্রকল্প: বিসিসির বিলাসী প্রকল্প নিয়ে ক্ষোভ নগরবাসীর

  • শুধু জমি কিনতেই ব্যয় হবে শতকোটি টাকা।
  • প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আয় বাড়বে, দাবি বিসিসির।
  • নাগরিক সমস্যা সমাধানের তাগিদ স্থানীয়দের।
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল
বৃষ্টি উপেক্ষা করে সৈকতে অনেকে সমুদ্রস্নান করছেন, আবার অনেকে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠেছেন। ছবি: আজকের পত্রিকা
বৃষ্টি উপেক্ষা করে সৈকতে অনেকে সমুদ্রস্নান করছেন, আবার অনেকে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠেছেন। ছবি: আজকের পত্রিকা

পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় জমি কিনে রিসোর্ট করার পরিকল্পনা নিয়েছে বরিশাল সিটি করপোরেশন (বিসিসি)। জমি কিনতে এরই মধ্যে দরপত্র গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে শতকোটি টাকার বেশি। নগরবাসী যেখানে নানাবিধ নাগরিক সমস্যায় জর্জরিত, সেখানে বিপুল অর্থ ব্যয়ে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ নগরবাসী। যদিও বিসিসির প্রধান নির্বাহীর দাবি, এতে করে সিটি করপোরেশনের আয় বাড়বে।

বিসিসি জমি কেনার দরপত্র আহ্বান করে ১৯ অক্টোবর। এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সৈকতের কাছাকাছি সড়কের পাশে কমপক্ষে ৩ একর জমি কেনা হবে। আগ্রহী জমিমালিকদের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ৭ দিনের মধ্যে আবেদন করার আহ্বান জানানো হয়।

বিসিসির সম্পত্তি কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান শাকিল জানিয়েছেন, মাসিক সভায় রিসোর্ট করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। দরপত্র অনুযায়ী, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৩টি আবেদন জমা পড়েছে। তার মধ্যে একটিতে ৮ একর এবং অন্য দুটিতে ৬ একর করে জমি রয়েছে। বিসিসি ৮ একরের জমিটির প্রতি আগ্রহী।

কুয়াকাটায় জমি কেনাবেচার সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থানীয় বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ। তিনি জানান, সৈকত থেকে আধা কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে সড়কের পাশে প্রতি শতাংশ জমি গড়ে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে ১ একরের দাম হবে ১৫ কোটি টাকা। বিসিসি ৮ একর কিনলে দাম পড়বে ১২০ কোটি টাকা। আধা কিলোমিটারের বাইরে পৌর এলাকার মধ্যে প্রতি শতাংশ বিক্রি হয় ১০ লাখ টাকায়। সে ক্ষেত্রে ১ একরের দাম ১০ কোটি এবং ৮ একরের দাম ৮০ কোটি টাকা।

কুয়াকাটায় জমি কিনে রিসোর্ট করার বিসিসির সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন নগরবাসী। বরিশাল জেলা বাম গণতান্ত্রিক জোটের এক বিবৃতিতে বলা হয়, সিটি করপোরেশন পানি শোধনাগার চালুর উদ্যোগসহ সার্বিক জনবান্ধব উন্নয়নের উদ্যোগ না নিয়ে কুয়াকাটায় জমি কিনছে, অথচ বরিশালে কোনো আধুনিক বর্জ্যব্যবস্থাপনা নেই।

নগরীর ময়লাখোলায় শহরের মধ্যে ৫৮ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে খোলা জায়গায় বর্জ্য ফেলা হয়। অচল হয়ে থাকা দুটি পানি শোধনাগার আজ পর্যন্ত চালু হয়নি। বহু রাস্তাঘাট-ড্রেন সংস্কার করা হয়নি। এসব বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া অতি জরুরি হলেও বাজেট ঘাটতির কথা বলে কোনো কাজ করা হচ্ছে না।

বাম গণতান্ত্রিক জোট বলছে, নগরীর যখন এ বেহাল দশা তার মধ্যেই ১৯ অক্টোবর কুয়াকাটায় জমি কেনার বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে সিটি করপোরেশন। তারা নিজেদের সীমানার বাইরে জমি কিনতে চাইলে সরকারের পূর্বানুমোদনের প্রয়োজন হয়। অথচ এটি নেওয়া হয়েছে কি না, তা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়নি।

নগরবাসী বলছেন, নগর উন্নয়নে বরাদ্দ না দিয়ে কুয়াকাটায় বিলাসবহুল রিসোর্ট নির্মাণের জন্য জমি কেনার বিজ্ঞাপন জনগণের প্রতি দায়হীনতার পরিচয় বহন করে। সিটি করপোরেশনকে অবিলম্বে বিলাসিতা ও অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে কুয়াকাটায় জমি কেনার মতো প্রকল্প থেকে সরে আসতে হবে।

স্থানীয় বাসিন্দা কাজী মিজানুর রহমান বলেন, ‘সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সমস্যা আছে। নগরীতে এত সংকট। তার মধ্যে কী করে তারা কুয়াকাটায় রিসোর্ট স্থাপনের মতো উচ্চবিলাসী প্রকল্পের কথা চিন্তা করে। নগরী থেকে যানজট দূর করতে বাস টার্মিনাল অপসারণ করতে পারছে না, যথাযথ বর্জ্যব্যবস্থাপনা নেই, পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট নেই। নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা না করে বিলাসিতার জন্য রিসোর্ট করতে চাইছে। আশা করি, তারা এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। পারলে প্রয়োজনে নগরীতে পাঁচতলাবিশিষ্ট হোটেল করুক।’

জেলা বাসদের সদস্যসচিব মনীষা চক্রবর্তী বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের সময় একজন প্রশাসক এভাবে বিপুল অর্থ খরচ করে কুয়াকাটায় রিসোর্ট করতে পারেন না। দেশের এত আর্থিক সংকটের মধ্যে সরকার এ ধরনের বিলাসী প্রকল্প হাতে নিতে বিসিসিকে অনুমতি দিয়েছে কি না, তাও স্পষ্ট করেনি কর্তৃপক্ষ। আমরা এ ধরনের প্রকল্প চাই না।’

এসব সমালোচনার সঙ্গে একমত নন বিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারী। তিনি বলেন, কুয়াকাটায় রিসোর্ট করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের দাবি। গত ২০ মার্চ পরিষদের মাসিক সাধারণ সভায় সেখানে জমি কেনার সিদ্ধান্ত অনুমোদন হয়। তাই কমপক্ষে ৩ একর জমি কেনার জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। রিসোর্ট ভাড়া দিলে বিসিসির আয় বাড়বে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টা হতে চেয়েছিলেন আসিফ নজরুল: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী

শিক্ষার্থীদের অর্থ আত্মসাৎ: বিএসবির খায়রুল বাশারকে আদালতে মারধর

বামপন্থীদের ‘মেরে ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে চান ডাকসু নেতা সর্বমিত্র, অভিযোগ ঢাবি শিক্ষার্থীর

পরীক্ষায় অটো পাসের মতো কোনো বিষয় তো সংবিধানে থাকতে পারে না: সালাহউদ্দিন আহমদ

জোটের প্রার্থীদের ইচ্ছেমতো প্রতীক চেয়ে আইন উপদেষ্টাকে বিএনপির লিখিত আবেদন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ফটিকছড়ি: টিলা কেটে সাবাড় বিএনপির নেতার

  • ইউনিয়ন বিএনপির এক নেতার নেতৃত্বে রাতে শ্রমিক দিয়ে মাটি কেটে বিক্রির অভিযোগ।
  • মাটি কাটার সময় চাপা পড়ে শ্রমিক নিহত।
নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ও ফটিকছড়ি সংবাদদাতা
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির দাঁতমারা ইউনিয়নের বালুখালী চামাঘোনা এলাকায় টিলা কেটে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে। আজকের পত্রিকা
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির দাঁতমারা ইউনিয়নের বালুখালী চামাঘোনা এলাকায় টিলা কেটে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে। আজকের পত্রিকা

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার দাঁতমারা ইউনিয়নে রাজনৈতিক প্রভাবে অবৈধভাবে চলছে টিলা কেটে মাটি বিক্রির মচ্ছব। স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপির এক নেতা এ মাটি কাটার কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে টিলা কেটে মাটি বিক্রি চললেও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সরেজমিনে জানা গেছে, দাঁতমারা ইউনিয়নের সোনারখিল মৌজার অধীন বালুখালী চামাঘোনা মনাইয়ার দোকান এলাকায় ইউনিয়ন বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক মামুনুর রশিদ মামুনের নেতৃত্বে টিলা কাটার কার্যক্রম চলছে। মামুন ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিউল আজম চৌধুরীর অনুসারী বলে জানা গেছে। টিলার মাটি ট্রাকে করে নেওয়া হচ্ছে স্থানীয় ব্যবসায়ী শাহাদাত হোসেন ওরফে ভাগনে শাহাদাত ও গাছ ব্যবসায়ী মিয়া সওদাগরের ফসলি জমি ও বাড়ি ভরাটের কাজে।

গত রোববার সন্ধ্যায় টিলা কাটার সময় মাটিচাপা পড়ে মো. আরিফ (২০) নামের এক শ্রমিক নিহত হন। এরপরই এলাকাবাসী অবৈধভাবে টিলা কাটার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।

অভিযোগের বিষয়ে মামুনুর রশিদ মামুন বলেন, ‘আমি টিলা কাটার সঙ্গে জড়িত নই। ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিউল আজম চৌধুরীর সঙ্গে রাজনীতি করার কারণে একটি গোষ্ঠী হীনস্বার্থে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’

তবে স্থানীয়রা জানান, সিরাজ ও মামুনসহ একটি চক্র রাতে শ্রমিক দিয়ে নিয়মিত টিলা কেটে মাটি পাচার করছে। স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে টিলা উজাড় করা হয়।

অভিযোগ অস্বীকার করে শফিউল আজম চৌধুরী বলেন, ‘দাঁতমারার বিভিন্ন স্থানে রাতের আঁধারে কারা মাটি কাটছে, তা আমার জানা নেই। আমি রাজনীতি ও চা-বাগান নিয়ে ব্যস্ত। মাটি কাটার সঙ্গে জড়িত নই।’

এদিকে রোববার সন্ধ্যায় শ্রমিকেরা টিলা কাটার সময় একাংশ ধসে পড়ে। এতে চাপা পড়ে শ্রমিক মো. আরিফ ঘটনাস্থলেই মারা যান। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপির নেতা মামুন প্রশাসনকে না জানিয়ে লাশ উদ্ধার করে ১০ কিলোমিটার দূরে নিহতের বাড়িতে নিয়ে যান। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে ও নিহতের বাড়িতে গেলেও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য পারভেজ তাঁদের বাধা দেন। পরিবারকে টাকাপয়সা দিয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মামুনের লাশ দাফন করা হয়।

ইউপি সদস্য পারভেজ বিষয়টি ‘অপপ্রচার’ দাবি করে বলেন, ‘আমি জনপ্রতিনিধি হয়ে পুলিশকে বাধা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। নিহতের পরিবারের অভিযোগ না থাকায় ময়নাতদন্ত না করতে সহায়তা করেছি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার পাইন্দং ইউনিয়নের আমতল ও রাবারবাগান এবং দাঁতমারা ও বাগানবাজার ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতি রাতে চলছে টিলা ও পাহাড় কেটে মাটি বিক্রির মচ্ছব। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খননযন্ত্র ও ট্রাকের বিকট শব্দে এসব এলাকার মানুষের ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটছে।

দাঁতমারা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি বোরহানউদ্দিন বলেন, বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত কেউ পাহাড় বা টিলা কাটার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না। কেউ জড়িত থাকলে সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি আমরা জেনেছি। পরিবেশ অধিদপ্তরকেও জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের গবেষণা কর্মকর্তা মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত টিলাগুলো পরিদর্শন করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টা হতে চেয়েছিলেন আসিফ নজরুল: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী

শিক্ষার্থীদের অর্থ আত্মসাৎ: বিএসবির খায়রুল বাশারকে আদালতে মারধর

বামপন্থীদের ‘মেরে ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে চান ডাকসু নেতা সর্বমিত্র, অভিযোগ ঢাবি শিক্ষার্থীর

পরীক্ষায় অটো পাসের মতো কোনো বিষয় তো সংবিধানে থাকতে পারে না: সালাহউদ্দিন আহমদ

জোটের প্রার্থীদের ইচ্ছেমতো প্রতীক চেয়ে আইন উপদেষ্টাকে বিএনপির লিখিত আবেদন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

রাজশাহী-পাবনা-কুষ্টিয়া: পদ্মা চরের আতঙ্ক কাঁকন বাহিনী

  • দখল-চাঁদাবাজি আর হামলার কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ৫ উপজেলার মানুষ।
  • গত সোমবারও রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পদ্মা নদীর চর দখলকে কেন্দ্র করে গুলি চালিয়েছে তাঁরা।
  • বারবার অভিযান চালিয়েও বাহিনীর প্রধানের হদিস পায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
 রিমন রহমান, রাজশাহী
রাজশাহী-পাবনা-কুষ্টিয়া: পদ্মা চরের আতঙ্ক কাঁকন বাহিনী

রাজশাহী, পাবনা ও কুষ্টিয়ার পদ্মার চরে এখন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম কাঁকন বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যদের বালুমহাল দখল, চরদখল আর চাঁদাবাজির কারণে অতিষ্ঠ কয়েকটি উপজেলার মানুষ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বারবার অভিযান চালিয়েও একাধিক মামলার আসামি সন্ত্রাসী কাঁকনের হদিস পায়নি। তাই এই বাহিনীর সদস্যরা একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

সর্বশেষ গত সোমবার রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পদ্মা নদীর চর দখলকে কেন্দ্র করে কাঁকন বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। এতে দুজন নিহত হন। গতকাল মঙ্গলবার পদ্মা নদীতে আরেকজনের ভাসমান লাশ পাওয়া যায়। এই ব্যক্তি কাঁকন বাহিনীর সদস্য বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। নদীর ওপারেও বাঘা উপজেলার একটি ইউনিয়ন আছে। আর তার পাশেই কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা। পদ্মা নদীর পাড়ে বাঘা উপজেলার পূর্বে নাটোরের লালপুর, ঈশ্বরদী ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলা। এই পাঁচ উপজেলার পদ্মা নদীর চরে প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরেই একক আধিপত্য কাঁকন বাহিনীর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাহিনীর প্রধান মো. কাঁকনের বয়স ৫০-৫৫ বছর। তাঁর আদি বাড়ি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের রায়চা গ্রামে। বাবার নাম মৃত জমির উদ্দিন। তিনি একজন স্বাস্থ্য সহকারী ছিলেন। কাঁকন ১৯৯৪ সালে সিভিল বিষয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন। এরপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। ২০০৭ সালে তিনি সৌদি আরবে চলে যান। কয়েক বছর পর ফিরে এসে আওয়ামী লীগের নেতাদের আশ্রয়ে এলাকার বালুমহালগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে শুরু করেন। এই বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েই তিনি গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। এখন এই বাহিনীর সদস্য প্রায় ৪০ জন।

এর মধ্যে পদ্মার দুর্গম চরে ৮-১০ জন অস্ত্রধারী সদস্য সব সময় কাঁকনের সঙ্গেই থাকেন। বাকিরা দৌলতপুর, ভেড়ামারা, ঈশ্বরদী ও লালপুর এলাকায় থেকে বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করেন। বালুমহাল থেকে চাঁদা তোলা তাঁদের কাজ। বালুমহাল থেকে চাঁদা দেওয়া না হলে তাঁরা মাঝপদ্মায় বালু তুলতে যাওয়া নৌযানগুলো আটকে রাখেন। এ কারণে কাঁকন বাহিনীকে চাঁদা দিতে বাধ্য হন বালু ব্যবসায়ীরা। কাঁকন নিজেও বালুমহাল ইজারা নেন।

কাঁকন বাহিনীর এক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাঁকনের নানিবাড়ির দৌলতপুরের মরিচা ইউনিয়নের বৈরাগীর চরে। এ এলাকা থেকেও কিছু তরুণকে নিজের বাহিনীতে ভিড়িয়েছেন তিনি। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মশুরিয়াপাড়া গ্রামেও কাঁকনের একটি বাড়ি আছে। মাঝেমধ্যে তিনি এ বাড়িতে যাতায়াত করেন। তবে এলাকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে মাঝেমধ্যেই আশ্রয় নেন দুর্গম চরে। সব সময় থাকেন সশস্ত্র অবস্থায়। পদ্মা নদী শাসনে দাপিয়ে বেড়ানোর জন্য কাঁকনের রয়েছে ব্যক্তিগত স্পিডবোট।

জানা গেছে, কাঁকন বাহিনীর সদস্যরা খুবই বেপরোয়া। তাঁরা কথায় কথায় গোলাগুলি করেন। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আওয়ামীঘনিষ্ঠ কাঁকনের আস্ফালন কমবে বলে ধারণা করেছিলেন এলাকার লোকজন। কিন্তু ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে তাঁর দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে গেছে। তাঁরা পদ্মা নদীর বিস্তীর্ণ চর আর চরের খড়ের সবই নিজেদের বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে সবসময় আলোচনায় থাকলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার কাঁকন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বারবার অভিযান চালালেও তাঁর টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। তবে বাহিনীর কয়েকজন ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

এর মধ্যে ঈশ্বরদীর বালুমহালে গোলাগুলির ঘটনায় গত ১১ জুন ঈশ্বরদী থানা-পুলিশ নদীতে অভিযান চালিয়ে দুটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ কাঁকন বাহিনীর সদস্য ইয়াছিন আলী, সোনারুল, হবি মণ্ডল, সাগর প্রামাণিক, সোহেল প্রামাণিক ও মিরাজ প্রামাণিক নামের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। অভিযানে বালুবোঝাই বাল্কহেডের ইঞ্জিন রুমের ভেতর থেকে একটি ওয়ান শুটারগান, ৪টি তাজা ১২ বোরের কার্তুজ এবং ট্রলারে বিছানো তোশকের নিচ থেকে একটি ক্যালিবার ২২ রিভলবার এবং ২২ বোরের ৪টি গুলি উদ্ধার করা হয়।

কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান বলেন, ‘কাঁকনের নামে কয়েকটি বালুমহালকেন্দ্রিক মামলা রয়েছে। আমরাও তার নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কথা শুনছি।’ তিনি বলেন, ‘রাজশাহী, নাটোর ও পাবনা পড়েছে পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জে। আর কুষ্টিয়া রয়েছে খুলনা রেঞ্জে। এই চার জেলার পদ্মা নদী ও চরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করতে আমরা সম্প্রতি দুই রেঞ্জ যৌথসভা করেছি। আশা করছি আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করে এটা বন্ধ করতে পারব।’

নাটোরের এসপি মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) খন্দকার মো. শামীম হোসেন বলেন, সংশ্লিষ্ট জেলার এসপিরা এ বিষয়ে কাজ করছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টা হতে চেয়েছিলেন আসিফ নজরুল: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী

শিক্ষার্থীদের অর্থ আত্মসাৎ: বিএসবির খায়রুল বাশারকে আদালতে মারধর

বামপন্থীদের ‘মেরে ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে চান ডাকসু নেতা সর্বমিত্র, অভিযোগ ঢাবি শিক্ষার্থীর

পরীক্ষায় অটো পাসের মতো কোনো বিষয় তো সংবিধানে থাকতে পারে না: সালাহউদ্দিন আহমদ

জোটের প্রার্থীদের ইচ্ছেমতো প্রতীক চেয়ে আইন উপদেষ্টাকে বিএনপির লিখিত আবেদন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

রাজশাহী-পাবনা-কুষ্টিয়া

পদ্মায় চরের আতঙ্ক কাঁকন বাহিনী

  • দখল-চাঁদাবাজি আর হামলার কারণে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে ৫ উপজেলার মানুষ।
  • গত সোমবারও রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পদ্মা নদীর চর দখলকে কেন্দ্র করে গুলি চালিয়েছে তাঁরা।
  • বারবার অভিযান চালিয়েও বাহিনীর প্রধানের হদিস পায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
  • বাহিনীর প্রধান মো. কাঁকনের বয়স ৫০-৫৫ বছর, তাঁর আদি বাড়ি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায়।
 রিমন রহমান, রাজশাহী
মো. কাঁকন। ছবি: সংগৃহীত
মো. কাঁকন। ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহী, পাবনা ও কুষ্টিয়ার পদ্মার চরে এখন মূর্তিমান আতঙ্কের নাম কাঁকন বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যদের বালুমহাল দখল, চরদখল আর চাঁদাবাজির কারণে অতিষ্ঠ কয়েকটি উপজেলার মানুষ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বারবার অভিযান চালিয়েও একাধিক মামলার আসামি সন্ত্রাসী কাঁকনের হদিস পায়নি। তাই এই বাহিনীর সদস্যরা একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

সর্বশেষ গত সোমবার রাজশাহীর বাঘা উপজেলার পদ্মা নদীর চর দখলকে কেন্দ্র করে কাঁকন বাহিনীর সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে। এতে দুজন নিহত হন। গতকাল মঙ্গলবার পদ্মা নদীতে আরেকজনের ভাসমান লাশ পাওয়া যায়। এই ব্যক্তি কাঁকন বাহিনীর সদস্য বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার দক্ষিণ পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পদ্মা নদী। নদীর ওপারেও বাঘা উপজেলার একটি ইউনিয়ন আছে। আর তার পাশেই কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা। পদ্মা নদীর পাড়ে বাঘা উপজেলার পূর্বে নাটোরের লালপুর, ঈশ্বরদী ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলা। এই পাঁচ উপজেলার পদ্মা নদীর চরে প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরেই একক আধিপত্য কাঁকন বাহিনীর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাহিনীর প্রধান মো. কাঁকনের বয়স ৫০-৫৫ বছর। তাঁর আদি বাড়ি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের রায়চা গ্রামে। বাবার নাম মৃত জমির উদ্দিন। তিনি একজন স্বাস্থ্য সহকারী ছিলেন। কাঁকন ১৯৯৪ সালে সিভিল বিষয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন। এরপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। ২০০৭ সালে তিনি সৌদি আরবে চলে যান। কয়েক বছর পর ফিরে এসে আওয়ামী লীগের নেতাদের আশ্রয়ে এলাকার বালুমহালগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে শুরু করেন। এই বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েই তিনি গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। এখন এই বাহিনীর সদস্য প্রায় ৪০ জন।

এর মধ্যে পদ্মার দুর্গম চরে ৮-১০ জন অস্ত্রধারী সদস্য সব সময় কাঁকনের সঙ্গেই থাকেন। বাকিরা দৌলতপুর, ভেড়ামারা, ঈশ্বরদী ও লালপুর এলাকায় থেকে বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ করেন। বালুমহাল থেকে চাঁদা তোলা তাঁদের কাজ। বালুমহাল থেকে চাঁদা দেওয়া না হলে তাঁরা মাঝপদ্মায় বালু তুলতে যাওয়া নৌযানগুলো আটকে রাখেন। এ কারণে কাঁকন বাহিনীকে চাঁদা দিতে বাধ্য হন বালু ব্যবসায়ীরা। কাঁকন নিজেও বালুমহাল ইজারা নেন।

কাঁকন বাহিনীর এক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাঁকনের নানিবাড়ির দৌলতপুরের মরিচা ইউনিয়নের বৈরাগীর চরে। এ এলাকা থেকেও কিছু তরুণকে নিজের বাহিনীতে ভিড়িয়েছেন তিনি। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মশুরিয়াপাড়া গ্রামেও কাঁকনের একটি বাড়ি আছে। মাঝেমধ্যে তিনি এ বাড়িতে যাতায়াত করেন। তবে এলাকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে মাঝেমধ্যেই আশ্রয় নেন দুর্গম চরে। সব সময় থাকেন সশস্ত্র অবস্থায়। পদ্মা নদী শাসনে দাপিয়ে বেড়ানোর জন্য কাঁকনের রয়েছে ব্যক্তিগত স্পিডবোট।

কথায় কথায় গুলি

জানা গেছে, কাঁকন বাহিনীর সদস্যরা খুবই বেপরোয়া। তাঁরা কথায় কথায় গোলাগুলি করেন। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আওয়ামীঘনিষ্ঠ কাঁকনের আস্ফালন কমবে বলে ধারণা করেছিলেন এলাকার লোকজন। কিন্তু ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে তাঁর দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে গেছে। তাঁরা পদ্মা নদীর বিস্তীর্ণ চর আর চরের খড়ের সবই নিজেদের বলে ঘোষণা দিয়েছেন।

সোমবার দুপুরে বাঘার চরাঞ্চলের নীচ খানপুর গ্রামের কিছু ব্যক্তি চরে খড় কাটতে যান। এতে বাধা দেন কাঁকন বাহিনীর সন্ত্রাসীরা। তখন কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে গুলি ছোড়া হয়। নীচ খানপুর গ্রামের বেলাল হোসেন জানান, তাঁরা খড় কাটা শুরু করলে কাঁকন বাহিনীর লোকজন গিয়ে বাধা দেন। এরপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকেন।

এতে আমান মণ্ডল, মুনতাজ মণ্ডল, নাজমুল মণ্ডল ও রাবিক হোসেন নামের চারজন গুলিবিদ্ধ হন। এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ার কারণে প্রথমে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করা যায়নি। পরে লোকজন গেলে কাঁকন বাহিনীর সদস্যরা সরে যান। আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এ ঘটনায় আমান মণ্ডল ও নাজমুল মণ্ডল মারা যান। বারিক ও মুনতাজ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

বাঘা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) সুপ্রভাত মণ্ডল জানান, গতকাল ভেড়ামারা এলাকায় পদ্মা নদীর চরে আটকে থাকা এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া গেছে। তাঁর নাম মো. লিটন। তাঁর বাড়িও ভেড়ামারায়। তাঁর শরীরে ধারালো অস্ত্রের আঘাত পাওয়া গেছে। ঈশ্বরদীর লক্ষ্মীকুণ্ডা নৌ পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা তাঁর লাশ উদ্ধার করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, লিটন কাঁকন বাহিনীর সদস্য ছিলেন। গোলাগুলির সময় তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে এ বিষয়টি পুলিশ পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেনি। গোলাগুলির ঘটনায় কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানায় মামলা করা হবে বলেও জানান তিনি।

দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোলায়মান শেখ জানান, মামলার পর এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাঁকন বাহিনীর সদস্যরা মাঝেমধ্যেই এলাকায় গোলাগুলি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। গত ৫ জুন ঈশ্বরদী উপজেলার সাড়াঘাটে বালুমহলের নিয়ন্ত্রণ নিতে ফিল্মি স্টাইলে অস্ত্রের মহড়া ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটান কাঁকন বাহিনীর সদস্যরা। সেদিন তাঁরা ট্রাক, পেলোডার, মোটরসাইকেল এবং বালু বিক্রির অফিসে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেন। ওই ঘর থেকে তাঁরা টাকাও লুট করেন।

ঈশ্বরদী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সদস্যসচিব মেহেদী হাসান জানান, বামনগাঁ নৌকা পারাপার ও সাড়া রানাখড়িয়া মহাল ঘাটের ইজারাদার তিনি। ঘাটের বৈধ ইজারাদার হওয়ার পরও কাঁকন বাহিনীকে চাঁদা না দেওয়ায় কাজ করতে পারছিলেন না। তাঁরা গোলাগুলি করে বালুমহালটিই দখল করে নিয়েছিলেন। কাঁকন বাহিনীর ভয়ে এলাকার জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে যেতে পারেন না। কৃষকেরা চরের জমিতে চাষাবাদ করতে পারেন না। ৬ অক্টোবরও তাদের লোকজনের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। এতে দুজন গুলিবিদ্ধ হন। এই হামলার সঙ্গেও কাঁকন বাহিনী জড়িত বলে তিনি ধারণা করেন।

এর আগে ৫ মে দিনদুপুরে নদীপথে স্পিডবোট ও ট্রলারে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে কাঁকন বাহিনী। ৯ জুন সাড়া ইসলামপাড়া বালুঘাটের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চার যুবলীগ কর্মীকে নৌকাসহ তুলে নিয়ে বেধড়ক মারধর ও কুপিয়ে জখম করার অভিযোগ ওঠে কাঁকন বাহিনীর বিরুদ্ধে। সেদিন নিজেই গিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার কাঁকন। চার যুবলীগ কর্মীকে কাঁকন তাদের স্পিডবোটে উঠিয়ে লালপুর প্রান্তের নদীর চরে নিয়ে বেদম মারধর ও কুপিয়ে জখম করেন। পরে রবু নামের একজনকে মৃত ভেবে পদ্মার চরে ফেলে রেখে যান। খবর পেয়ে নৌ পুলিশ ও বালুঘাটের অন্যা বালু ব্যবসায়ীরা চারজনকে উদ্ধার করেন।

১২ জুলাই দুপুরে কাঁকন বাহিনীর সন্ত্রাসীরা স্পিডবোট নিয়ে গিয়ে ঈশ্বরদীর যুবদল নেতা টনি বিশ্বাসের বালুবোঝাই নৌকা থেকে চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দিলে তাঁরা ঘাটে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করেন। এতে সোহান হোসেন নামের স্থানীয় এক কৃষক গুলিবিদ্ধ হন। পদ্মা নদী ও চরে একক আধিপত্য বিস্তারে এভাবে যখন-তখন গোলাগুলি করে কাঁকন বাহিনী।

ধরাছোঁয়ার বাইরে কাঁকন

একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে সবসময় আলোচনায় থাকলেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার কাঁকন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বারবার অভিযান চালালেও তাঁর টিকিটিও ছুঁতে পারেনি। তবে বাহিনীর কয়েকজন ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

এর মধ্যে ঈশ্বরদীর বালুমহালে গোলাগুলির ঘটনায় গত ১১ জুন ঈশ্বরদী থানা-পুলিশ নদীতে অভিযান চালিয়ে দুটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ কাঁকন বাহিনীর সদস্য ইয়াছিন আলী, সোনারুল, হবি মণ্ডল, সাগর প্রামাণিক, সোহেল প্রামাণিক ও মিরাজ প্রামাণিক নামের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। অভিযানে বালুবোঝাই বাল্কহেডের ইঞ্জিন রুমের ভেতর থেকে একটি ওয়ান শুটারগান,৪টি তাজা ১২ বোরের কার্তুজ এবং ট্রলারে বিছানো তোশকের নিচ থেকে একটি ক্যালিবার ২২ রিভলবার এবং ২২ বোরের ৪টি গুলি উদ্ধার করা হয়।

গত ১৭ জুলাই ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ঈশ্বরদীর সাড়াঘাট ও লালপুরের দিয়ার বাহাদুরপুর এলাকায় অভিযান চালান সেনাবাহিনীর পাবনা ও নাটোর ক্যাম্পের সদস্যরা। অভিযানে কাঁকনের ভায়রা ভাই মেহেফুজ সোহাগ, বাহিনীর সদস্য আশরাফুল ইসলাম বাপ্পি ও রোকেয়া খাতুন নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে তিনটি বিদেশি অস্ত্র, গোলাবারুদ, মাদকদ্রব্য, একটি মাথার খুলি ও প্রায় ১২ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়াও চাঁদাবাজি ও অবৈধ বালুমহালের টাকার ভাগবাঁটোয়ারার তালিকাও উদ্ধার করা হয়। তবে এসব অভিযানে পাওয়া যায়নি কাঁকনকে। তিনি এখনো রয়েছেন আত্মগোপনে। কথা বলার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেও কাঁকনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

পুলিশ যা বলছে

কাঁকনের বিষয়ে জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) মিজানুর রহমান বলেন, ‘কাঁকনের নামে কয়েকটি বালুমহালকেন্দ্রিক মামলা রয়েছে। আমরাও তার নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কথা শুনছি। কিন্তু কেউ এসে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করে না। আমরা এটা নিয়ে কাজ করেছি।’ তিনি বলেন, ‘রাজশাহী, নাটোর ও পাবনা পড়েছে পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জে। আর কুষ্টিয়া রয়েছে খুলনা রেঞ্জে। এই চার জেলার পদ্মা নদী ও চরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ করতে আমরা সম্প্রতি দুই রেঞ্জ যৌথসভা করেছি। আশা করছি আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করে এটা বন্ধ করতে পারব।’

নাটোরের এসপি মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট) খন্দকার মো. শামীম হোসেন বলেন, সংশ্লিষ্ট জেলার এসপিরা এ বিষয়ে কাজ করছেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টা হতে চেয়েছিলেন আসিফ নজরুল: নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী

শিক্ষার্থীদের অর্থ আত্মসাৎ: বিএসবির খায়রুল বাশারকে আদালতে মারধর

বামপন্থীদের ‘মেরে ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে চান ডাকসু নেতা সর্বমিত্র, অভিযোগ ঢাবি শিক্ষার্থীর

পরীক্ষায় অটো পাসের মতো কোনো বিষয় তো সংবিধানে থাকতে পারে না: সালাহউদ্দিন আহমদ

জোটের প্রার্থীদের ইচ্ছেমতো প্রতীক চেয়ে আইন উপদেষ্টাকে বিএনপির লিখিত আবেদন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত