Ajker Patrika

স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে গেল বুর্জোয়ারা: অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম

ঢাবি প্রতিনিধি
স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে গেল বুর্জোয়ারা: অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম

ব্যক্তি মালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করাই ছিল গণ-অভ্যুত্থানের মূল বাণী। কিন্তু পরে রাষ্ট্রক্ষমতা পেল বুর্জোয়ারা। মানুষের ভেতর যে চেতনা এসেছিল সেটির আর বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি। 

এমন মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। 

শুক্রবার (২৩ জুন) বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম তাঁর ৮৮ তম জন্মদিন উপলক্ষে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও একক বক্তৃতায় এসব কথা বলেন। 

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান থেকে আমরা কী পেলাম? দুটো প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছিল: একটি হচ্ছে স্বাধীনতা, অপরটি হচ্ছে বিপ্লব। স্বাধীনতা এল কিন্তু বিপ্লবটা এল না। ফলে যেটি ঘটল যে বুর্জোয়ারা রাষ্ট্র ক্ষমতা পেয়ে গেল। যে পরিবর্তনটা মানুষের চেতনার ভেতর এসেছিল সেই চেতনার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটবে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেটা ঘটল না। তরুণেরা সেসময় প্রতিবাদ করছিল, বিভিন্ন অনিয়মের। কিন্তু তারা সমাজতন্ত্রের কথা বলছে না। পরিবর্তন আসছে, পরিবর্তনটা হলো এ রকমের...যে তরুণ কবি কবিতা লিখেছিল একদা বেশ্যার বিড়াল নিয়ে, সেই কবি স্বাধীনতার পরে ভাত দে হারামজাদা লিখছে। ভাত দে হারামজাদা কোথা থেকে পেলেন তিনি? এটা পেলেন দেয়ালের লিখন থেকে, এই পরিবর্তন ঘটছে। কিন্তু আর এগোতে পারেননি।’ 

তিনি বলেন, ‘ফররুখ আহমদ তাঁর কালের সবচেয়ে শক্তিশালী কবি ছিলেন, তিনি প্রথম জীবনে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে “সাত সাগরের মাঝি” কবিতায় তীব্র ঘৃণা জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি পাকিস্তানপন্থী হয়ে গেলেন। হায়াত দারাজ খান পাকিস্তানপন্থী হয়ে গেলেন, সৈয়দ আলী আহসান যিনি প্রভাবশালী একজন অধ্যাপক ছিলেন, তিনি পাকিস্তান হওয়ার পর লিখেছেন যে প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত বাদ দেব। কেননা—আমাদের কাছে রাষ্ট্রের সংগতি অনেক বেশি জরুরি। তিনি এও বলেছিলেন যে, আমি আমার আগের লেখাগুলো বর্জন করছি, ওইগুলো অনুশীলন ছিল। তখন তিনি খুবই সুন্দর কবিতা লিখছেন—আমার পূর্ববাংলা’ নামে। এই পরিবর্তনটা ঘটছিল কিন্তু সৈয়দ আলী আহসান অ্যান্টি কমিউনিস্ট ছিল, একেবারে শুরু থেকে। তিনি লিখেছেন অ্যান্টি গ্লোরিং নামে কবিতা, লাল বন্ধুদের জ্ঞান গ্রহণ করে কবিতা এবং যারা কাস্তে শান দিতে পারে তাদের বিরুদ্ধে কবিতা। তিনি রয়ে গেলেন, পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী মানুষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী হলেন কিন্তু অ্যান্টি কমিউনিস্ট রয়ে গেলেন।’ 

দ্বিজাতি তত্ত্বের ফলে সাম্প্রদায়িকতার শুরু মন্তব্য করে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের উপমহাদেশে শ্রেণি সমস্যা ও জাতি সমস্যা রয়েছে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় জাতি সমস্যা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেখানে ভ্রান্তি ঘটেছিল এভাবে, ভারতকে এক জাতির দেশ বলল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। এরপর মুসলিম লীগ বলল এখানে দুই জাতি আছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িকতা হলো। হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায় জাতি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। এর মধ্যে দেশভাগ হলো। দেশভাগ একটি বড় রকমের দুর্ঘটনা। পাকিস্তানি কী রকম অদ্ভুত রাষ্ট্র ছিল। দুই অঞ্চল বিশাল ব্যবধানে অবস্থিত, মধ্যখানে আরেক দেশ। আইয়ুব খানের দুশ্চিন্তা ছিল ৫৬ শতাংশ বাঙালি। জিন্নাহ সাহেব তখন পাকিস্তান নিয়ে দর-কষাকষি করছেন। তখন আরাকান ও ত্রিপুরা পাকিস্তানে আসার সম্ভাবনা ছিল। কলকাতা যে চলে গেল, এতে জিন্নাহর মাথাব্যথা ছিল না। কলকাতা থাকলে সেটা রাজধানীর করার আলাপ উঠত, সে না হওয়ায় তিনি তার জন্মভূমি করাচিকে রাজধানী করতে পারবেন।’ 

নদীর ওপর পাকিস্তানের নেতাদের গুরুত্ব না দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই উপমহাদেশ নদীর ওপর নির্ভরশীল, পাঞ্জাবে নদী আছে, সেগুলোর ব্যাপারে নেহরু অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। নদীর বিষয়ে র‍্যাডক্লিফকে প্রভাবিত করতে তিনি তৎপর ছিলেন। পূর্ববঙ্গের নদী নিয়ে পাকিস্তানের মাথাব্যথা ছিল না। মালদহ ও মুর্শিদাবাদ প্রথমে পাকিস্তানে আসার কথা ছিল। মুসলিমপ্রধান হিসেবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। এমনকি সেখানে পাকিস্তানের পতাকা তোলা হয়েছিল। পরে দেখা গেল সেটা ভারতে চলে গেল। কারণ ভারত এটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে। বিশেষ করে গঙ্গা-পদ্মার ওপরে যে কর্তৃত্ব—এই দুই জেলার মধ্য দিয়ে সম্ভব ছিল। ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্যেই পূর্ববঙ্গের প্রতি অবজ্ঞা দেখা যায়।’ 

করোনার প্রসঙ্গে টেনে এনে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্ব একটি গভীর সংকট মোকাবিলা করছে। করোনা হলো সবচেয়ে বড় সংকট, এত বড় সংকট মানব সভ্যতার ইতিহাসে হয়তো আর দেখা যায়নি। হাজার হাজার বছর ধরে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেই সভ্যতা যুদ্ধ, ধ্বংস, বর্ণবাদ এসবের মাধ্যমে ব্যবসা—এগুলো করবে! অন্ধকারকে আরও গাঢ় করবে, নাকি এ পৃথিবীকে বদল করার চেষ্টা করবে? এই প্রশ্নটা আজকে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আজকে আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কথা শুনি, সেই বুদ্ধিমত্তা আসবে কিন্তু তার মালিকানা কি ব্যক্তিগত থাকবে নাকি সেটি সামাজিক হবে সেটি প্রশ্ন আমাদের। এটি কি দৈত্যের মতো ধ্বংস করবে। এই প্রশ্ন আমাদের বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রশ্নের জবাব আছে সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।’ 

ব্যক্তি মালিকানার হাজার হাজার বছরের ইতিহাস পরিত্যাগ করতে হবে উল্লেখ করে এ বাম বুদ্ধিজীবী বলেন, ‘সামাজিক মালিকানায় যেতে হবে। সামাজিক মালিকানায় না গেলে পৃথিবীতে মানুষ বসবাস করতে পারবে কি পারবে না সেই সংশয় দেখা দিবে। এটা শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, প্রত্যেকটা দেশে এ সমস্যাটা রয়েছে। সমস্যা সমাধান রয়েছে সামাজিক বিপ্লবে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান সামাজিক বিপ্লবের সম্ভাবনা ছিল, এগিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করা যায়নি। আজকে পৃথিবীর সব দেশের মানুষ ব্যক্তি মালিকানার হাজার হাজার বছরের ইতিহাস বদল করে সামাজিক মালিকানায় নিয়ে যেতে চায়। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মূল বাণী বলে আমি মনে করি—সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে হবে।’ 

শুধু স্বাধীনতা নয়, প্রয়োজন রয়েছে বিপ্লবের। সেই বিপ্লব আইয়ুব খানের বিপ্লব নয়, এ বিপ্লব সামাজিক বিপ্লব, মানুষের মুক্তির বিপ্লব। যে মুক্তির জন্য জনগণ পাকিস্তান চেয়েছিল, সে পাকিস্তান হয়নি বলে তারা বিদ্রোহ করেছে। বাহান্নতে করেছে, উনসত্তরে করল, একাত্তরে যুদ্ধ করল, প্রাণ দিল। প্রাণ দিয়ে সেই পাকিস্তানকে বিদায় করল, সেই রক্তগঙ্গা বয়ে গেল যার কথা আইয়ুব বলেছিলেন। পাকিস্তান ভেঙে গেছে, টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানও টিকবে না। এখন প্রয়োজন ব্যক্তি মালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা। এটি ছিল উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের মূলবাণী—যোগ করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। 

এএসএম কামালউদ্দিনের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা–কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত