Ajker Patrika

মিরপুরে আগুন: কাজে গিয়ে পুড়ে লাশ ১৬ জন

  • একসঙ্গে স্তূপ হয়ে ছিল ৯ লাশ, নারী-পুরুষ বোঝার উপায় নেই।
  • ডিএনএ পরীক্ষার পর মরদেহ হস্তান্তর।
  • অনেকে নিখোঁজ, হতাহতের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা, স্বজনদের ভিড়।
  • বিষাক্ত ধোঁয়ায় সংজ্ঞাহীন হন ভুক্তভোগীরা, ছাদের দরজায় তালা।
‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
রাসায়নিকের গুদামে আগুন লাগলে ঘটে বিস্ফোরণ। এতে ছড়িয়ে পড়ে টক্সিক গ্যাস। ঘটে প্রাণহানির ঘটনা। গতকাল রাজধানীর মিরপুরে। ছবি: আজকের পত্রিকা
রাসায়নিকের গুদামে আগুন লাগলে ঘটে বিস্ফোরণ। এতে ছড়িয়ে পড়ে টক্সিক গ্যাস। ঘটে প্রাণহানির ঘটনা। গতকাল রাজধানীর মিরপুরে। ছবি: আজকের পত্রিকা

রোজকার মতো গতকাল মঙ্গলবারও তাঁরা পোশাক কারখানায় কাজে গিয়েছিলেন। আগুনে কারখানাতেই নিভে গেল তাঁদের জীবনপ্রদীপ। সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস। গুরুতর দগ্ধ তিনজনকে ভর্তি করা হয়েছে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। অনেকে নিখোঁজ থাকায় হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরের শিয়ালবাড়ীতে একটি পোশাক কারখানা ও পাশের রাসায়নিকের গুদামে আগুনে হতাহতের এই ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট কাজ করলেও সন্ধ্যা ৭টার পরও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। রাসায়নিকের কারণে সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরাও উদ্ধার তৎপরতায় যোগ দেন। এই উদ্ধার তৎপরতার মধ্যে কারখানার কর্মীদের ছবি হাতে তাঁদের সন্ধান করছিলেন স্বজনেরা। করছিলেন আহাজারি।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস শিয়ালবাড়ীতে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি অগ্নিকাণ্ডে আহত ব্যক্তিদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ দেন।

ঘটনাস্থলে সন্ধ্যা ৭টার দিকে সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী ১৬ জনের মরদেহ উদ্ধারের তথ্য জানান। তিনি জানান, পোশাক কারখানার একই জায়গা থেকে ৯ শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। নিহত ব্যক্তির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

সূত্র জানায়, দুপুর পৌনে ১২টার দিকে শিয়ালবাড়ীর ৩ নম্বর রোডে এম এস আলম ট্রেডার্স নামের একটি রাসায়নিকের গুদামে আগুন দেখা যায়। দোতলা গুদামটির ওপরের তলায় টিনের ছাউনি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই গুদামে আগুন লাগার পর বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান তাঁরা। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন গুদামটির পাশের চারতলা ভবনের একটি পোশাক তৈরির কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। রাসায়নিকের কারণে ধোঁয়া ও আগুনের তীব্রতায় পোশাক কারখানার শ্রমিকদের অনেকে ভেতরে আটকা পড়েন। কালো ধোঁয়ায় পুরো এলাকা প্রায় অন্ধকার হয়ে যায়।

তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ কেউ বলেন, আগুনের সূত্রপাত হয়েছে পোশাক কারখানার নিচতলার ওয়াশ ইউনিট থেকে। সেখান থেকে আগুন পাশের রাসায়নিকের গুদামে ছড়িয়ে পড়ে।

খবর পেয়ে প্রথমে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। আগুনের তীব্রতা বাড়ায় ফায়ার সার্ভিসের আরও সাতটি ইউনিট যোগ দেয়। আগুনের তীব্রতার কারণে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। রাসায়নিকের বিস্ফোরণ, ঘন ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাসের কারণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পক্ষে কাজ করা ছিল কঠিন।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সেখানে গিয়ে দেখি দুটি ভবনই জ্বলছে। কোথা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে; রাসায়নিকের গুদাম নাকি পোশাক কারখানা থেকে, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ৯টি লাশ একসঙ্গে স্তূপ আকারে ছিল। নিহত ব্যক্তিরা নারী না পুরুষ, তা বোঝা যাচ্ছে না।’

আগুনে দগ্ধ তিনজনকে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান বলেন, তিনজনকে গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

ফায়ার সার্ভিসের সূত্র বলছে, তাদের ধারণা, পোশাক কারখানার পাশের রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণের পর সেখান থেকে বিষাক্ত সাদা ধোঁয়া বা টক্সিক গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে, যা প্রাণঘাতী। আগুন খুব দ্রুত তৃতীয় ধাপে পৌঁছে যাওয়ায় ভুক্তভোগীরা সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। এ ছাড়া পোশাক কারখানাটির ভবনের ছাদের দরজায় তালা লাগানো থাকায় শ্রমিকেরা কেউ ওপরে উঠতে পারেননি। পোশাক কারখানার ভবন ও রাসায়নিকের গুদামের অগ্নিনিরাপত্তা সনদ ছিল না বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

ফায়ার সার্ভিসের সূত্র জানায়, ১৬টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে পোশাক কারখানার দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থেকে। বাইরে শত শত মানুষ। অনেকে এসেছেন স্বজনের খোঁজে।

নিখোঁজ নারগিস আক্তারের বড় বোন লাইজু বেগম চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমার বোন সকাল পৌনে ৮টায় কাজে আসে। বেলা ১১টার দিকে খবর পাই, আগুন লেগেছে। ভেতরের একজন ফোনে বলল, আপা, কেউ বের হতে পারছে না। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই।’

ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ড্রোনসহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু রাসায়নিকের উপস্থিতির কারণে অনেক জায়গায় যেতে পারছিলেন না।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা। আমরা কাউকেই ঢুকতে দিচ্ছি না, এমনকি আমাদের ফায়ার ফাইটারদেরও না। ধোঁয়া আর তাপ এত বেশি যে সেখানে যাওয়া মানে প্রাণ হারানোর ঝুঁকি।’ তিনি জানান, ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা যৌথভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও ৩০০ গজ দূরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

অনুমোদনহীন গুদাম, অজানা মালিক

স্থানীয়রা জানান, আগুন লাগা ভবনের নিচতলায় ছিল রাসায়নিকের গুদাম, ওপরের তলাগুলোতে পোশাক তৈরির কাজ হতো। আশপাশের বাসিন্দারা বলেন, সেখানে দিনের পর দিন দাহ্য পদার্থের গন্ধ পাওয়া গেলেও কারও তদারকি ছিল না।

ঘটনাস্থলে কারখানার মালিক বা ম্যানেজার, কাউকে পাওয়া যায়নি। পুলিশ জানায়, পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামের মালিকের খোঁজ পাওয়া যায়নি।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম বলেন, ‘যতটুকু জেনেছি, এটি আলম কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি। কিন্তু মালিকের কোনো মোবাইল ফোন বা যোগাযোগের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।’ গুদামের অনুমোদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে শুনেছি, এর অনুমোদন ছিল না। তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানানো হবে।’

ঘটনাস্থলে আলামত সংগ্রহ করে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের একটি দল। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, সিআইডির টিম রাসায়নিকের গুদাম ও নিহত ব্যক্তিদের নমুনা সংগ্রহ করবে।

ফায়ার সার্ভিস জানায়, উদ্ধার করা সব মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। সেখানে পরিচয় শনাক্তের পর মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করবে পুলিশ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতে আত্মহত্যা করা পুলিশকে ‘দুর্নীতিবাজ’ বলে তদন্ত কর্মকর্তারও আত্মহত্যা, রেখে গেলেন তিন পাতার ‘সুইসাইড নোট’

অব্যাহতি চাওয়ার পর মাউশি মহাপরিচালক আজাদ খানকে ওএসডি

‘জুলাই যোদ্ধাকে’ জুলাই ফাউন্ডেশনে পাইপ দিয়ে মারধর, ১৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা

ভারতের হারে বাংলাদেশের বিদায়, হামজার হতাশা

এবার দলগুলো পেল চূড়ান্ত জুলাই সনদ ও স্বাক্ষরের আমন্ত্রণপত্র

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত